বাউল একটি বিশেষ লোকাচার ও ধর্মমত।এই বাংলার মাটিতেই প্রথম সৃষ্টি হয়েছে বাউল মতের। ফকিরি ভাষায় সাধারণ মানুষরা হল “আউল”।আউল’রা গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে “বাউল” হয়।বাউলের কোন গ্রন্থ নেই,বাউল একটা টাইটেল বা উপাধি।অন্য কথায় বাউলেরা “সর্বকেশী”।তারা সন্ধানে চলেন,হাওয়ার সন্ধানে। “বাও” মানে হল বাতাস,আর “উল” মানে সন্ধান।বাউল’রা সরুপ থেকে অরুপ-এর খোঁজ করেন।অরুপের সন্ধান করতে গিয়ে তাকে চিনে নেয়াই হল মূল বাউলত্ব।এই চেনা চিনির পথে গুরু ও লালনের গানই হল বাউলদের অনিবার্য অবলম্বন।ফকিরি জীবন হল মানব জীবনের আরেক রুপ।ফকিরদের ভাষায়, “জাগতিক লোভ লালসা থেকে শান্তিময় মুক্ত এক জীবন”।
লালন সম্পর্কে কম বেশি সকলেই হয়ত জানে।এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।
বাউলেরা গানের সময় সাধারণত যেসব বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার করে থাকে,তাদের মধ্যে অন্যতম হল “দোতারা”।দোতারা’র তারের সংখ্যা ৪টি।তার পরেও একে দোতারা বলা হয় কেন?বলে দিচ্ছি।বাউলেরা দোতারা বাজিয়ে থাকে ৩টি তার হিসাবে।মাঝের ২টি তার কে বলা হয় “যুগল”,মানে হল এই দু’টি তার একই স্বরে বাঁধা।এই যুগল শব্দ দিয়েই এ বাদ্য যন্ত্রের নাম হয়েছে দোতারা।আবার যদি সেই দু’টি তার কে যুগল না ধরে ৪টি হিসেবে ধরা হয়,তখন এর নাম হয়ে যাবে “শরদ”।আরও আছে,এই ৪টি বাদ দিয়ে যদি আবার ৮টি তার দেয়া হয়,তবে সেটি হয়ে যাবে “ম্যান্ডোলিন”।একই বাদ্য যন্ত্র তারের পার্থক্যে বিভিন্ন নাম ধারণ করে।
আমরা সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছি যে,বাউলেরা সাধারণত কোন কাজ করে না।সারাদিন পাতা-ফাতা খায় আর বসে বসে ঝিমায়।আসল ব্যপার কিন্তু মোটেও এরকম না।সব বিখ্যাত লালন সাধকই কিছু না কিছু করে ভাত জোটাতেন।কুষ্টিয়া’র বিখ্যাত লালন সাধক আব্দুর রব ফকিরের মুখে কিছু কথা শোনা যাক,
-কর্ম থাকবেই,থাকতেই হবে।কর্মকে সাঁইজী সব সময়ই ভালবেসেছেন।কর্মহীন জীবনে তো কোন ভজন সাধন নেই।কেউ যদি এরকম থাকে,তবে সে ব্যটা তো ছন্নছাড়া।পৃথিবীতে ধর্মের আরেক পাঠ হচ্ছে কর্ম।
সাধারণত বাউলেরা প্রথমে কোথাও গান গাইতে গেলে প্রথমেই যে গানটি গেয়ে আসর শুরু করে থাকে,তা হল-
“জগত মুক্তিতে ভোলালেন সাঁই।
ভক্তি দাওহে যাতে চরণ পাই।।
ভক্তিপদ বন্দ চিত্ত করে
মুক্তিপদ দিচ্ছ সবারে
যাতে জীব ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে
কাণ্ড তোমার দেখতে পাই।”
এর মানে হল,এই জগতে সৃষ্টি’র প্রকৃতি এত সুন্দর যে,যেখানেই যাই,প্রকৃতি দেখে ভুলে থাকি।সাঁইজী আশা জাগায় বা বুঝান যে, যে যেই কাজের ভেতরি থাকি না কেন,তাতে যেন আমার সু-ভাব থাকে।আমার ভেতরে যেন ভক্তি থাকে।
লালনের বাড়ি,ধর্ম নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে যে,তিনি কোন ধর্মে’র অনুসারী ছিলেন,এসব আর কি।লালন অনুসারী’রা বিশ্বাস করে যে,লালন আসলে তার নাম,ধর্ম এসব তিনি নিজেই অজ্ঞাত রেখে গিয়েছেন।তারা আরও বলেন যে, “সাঁইজী তো সব মানুষের কথা বলে গিয়েছেন।উনি যদি উনার নিজের পরিচয় দিতেন,তাহলে সব মানুষের কথা বলা হত না।কেবল একটা গোত্রের কথাই বলা হত।কিন্তু তিনি তো সারা পৃথিবী’র মানুষের কথা বলেছেন।সারা পৃথিবী’মানুষের কথা যাহেতু এসেছে,সেখানে কোন জাতি,গোত্র থাকছে না”।
“ফকিরি গান” কথাটা’র উৎপত্তি মূলত কুষ্টিয়া’য়।বাউল শব্দটা’র বেশি প্রাধান্য দিয়ে গিয়েছেন দুদ্যু সাঁইজী।ইনি ছিলেন লালনের সরাসরি ভক্ত।বাউল,ফকির,দরবেশ এসব মূলত একই জিনিস।পাত্র বিশেষ যে যেখানে যায়,সে সেখানে নিজের পরিচয় ধারণ করে।
এখন আসি,বাউল হতে গেলে কি করতে হয়,সে ব্যপারে।লালন সাঁইজী’র একটা গানে আছে যে-
“দাসের দাস তার দাসের যোগ্য নয়,
কোন ভাগ্যে এলাম এই সাধু-সভায়।
ফকির লালন বলে মোর,
ভক্তিহীন অন্তর,
এবার বুঝি পেলাম কদাচর
আর কি বুঝবে এমন সাধুরও সাধ বাজার,
না জানি কোন সময় কোন দশা ঘটে আমার।”
এই সাধুকূলে আসতে হলে পূর্ব সূত্রতা থাকতে হবে।সাঁইজী’র ভক্ত বলতে যারা গুরু পরম্পরায় চলে আসছে এবং এরা হাতে হাতে যেসব মুরিদ তৈরি করেছে,এদের বুঝায়।মুরিদ হতে হলে ৫টি চাল লাগে।৫টি চাল জমা দিয়ে সাঁইজী’র মুরিদ হতে হয়।যে যেখান থেকেই আসুক,তাকে এই নিয়ম মানতেই হবে।
ব্যপারটা আরও বুঝিয়ে বলছি।প্রাথমিক ভাবে আপনাকে ৫টি চাল দিতে হবে,আর সকাল-সন্ধ্যা গুরু ভক্তি করতে হবে এবং পৃথিবীর সকল প্রানীকে ভালবাসতে হবে।মোট কথা,নিজেকে নম্র হতে হবে (লালনের কোন গানেই কিন্তু উনি নিজেকে উঁচু বা মহৎ দাবী করেন নাই।উনার সকল গানেই নিজেকে নরাধম,পামর,বধির,অবোধ ইত্যাদি বলে উল্লেখ করেছেন)।গুরু যদি মনে করে যে,তাকে খিলকা(খিলকা হল কাফন সদৃশ পোশাক) দিতে হবে,তবে তাকে খিলকা দান করতে হবে।এই খিলকা দেয়ার সময় একটা গান গাইতে হয়-
“জিন্দা দেহে মুর্দার পোশাক,
খিলকা তাজ আর ডোর-কোপিনি॥
কে তোমারে এ বেশ-ভূষণ পরাইল বল শুনি।”
তার চোখ আর হাত বেঁধে সাত পাক ঘুরাতে হয় আর সাত বাড়ি ভিক্ষে করাতে হয়।এর অর্থ হল, সে বড়লোক হোক বা বিশাল কিছুই হোক বা সে যত টাকা কড়ি’র মালিকই হোক,এখন থেকে সে ফকির হয়ে গেল।এটা হচ্ছে ফকির হওয়ার শেষ ধাপ।তার পরের দিন থেকে সেও ২/১ জনকে ফকির বা শিশ্য বানাতে পারবে।মানে হল গুরু তাকে ফকির হওয়ার সার্টিফিকেট দান করল।এই যে ধাপ,এসব কারও কারও ২/১ দিনেও হতে পারে,কারও ১ বছরে,১০ বছরে,২০ বছরে হতে পারে,আবার নাও হতে পারে।
"বারে বার ডাকি তোমায়,
ক্ষম ক্ষম অপরাধ……!
বড় সঙ্কটে পড়িয়া এবার,
ওগো দয়াল বারে বার ডাকি তোমায়,
ক্ষম ক্ষম অপরাধ……!
দাসের পানে একবার চাও হে দয়াময়,
ক্ষম অপরাধ।
তোমারি ক্ষমতায় আমি,
যা ইচ্ছে তাই কর তুমি,
রাখ মার সে নাম নামি।
ওগো দয়াল তোমারি এই জগৎময়
পাপী অধম তরাইতে সাঁই
পতিত পাবন নাম শুনতে পাই
সত্য মিথ্যা জানবো হেথায়,
ওগো দয়াল তরাইতে আজ আমায়
কসুর পেয়ে মার যারে
আবার দয়া হয় গো তারে
লালন বলে এ সংসারে
ওগো দয়াল
আমি কি তোমার কেহই নই।
যাদের কাছ থেকে দু'হাত পেতে সাহায্য নিয়েছি : উইকি,ইস্টিশন ব্লগ,ট্রাভেল শো বাংলার পথে পথে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৪ ভোর ৬:১৯