তুমি আমার কে? এই বলে তুমি হারিয়ে গেলে শাদা বৃষ্টির ভিতর। তোমার চোখে রাগ আর চোখের ভিতরে আরক্ত অভিমান। তারপর বৃষ্টি শেষে আমি পথের মাঝে পড়েছিলাম বৃষ্টিদগ্ধ লেবুপাতা। আমার স্মৃতিতে ছিলো ঝড়ের স্পর্শ, বৃষ্টির আগে যে ঝড় এসে রাঙিয়ে দিয়েছিলো ধূলির অরণ্য। তুমিও ছিলে না, আমি একাই পান করেছি অন্ধকার দিবসের সকাতর কুয়াশা। বুকের একপাশে ঝড়-বিজলি আর বৃষ্টি ছিলো। আর পাশে যে তুমি ছিলে তা বলতে পারি না। শূন্যতার অন্যনাম যদি তুমি, তবে ছিলে।
বৃষ্টির আঘাতে বকুলেরা যেদিন কেঁদেছিলো তোমাদের দালানগুলির সামনের রাস্তায়—সেদিন আমিও ছিলাম। তাদের কান্নার আনন্দে আমি কাঁদতে পারি নি ঠিকই—আমি তাদের কান্না হয়েই ছিলাম। আর চারতলার জানলার শার্সিতে চোখ রেখে তুমি বাষ্পখাতা। দেয়ালের ওধারে মাঠ ছিলো একফালি। আনন্দ ছিলো ওখানে শূন্যতার সহোদর ভাই। শ্যামল রঙের ছায়া এক ঘিরে থাকে মাঠের পাঁজর। মাঠ ভাবে বিকেল এনে দেবে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির সন্ধ্যা। দুইশোকোটি পাতা ঝড়ের মুখে। ওরা উড়ে যায় মিছিলের মতো। তারপরও প্রান্তরটিকে ছুঁয়ে যায় না। প্রান্তরের চোখ তখন মাছের চোখ। আর বুকের অতলে উথল জল ছিলো দ্বিধায় পাথর। কম্পমান শিশিরেরা নিমেষের ঘোরকে হত্যা করে একটা প্রান্ত খুঁজে। একটি অধর কাঁপে; তারপর কাঁপে ওষ্ঠাধর। একটি হাত ছিলো—ঢেকেছিলো চোখ। এখন হাতখানি একটি গাছের সবচে’ কনিষ্ঠ ডাল।
অতঃপর উদ্ভ্রান্ত কালের পক্ষাঘাতে পাঁজর ভাঙে মাঠের শরীর। আমি যদি মাঠ হই—তুমি আনন্দিত, আনন্দিত সেও। শুধু একজন আমার জন্যে নিরানন্দের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাদল হবে। তাকে চিনি না, চিনবো না একদিনও।
ধূপের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন জায়গাটি। শটটি নেয়া হবে এমন ভাবে দেখে মনে হবে ধূপের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। মিনিটখানেক ক্যামেরার চোখ হেঁটে যাবে ধোঁয়াধূসর পথে। তারপর একফালি ভূমি। কংক্রিটের। তারপর ইঞ্চিদুই জলের পরত। সেই জলে বিস্রস্ত রাশি রাশি বৃষ্টিবকুল। ক্যামেরার চোখ ধীরে উড়ে থামলো দুইজোড়া নগ্নপায়ে। ওরা দুইজন একটি ছাদের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। মেয়েটির কণ্ঠে গান, মেয়েটি তখন গীতবিতান। গানটি দিগন্ত ছুঁয়ে পুনর্বার ফিরছিলো ওই ঝুমবৃষ্টির ইঁদারায়। ছেলেটি তাকিয়ে আছে মেয়েটির বিপরীতে যেখানে দিগন্তে পাহাড়ের সারি ধূসরনীল সমুদ্রের রেখা হয়ে কাঁপছে বৃষ্টির ভিতর। মেয়েটি কণ্ঠে গান ধরেই তাকায় আকাশে। বৃষ্টির ফোঁটা নামে তার চোখের ভিতর। তার চোখে একটি ক্লোজ শট। ক্যামেরার চোখ আকাশের দিকে; ফলত বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা স্পষ্ট। ক্রমে থামে গান। তারপর ধূপের আঁধার ঝড়ের মুখে।
সর্বসাকুল্যে তিনচার মিনিটের বিস্তার। এইভাবে একটি চিত্রনাট্যের খসড়া তার কাছে মোটামুটি বর্ণনা করে সমস্যাটি বললাম, মেয়েটির চোখে ততোখানি শূন্যতা থাকতে হবে—ঠিক যতোটা শূন্যতা গানটির একটি মাত্র লাইনে আছে। ফরিদ মজুমদার ক্যামেরা নিয়ে এসেছে; ঝুমবৃষ্টি নামলে আজই শট নিতে চাই। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত নিষ্পলক। প্রাণের গভীর থেকে তাকে বললাম, আমার সাথে তবে কেনো তুমি বৃষ্টিতে ভিজবে না, গীতবিতান? প্রত্যুত্তরে সে কী বলেছিলো আমার সত্যিই মনে নেই। ক্ষমা করো প্রার্থনা, ক্ষমা করো...। গুড়িবৃষ্টির তলে ফরিদের সাথে দেখা হলে শুধু বললাম, নতুন চিত্রনাট্য ভাবছি। তুই রেডি থাকিস।
আমার হাতের অঞ্জলিভর্তি বকুলের মালা, তাকে দেখালাম। তার প্রশ্নবোধক চোখ কী ছিলো বুঝি নি। বললাম, মালাটা তোমাকে দেবো না, গন্ধটা তোমাকে দিলাম, নাও। সে আমার অঞ্জলিতে মুখ ডুবিয়ে বকুলের সমস্ত গন্ধ নিয়ে নিলো। আর আমি যে কেঁপে কেঁপে নিঃস্ব হলাম—তা একটুও টের পেলো না। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিলো। তাকে ডেকে শুধালাম, বৃষ্টিতে ভিজবে না? অভিমান বললো, না। কেনো? যার সাথে ভিজবো সে যে নেই। আমি তাকে বলেছি কিনা মনে নেই, মানুষ জন্মাবধি নিজের সাথেই বসবাস করে। বৃষ্টিতে আমার মতন একা একাই ভিজতে হয় ইত্যাদি। তার চোখে সেদিনও তৃষ্ণা ছিলো। আজও আছে। আর তৃষ্ণার রঙ আমি বুঝতে পারি নি। তার মানে আমি ছবি আঁকতে পারি না জলের।
আজকে আমরা যাই নি ওখানে—অন্তত আমি। আমার খরায় নেমেছিলো চাঁদের কাজল। তৃষ্ণা ছিলো আষাঢ়ের তীব্র রোদের দিন। আমি আর সে বসেছিলাম পাশাপাশি। তার বিমূর্ত দুটি হাত আবেষ্টন করে রেখেছিলো আমার আবিষ্ট ডানহাত। আর বামহাতে বাতাসের সিঞ্চন—কবন্ধ সৌন্দর্যের শূন্যতা। একজন এগিয়ে আসছিলো আমাকে লক্ষ্য করে। প্রকৃত অর্থে আমি হয়তো লক্ষ্য নই। ঝুপড়ির অদূরে একটি পাথরে বসেছিলাম। তাই আমার এই বিভ্রম নিজের ভালোলাগার জন্যে ছাড়া নয়। তার নাম জানতাম বৃষ্টি। সে আসতে আসতে হাসলো। বললো, কেমন আছেন? আপনি কি আমার সাথে কথা বলবেন? এইতো বললাম। আপনি সময় করে নামতে পারেন না, বৃষ্টি? এই যে রোদে পুড়ে যাচ্ছি। সে হাসলো। পারলে তো নামতাম...! এইবার চুপিচাপ। তারপর বললাম, এই যে আমরা দুজন বসে আছি—আমরা কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজি না, নিরন্তর পুড়ে যাই। সে আমার পাশে কাউকেই বসা দেখতে পেলো না। খানিক অবাক হলো। আমার কথার ভুল অর্থ করলো বুঝতে পারলাম। খানিক অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়ালো কয়েক সেকেন্ড। সে চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ানোর আগেই বললাম, ঠিক আছে, যান।
একটা পাহাড় পেরিয়ে আমার কণ্ঠস্বর যখন আমার কাছেই ফিরে এলো—তখনো বুঝতে পারি নি পাহাড়ের ওপারে কোন দেয়াল। চমকে উঠলাম অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাতে। যেদিন উড়ে গেলো একঝাঁক রাঙা হরিণ—তাদের চোখে কেবলি মায়া ছিলো ছায়াময়, কাজলপুকুর। কল্পনা ছিলো দুইটি ডানা—দিয়েছিলো বকুলবনের একজন নিঝুম প্রজাপতি। আমার নিজের কণ্ঠ বৃষ্টির মধ্যে—প্রজাপতির গুনগুন গানে—হরিণের কান্নায়। না, ওধারে দেয়াল ছিলো না বালিয়াড়ি প্রাচুর্য নিয়ে। অলৌকিক বিকাশের পথ ধরে নতুন অসহায় ফুল ঝরে পড়ার শঙ্কায় কাতর হওয়ার আগেই শোভা পেয়েছিলো সেইদিন পৃথিবীর একজন চুলবতীর গাভীন খোঁপায়। সেই আনন্দে ফুল হয়েছে উত্তরোত্তর ফুল। আমার ওঙ্কার কেনো ফিরেছিলো দুইটি চোখের কূলে। দুইটি বাদামপাতায় ছিলো শ্যামলচুম্বনের সাবলিল গন্ধ। অন্ধপ্লাবন তারপরও ঘোলাটে করে দেয় আদিগন্ত পৃথিবী। কোনো দেয়াল থাকার কথাই ছিলো না। তারপরও অথৈ শ্রাবণ। তারপরও কাজলপুকুর। তারপরও বেদনায় থরথর আনন্দ। তারপরও দেয়াল এবং দেয়ালের বিভ্রম।
আমি তোমাকে বলি নি বৃষ্টি হবে। তারপরও তুমি মেঘের শাড়ি পরে নেমেছিলে শহরের ব্যস্ত এক রাস্তায়। ঝুমবৃষ্টি নামলে ধূলির নূপুরগুলি সব পলাতক, কাদাজলে। তুমি সেই কাদার আলতা পরে নেচেছিলে বৃষ্টিদগ্ধ সন্ধ্যায়, আমারি মতন। তোমার হাতে ছিলো আমার দেয়া বাঁশিটি। রঙ তার কালো। আমার খুব প্রিয় ছিলো ওটা। তোমার দিদির হাতে বাঁশিটি দিয়ে বলেছিলাম, অনিন্দ্যকে বলো এই বাঁশিতে ভরে দিয়েছি আমার দীর্ঘশ্বাস। মৃন্ময়ী বললো, ও ছোটোমানুষ, বুঝবে না তোমার এইসব কথা। না বুঝলেও ওর মনে তো থাকবে! একদিন বুঝবে। দিনের শেষে তুমি বৃষ্টির ভিতর ডুবে কেঁদেছিলে। তোমার কান্নার জলে আমি জন্মাবধি নির্ঝর, তা তো জানতে পারোনি কিছুই; কেবলি ছেড়ে গেছো। পুনর্বার ছেড়ে যাও। তারপরও আমার বাঁশিতেই বাজবে তোমার কণ্ঠের সুর।
শাটলট্রেনের জানলার ধারে বসেছিলাম। একজন আমার বামপাশে। ঝুমবৃষ্টিটা নামলে আমি শাটার নামাইনি। আমি ভিজে গেলাম দৃশ্যত। মূলত বৃষ্টিতে আমি নিরন্তর পুড়ে যাই। সে বললো, তুমি আমাকে ভিজিয়ে দিলে? বললাম, তাতে কী! আমি তো কেবল তোমার ডানপাশটাই ভেজাতে পেরেছি।
শ্রাবণকে সাথে নিয়ে তুই অবশেষে একা হয়ে গেলি। আর একজন তোর সিঁথিতে আগুন দেখে বিস্ফারিত চোখে নিভিয়েছে বৃষ্টি। তোর চোখেও সমুদ্র নিভে গেছে। এখন লবণের মাঠে খরা। জমেছে বিষাদের সুতীব্র ভাঙন। তুই আনন্দিত। সেদিনও সে তোর নামে অনুযোগ করেছে একটা সবুজ প্রজাপতির কাছে; বলেছে, দ্যাখো, দ্যাখো, গায়ত্রীটা কতো বড় হয়ে গেছে! গায়ত্রী! তুইও ছেড়ে গেলি সকলের মতো। তারপরও সে ঝরছে অবিরত।
বৃষ্টি জারুলবনে নেমে দাঁড়িয়েছে ঘাসে ঘাসে। বাতাসে ভাসে তার পায়ের পাতা। দুটি পা তার রোদের শরীর হলে তার নাম মেঘ হয় না; হয় সোনালি আগুন। আগুনের আঁচে চোখ পুড়ে যায়; চোখপোড়া ঘ্রাণে থমকে থাকে এলোকেশী বৈশাখ। বুক পুড়ে যায়; বুকপোড়া ঘ্রাণে থমকে থাকে আষাঢ়ের আলোছায়া। তার কাঁধে ব্যাগভর্তি বিজলি। বিজলি আছে নিবিড় রামধনুর জন্যে। তার চোখে রঙের চশমা মেলেছে ফাঁদ অমর অসুখের। সেই অসুখের নামে জল কাঁপে জলের শরীরে। অতঃপর অন্যকথা লেখা হয়—যার জন্যে সে আগন্তুক।