''হঠাত অনেক লোকের আনাগোনা,চেঁচামেচি কানে এলো।একজন বাংকারের মুখে উঁকি দিয়ে চিতকার করলো,কই হ্যায়:ইধার আও। মনে হলো আমরা সব এক সঙ্গে কেঁদে উঠলাম। ঐ ভাষাটা আমাদের নতুন করে আতঙ্কগ্রস্ত করলো।কয়েকজনের মিলিত কন্ঠ,এবারে মা,আপনারা বাইরে আসুন । বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা আপনাদের নিতে এসেছি। চিরকালের সাহসী আমি উঠলাম। কিন্তু এতো লোকের সামনে আমি সম্পূর্ণ বিবস্ত্র,উলঙ্গ। দৌড়ে আবার বাংকারে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যে বলিষ্ঠ কন্ঠ প্রথম আওয়াজ দিয়েছিলো, কোই হ্যায়, সেই বিশাল পুরুষ আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে নিজের মাথার পাগড়িটা খুলে আমাকে যতটুকু সম্ভব আবৃত করলেন।. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . আমি ওই অধিনায়ককে জড়িয়ে ধরে চিতকার করে কেঁদে উঠলাম।''
'আমি বীরাঙ্গনা বলছি' বইটার এই অংশটুকু পড়েই আমি প্রথম বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে জানতে পারি।
তখন আমি কাস ফোর কি ফাইভে পড়ি। ছোটতে যতো সহজে আমরা মুখস্ত করে যাই,'ত্রিশ ল শহীদের রক্ত এবং দু'লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা অর্জন করেছি', ব্যাপারটা কি অতোটা সহজ?-এ প্রশ্নটা সবসময়ই আমার মধ্যে কাজ করত। যখন একটু বড় হলাম, একটু বুঝতে শিখলাম, বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে জানলাম তখন বুঝলাম দেশের জন্য,প্রিয় স্বাধীনতার জন্য আমাদের মা-বোনেরা কী ত্যাগ করেছেন আর তাঁদের এ ত্যাগ কতটা মহিমান্বিত!
কিন্তু যখন আরো একটু বড় হলাম,আরো কিছু বুঝতে শিখলাম,তখন চরম বিস্ময়ের সাথে এটাও বুঝলাম,তাঁদের এই মহত ত্যাগকে এ সমাজ কতখানি অবহেলার সাথে অবহেলা করেছে।
যদিও ড. নীলিমা ইব্রাহিমের 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি' বইটার সাথে আমার পরিচয় কাস ফোর কি ফাইভে,কিন্তু বইটা পুরোপুরি ভালোভাবে পড়ার সুযোগ হয় কাস টেনে।পরবর্তীতে আবার বইটা পড়ি এইচএসসি পরীক্ষার পর।বইটা যখন প্রথম হাতে নেই,আমার ধারণা ছিল,এতে শুধু বীরাঙ্গনাদের দু:খ-অবহেলা-নির্যাতনের কথাই বলা হয়েছে,কিন্তু যখন পড়া শুরু করলাম,অবাক হয়ে ল্য করলাম,আমাদের বীরাঙ্গনা মা-বোনেরা কতটা আত্মপ্রত্যয়ী।তাঁরা কখনোই নিজেদের বীরাঙ্গনা বলে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করেননি,বরঞ্চ এ সমাজই তাঁদের যোগ্য মর্যাদা দিতে পারেনি।কী লজ্জা!কী লজ্জা!
এ প্রসঙ্গে বীরাঙ্গনা রীনার কথাটা মনে পড়ছে-
'. . . . . . . . . . . . . . .বাংকার থেকে আমাকে যখন ভারতীয় বাহিনীর এক সদস্য অর্ধ উলঙ্গ এবং অর্ধমৃত অবস্থায় টেনে তোলে তখন আশেপাশের দেশবাসীর চোখে মুখে যে ঘৃণা ও বঞ্চনা আমি দেখেছিলাম তাতে দ্বিতীয়বার আর চোখ তুলতে পারি নি।জঘন্য ভাষায় যেসব মন্তব্য আমার দিকে তারা ছুড়ে দিচ্ছিল. . . ভাগ্যিস বিদেশীরা আমাদের সহজ বুলি বুঝতে পারে নি।'
কিংবা
'. . . . . . . যুদ্ধের উন্মাদনায় আমাদের কথা তো কেউ মনে রাখে নি।পেছনে পড়েছিল গর্ভবতী স্ত্রী,বিধাব মা,যুবতী ভগ্নী কারও কথাই সেদিন মনে হয় নি। অথচ তাদের আত্মরার তো কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। বৃদ্ধ পিতা-মাতা মরে বেঁচেছেন,গর্ভবতী স্ত্রীর সন্তান গর্ভেই নিহত হয়েছে।অথচ আজ যখন বিজয়ের লগ্ন এসেছে,মুক্তির মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে তখনও এক বুক ঘৃণা নিয়ে তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করছে সামাজিক জীবেরা। একটা পথই এসব মেয়েদের জন্যে খোলা ছিল-তা হলো মৃত্যু। নিজেকে যখন রা করতে পারে নি,তখন মরে নি কেন? সে পথ তো কেউ আটকে রাখে নি। কিন্তু কেন মরবো? সে প্রশ্ন তো আমার আজও। মরি নি বলে আজও আর পাঁচজনের মতো আছি,ভালোই আছি,জাগতিক কোন সুখেরই অভাব নেই।নেই শুধু বীরাঙ্গনার সম্মান। উপরন্তু গোপনে পাই ঘৃণা,অবজ্ঞা আর ভ্র'কুঞ্চিত অবমাননা।'
-বীরাঙ্গনা রীনার এ ক্ষোভগুলো বুকের মাঝে এসে আঘাত করে।আমরা এতোটাই অকৃতজ্ঞ??
বীরাঙ্গনা তারা ব্যানার্জী যখন ড. নীলিমা ইব্রহিমকে বলেন,
'. . . . . .আপা দেশ স্বাধীন হয়েছে,কেউ গাজী-কেউ শহীদ।কেউ বীর উত্তম,বীরশ্রেষ্ঠ,কেউ মন্ত্রী,কেউ রাষ্ট্রদূত সবার কতো সম্মান সুখ্যাতি। আর আমি? আমি কিছুই চাইনি,চেয়েছিলাম শুধু আমার নারীত্বের মর্যাদা আর প্রিয় জন্মভূমির বুকে আশ্রয়।স্বদেশে আমার সত্যিকার পরিচয় নেই,তারা ব্যানার্জী মরে গেছে।সেখানে সেদিন সম্মান মর্যাদা সবই পেলো মিসেস টি.নিয়েলসন আর টমাসের মা। আমি কোথায়?ওদের কাছে আমি ঘৃণ্য,নিন্দিত,মৃত।. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .. . . . . . . . . . . . . .আমি যখন পুনর্বাসন কেন্দ্রে ছিলাম,কতো স্বামী-ভাই-বাবা এসেছেন মুসলমান সমাজের কিন্তু মেয়ে,বউকে কেউ ফিরিয়ে নেন নি। একজন আর্মি অফিসারও ছিলেন।তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন;বউকে বললেন মাসে মাসে টাকা দিতে পাওের কিন্তু ঘরে নিতে পারবেন না।মনে হয় এতোদিনে জেনারেল হয়ে গেছেন তার বীরত্বের পুরস্কার পেয়েছেন,আর সুলতানা সম্ভবত টান বাজারে জীবনযুদ্ধের শেষ লড়াইয়ে ব্যস্ত।'
তখন মনে হয় একজন মানুষ হিসেবে,একজন বাংলাদেশী হিসেবে এ লজ্জা রাখার জায়গা কোথায়?যারা এমন সংকীর্ণমনা কাজ করেছে তারা কি কখনও তাদের ব্যর্থতাটা উপলব্ধি করে নি?অবশ্য তাদের সে যোগ্যতা কিংবা উপলব্ধি করবার মতো মন আছে কিনা সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।
তবে যখন আর্মির ডাক্তার মুক্তিযোদ্ধা নাসির রীনাকে বলেন,
'আমিও তো মুক্তিযোদ্ধা আর সেটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাহলে তোমারই-বা অহংকার থাকবে না কেন?লজ্জা?কিসের লজ্জা?লজ্জা তাদের যারা দেশের বোনকে রা করতে পারেনি।শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছে। আমাদের এ অপরাধের জন্য আমি সবার পক্ষ থেকে তোমার কাছে মা চাইছি।'
আবার বীরাঙ্গনা শেফার জবানবন্দীতে যখন দেবদূতসম শিখ অধিনায়ক যোগীন্দর সিং সম্পর্কে জানতে পারি,তখন তাঁদের প্রতি অন্যরকম এক শ্রদ্ধা জেগে ওঠে। শুধু যোগীন্দর সিং বা ডা. নাসির নয় ,বইটিতে যে সাতজন বীরাঙ্গনার কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে,তাদের প্রত্যেকের পরিবারই তাঁদের নিয়ে গর্ব করে।কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেেত্র এ সমাজের ভ্রূকুটির কাছে তারা ছিলেন অসহায়।এর চেয়ে কষ্টের কথা আর কি-ই বা হতে পারে??
'আমি বীরাঙ্গনা বলছি' বইটিতে তারা ব্যানার্জী,মেহেরজান,রীনা,শেফা,ফাতেমা,ময়না,মিনা-এ সাতজন বীরাঙ্গনার কথা,তাঁদের মহৎ ত্যাগ এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী তাঁদের আত্মপ্রত্যয়ী পথ-চলার কথা ড. নীলিমা ইব্রহিম অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তুলে ধরেছেন।লিখেছেন বীরাঙ্গনাদের ওপর চালানো পাক-পশুদের অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা যা পড়ে প্রতি মুহূর্তে শিউরে উঠতে হয়। সেই সাথে তুলে ধরেছেন আমাদের আস্তাকুঁড়রূপী সমাজের প্রতিচ্ছবি।
বীরাঙ্গনা শেফা রাজাকার ফারুকের স্বাধীনতা-পরবর্তী অবস্থান বর্ণনা করেন এভাবে-
'ফারুক এখন জজ সাহেব।আর কখনো হাফ হাতা শার্ট পরে না।কেউ হাতের দাগ দেখে ফেললে বলে মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়েছিল বেয়োনেট চার্জে। দেখুন তাহলে এ দেশে মুক্তিযোদ্ধা কারা!'
এই ফারুক হলো সেই ফারুক যে কিনা শেফাকে আটক করে নিয়ে গিয়ে তুলে দিয়েছিল পাক-আর্মিদের হাতে আর সে সময় ওই পশুর হাত থেকে বাঁচার জন্য শেফা কামড় বসিয়ে দেন ফারুকের হাতে।সেই পাপের নিশানা হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের নিশানা! আর সেটা কিনা বহাল তবিয়তে সে বলেও বেড়াতে পারছে! আমাদের মুক্তিযোদ্ধা-বীরাঙ্গনাদের ত্যাগ কি এতোটাই দুর্বল?রাগে-দুঃখে মাঝে মাঝে আর কিছুই বলার থাকে না।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যতগুলো বই আছে,এ বইটি নি;সন্দেহে তাঁদের মধ্যে এতোটাই অন্যতম যে আমার মতে,এ বইটি না পড়লে মুক্তিযুদ্ধের একটা বড় অংশ আমাদের অজানা থেকে যাবে।তারা,মেহেরজান,শেফারা তো শুধু তাঁদের কথা বলেননি,তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেছেন দেশের প্রতিটি বীরাঙ্গনা মা-বোনদের যাঁরা দেশের জন্য,দেশের মাটির জন্য নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদকে বিলিয়ে দিয়েছেন হৃদয়ের রক্ত দিয়ে,প্রিয় স্বাধীনতার জন্য নিজেকেই করে তুলেছেন সবচাইতে বড় অস্ত্র।অনেক মা-বোনেরা পাক-হানাদারদের নির্মম অত্যাচারে প্রাণ হারিয়েছেন,যাঁরা বেঁচেছিলেন তাঁরাও ভোগ করেছেন নরক-যন্ত্রণা।অনেকে সমাজের ধিক্কার থেকে নিজেকে বাঁচাতে বুকে পাথর বেঁধে তারা কিংবা মেহেরজানের মতো ছেড়ে গেছেন নিজের দেশকে।
তাই বুঝি মেহেরজান বলেছেন-'আমি জীবনের সব পেয়েছি কিন্তু মাটি হারিয়েছি।'
যে দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন,তার মাটিতেই ধিক্কৃত হবার ভয়ে তিনি আজ সেই দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচিত যার মানুষরুপী হায়েনারা তাঁর ওপর চালিয়েছিল বর্বোরচিত অত্যাচার।এমন আরো কত বীরাঙ্গনার বুকের কান্না স্তব্ধ হয়ে গেছে,কতজন মেহেরজানের মতো বাড়ির কোণের শিউলি-গাছটার জন্য মন খারাপ করেছে তার হিসেব কি ক’টা সংখ্যা দিয়েই উপলব্ধি করা যায়?
তারপরও যখন দেখেছি বীরাঙ্গনা মা-বোনেরা সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে নতুন প্রত্যয়ে জীবনে পথ-চলা শুরু করেছেন,তখন সত্যিই গর্বে বুকটা ভরে ওঠে।বীরাঙ্গনা হিসেবে তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের যে গর্ববোধ তা বোধ করি দু:স্বপ্নের কালো আঁধার কেটে ভোরের সূর্যালোকেরই নিশান দেখায়।আমরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনুষ্ঠানে-আলোচনায় অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানাই,তাঁদের কথা শুনি,সংবর্ধনা দেই।কিন্তু ক'টা জায়গায় বীরাঙ্গনাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়?ক'টা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়?তাহলে স্বাধীনতার এতো বছর পরেও কি আমাদেও সংকীর্ণতা দূর হয় নি?আজও কি আমাদের বিবেকে এটুকু সাহস অজির্ত হয় নি যাকে অবলম্বন করে আমরা পারি প্রকৃত বীরদের তাঁদের প্রাপ্য সম্মান টুকু দিতে?
বীরাঙ্গনাদের নিয়ে বেশ কিছু নাটক করা হলেও আমার জানামতে,এ বইটির ওপর ভিত্তি করে এখন পর্যন্ত কোন মুভি তৈরি হয়নি। মুভি বা মিডিয়া মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ তৈরি করার একটি মাধ্যম,তাই এ বিষয় নিয়ে মিডিয়ায় আরো কাজ হওয়া উচিত।সমাজ ও সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ক্ষেেত্র মিডিয়া অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।যারা'আমি বীরাঙ্গনা বলছি' এমন একটি বই যা পাঠকের বিবেককে কিছুটা হলেও নাড়া দেয়,মুক্তিযুদ্ধের প্রাপ্তির গভীরতাকে গভীর থেকে গভীরতর করে জাগ্রত করে।
সবশেষে বীরাঙ্গনা রীনার শেষ কথাটুকু বলতে চাই যা আমার মনকে সবসময় আলোড়িত করে,
'. . . . . .একটি মুহূর্তের আকাক্সা মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত রয়ে যাবে।এ প্রজন্মের একটি তরুণ অথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে,বীরাঙ্গনা আমরা তোমাকে প্রণতি করি,হাজার সালাম তোমাকে।তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা,ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে।জাতীয় সংগীতে তোমার কন্ঠ আছে।এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার।সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণ মুহূর্তে পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইবো।'
আর এ প্রজন্মের একজন হয়ে আমিও তেমনই একটি মুহূর্তের প্রতীক্ষায় থাকি,যেদিন আমার সৌভাগ্য হবে কোন এক বীরাঙ্গনা মা-কে প্রাণ ভরে দেখার,সসম্মানে তাঁকে সালাম জানাবার. . . .।