১
প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেলের বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়া দেখছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ক্যাপ্টেন ড্যারেন স্যামি।বৃষ্টির কারণে ম্যাচ হেরে যাওয়াতে টি২০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হল এবার। মন অসম্ভব খারাপ করে ভাবছিলেন, বৃষ্টি না হলে খেলার ফলাফল অন্য রকমও হতে পারত।খেলার কারণে অনেক দিন হল দেশের বাহিরে আছেন।মন পড়ে আছে সেন্ট লুসিয়া’র ছোট্ট ডুপ্লেক্স দোতলা বাড়িতে ৮ মাস বয়সি মেয়ে “স্কাই” এর কাছে।কতদিন মেয়েকে কোলে নিয়ে বাগানে খেলা করা হয়নি।এবার বাড়ি যাবার সময় হয়েছে।সামনে লম্বা ছুটি,তারপর আবার সেই ব্যস্ত জীবন।
অনেকক্ষণ থেকে মোবাইল ফোন বেজে যাচ্ছে।কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না বলে ফোন ধরছেন না এই ভদ্রলোক।শেষে বাধ্য হয়েই বাড়ান্দা থেকে ঘরে আসলেন।বিছানার উপর মোবাইল পড়ে আছে।হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দেখলেন “১৭ মিসড্ কল”।স্ত্রী ড্যানিয়েল ক্যাথি ফোন করেছিল।স্যামি কল ব্যাক দিলেন।অপর প্রান্তে ক্যাথি’র ভয়ার্ত গলা শোনা গেল,
-হানি,তুমি ঠিক আছো তো?
-হুম। তোমরা ভাল আছো?
-হ্যা।তুমি ফোন ধরছিলে না কেন?আমি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
-জানোই তো,আমরা হেরে গিয়েছি।এবার বিশ্বকাপ’টা নিয়ে স্কাই-এর হাতে দিতে চেয়েছিলাম।হল না...
-ইটস্ ওকে হানি। এবার হয়নি তো কি হয়েছে।পরের বার হবে,তুমি দেখো।
-হয়তো।স্কাই কি করছে?
-ওর দাদি এসেছে।তুমি জানো, স্কাই এখন শুধু হাঁটতেই পারে না,দৌড়াতেও পারে! আজ দৌড়াতে গিয়ে পড়ে হালকা ব্যথা পেয়েছে।
-তুমি আশেপাশে থাকতে পারো না?ব্যথা পায় কিভাবে?
ক্যাথি স্বামী’র মনের অবস্থা টা বুঝতে পারে।স্যামি এমন এক মানুষ,যে কখনও রেগে কথা বলতে পারে না,কিন্তু আজ বলছে।নিশ্চই মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েছে বেচারা।সে আর কথা বাড়ায় না।
-স্যরি হানি।আমি খেয়াল করিনি। তুমি কবে আসছো?
-এইতো কাল দুপুরে রওনা দিব।এখন রাখি,পরশু দেখা হবে।তোমরা ভালো থেকো।
-তুমিও ভালো থেকো।এখন তো ওখানে রাত,তাই না?
-হুম।
-তাহলে রাত জেগো না।ঘুমিয়ে পড়।
-হুম,ঘুমাবো।স্কাই-এর খেয়াল রেখো।
-ঠিক আছে।
-আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি হানি।
-আমরাও তোমাকে খুব ভালোবাসি হানি।বাই...
ফোন রেখে আবার বাড়ান্দায় এসে দাঁড়ালেন স্যামি।এখন আর বৃষ্টি নেই,তবে হালকা ঠান্ডা বাতাস হচ্ছে।এদেশের আবহাওয়া কেমন যেন!এই কাঠ ফাটা রোদ,তো আবার এই ঝুম বৃষ্টি।তবে এখানকার বৃষ্টি’টা অসাধারণ।সাথে নেশা’র মত বাতাস।কখনও জোরে,কখনও আস্তে।সেই সাথে বৃষ্টির পানি যখন শরীরে পড়ে,তখন আপন মনেই গলায় গান চলে আসে।বাংলাদেশের কোন গানের সাথে তিনি পরিচিত নন।তবে খেলা শুরু হওয়ার আগে এদেশের জাতীয় সঙ্গীত শুনেছেন।সেইন্ট লুসিয়া’র পর এত মায়া নিয়ে জাতীয় সঙ্গীত তিনি আর কোথাও শুনেছেন কিনা,মনে করতে পারেন নি।তার মন হঠাৎ করেই ভাল হয়ে গেল।বাড়ান্দায় দাঁড়িয়েই তিনি গুণগুণ করে সেইন্ট লুসিয়া’র জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করলেন,
“Sons and daughters of St. Lucia,
Love the land that gave us birth,
Land of beaches, hills and valleys,
Fairest isle of all the earth.
Wheresover you may roam,
Love, oh love your island home.”
হঠাৎ রাস্তার দিকে তার চোখ আটকে গেল।হলিউডের জম্বি সিনেমা’র জম্বিদের মত করে একটা মানুষ খুবই আস্তে আস্তে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।উনি খুব আগ্রহ নিয়ে সেই মানুষটির হেঁটে যাওয়া দেখলেন।গোল চত্বর পার হয়ে লোকটি কোথায় যেন চলে গেল।স্যামি আবার লোকটিকে দেখার জন্য বাড়ান্দায় অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলেন।পরে ধৈর্য হাড়িয়ে ঘরে চলে গেলেন।
২
সুদীপের মন খুব খারাপ।আজ সকাল থেকে কোন কিছুই ওর মন মত হচ্ছে না।রাত জাগা আবার বেড়েছে।ওর ভাষ্যে, “নিদ্রাদেবী হারামজাদী আবার ছল চাতুরী শুরু করছে রে।” ফজরের আজান শুনে তারপর দু’চোখে রাজ্যের ঘুম নামে।আজ সকাল ৮ টায় খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা ক্লাশ ছিল বলে ও আর ঘুমায় নি।ভেবেছিল ক্লাশ করে এসে তারপর লম্বা একটা ঘুম দিবে।কিন্তু ক্যাম্পাসে গিয়ে শোনে যে,স্যার নাকি আজ আর ক্লাশ নিবেন না। কি আর করা।একবার ভাবল,হলে গিয়ে ঘুমিয়ে নিবে।সেখানে যাওয়ার পর বন্ধুরা তাশ খেলার বায়না তোলে।বিকাল পর্যন্ত হলে থেকে তারপর টিউশনি করতে যায় এলিফ্যান্ট রোডে।সেখানেই পরপর ২টা স্টুডেন্ট পড়ায় ও। ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যেটাই হোক,তার দু’টো স্টুডেন্ট-ই ছাত্রী।বন্ধুরা অনেকেই হিংসা’র দৃষ্টি নিয়ে তাকায় ওর দিকে।সুদীপ নিজেও এটা নিয়ে গর্ব করে ওর সেই বন্ধুদের আরও বেশি করে জ্বালায়।
সুদীপ ভেবেছিল প্রথম ছাত্রী’র বাড়ি গিয়ে ঘন্টা খানেক পড়িয়েই চলে আসবে।তার উপর আজ আবার মাসের বেতন দিবে।কিন্তু হল বিপরীত।সন্ধ্যা’র পর ছাত্রী’র বাসায় গিয়েছে।গিয়ে শোনে ছাত্রী’র বাবা-মা কেউই নাকি আজ বাসায় নেই।ও বসার ঘরে প্রায় আধা ঘন্টা হল বসে আছে,কিন্তু ছাত্রী’র দেখা নাই।কাজের বুয়া একবার চা দিয়ে গিয়েছে।টিভি-তে স্রীলঙ্কা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেমি ফাইনাল খেলা চলছে।ও কিছুক্ষন খেলা দেখে।অনেক পড়ে ছাত্রী এসে বলে যে,তার নাকি আজ আর পড়তে ভাল লাগছে না।আজ নাকি তার “মুড” নাই।সুদীপ উঠে পড়ে।
দ্বিতীয় ছাত্রীর মা আবার খুবই গল্পবাজ মহিলা।দেড় ঘন্টা পড়ানোর পর আরও ১ ঘন্টা বিরস মুখে মহিলার গল্প শুনতে হল।তারা নাকি গুলশানে বাড়ি কিনেছেন। মাসখানেকের মধ্যেই সেখানে চলে যাবেন।সুদীপ গত ৬মাস ধরে মহিলা’র “মাসখানেক” এর অপেক্ষা করছে।
সেখান থেকে বের হওয়ার পড়ে ঘটল আরেক বিপত্তি।বাম পায়ের স্যান্ডেল ছিড়ে গেল হঠাৎ করে।কয়েকদিন থেকেই নতুন একটা স্যান্ডেল কেনার কথা ভাবছিল।আজ আর রেহায় পাওয়া গেল না।ছেঁড়া স্যান্ডেল নিয়ে টেনে টেনে ১০-১২ পা হাঁটতে গিয়েই শুরু হল ঝুম বৃষ্টি।ওর মুখ দিয়ে অস্ফুস্ট স্বরে বের হয়ে এলো, “আহ্...”। গত কয়েকদিন খুব গরম গেল।বৃষ্টি’র খুব প্রয়োজন ছিল।
এক হাতে ছেঁড়া স্যান্ডেল’টা নিয়ে দৌড়ে যাত্রী ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়াল ও।খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে।সাথে শীল পড়ছে।যাত্রী ছাউনির উপর শীলের শব্দ অন্যরকম একটা আবহসঙ্গীত তৈরী করছে।ও এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করে।বৃষ্টির সাথে মন খারাপের একটা সূক্ষ সম্পর্ক আছে বোধয়। বৃষ্টি হলে অকারণে মন খারাপ হয়ে যায়।একটু বেশিই খারাপ হয়।স্মৃতি'র পাতায় হারিয়ে যাওয়া অথবা হারাতে বসা চেনা মুখ গুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে,যাদের সাথে একসময় কথা কাটাকাটি,ভালোবাসা,ওঠা-বসা করা হয়েছে,একই সুরে গান গাওয়া হয়েছে,কথার পিঠে কথা হয়েছে,মান-অভিমানের খেলা হয়েছে, কারণে... অকারণে...
হঠাৎ করেই বৃষ্টি থেমে যায়।সুদীপ আবার হাঁটা শুরু করে।মোবাইলের ঘড়িতে ১০.৪৬ বাজে।এখন রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা।পা টেনে টেনে হাঁটছে বলে নিজেকে জম্বি’র মত মনে হয়।সোনারগাঁ হোটেলের সামনে এসে শ্যামলী যাবার একটা বাস পেয়ে যাওয়ায় লাফ দিয়ে বাসে উঠে পড়ে।
আদাবর-এ অনেকগুলো ৭-৮ তলা বাড়ি আছে।এরই কোন এক বাড়িতে একটা মেয়ে থাকে,যাকে সুদীপ এক সময় খুব ভালবাসত।যদিও সে তার বন্ধুদের হরহামেশাই বলে থাকে,এখন অনুভূতিগুলো অনেকটাই ভোঁতা হয়ে গিয়েছে বলে তার নাকি সেভাবে আর মেয়েটাকে মনে পড়ে না।তবে কিছু কিছু জিনিস অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছে।সেসব অবশ্য তার একান্তই নিজের ব্যপার।এখনও ও দিনের শেষে যখন বাসায় ফেরে,তখন মনের অজান্তেই বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে হাঁটে,এই আশায়,যদি কখনও ভুল করেও একবার দেখা হয়ে যায়।
আজও হাঁটতে হাঁটতে এক বাড়ির ৫ তলা’র বাড়ান্দায় একটা ছায়ার দিকে ওর চোখ পড়ে।ঘরে আলো জ্বলছে বলে ছায়াটা গাড় ভাবে বোঝা যাচ্ছে।বাতাসে ছায়া’র লম্বা চুল উড়ছে।সুদীপ দাঁড়িয়ে যায়।অনেক্ষন তাকিয়ে থাকে সেই ছায়া’র দিকে।নিচের অন্ধকার ভাবটা ততক্ষনে চোখ মানিয়ে নিয়েছে।একটা মেয়ে এক হাতে বাড়ান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।দৃষ্টি সামনের দিকে।সুদীপের হঠাৎ হাসি পেয়ে যায়।শুধু শুধু একটা মেয়ে কে দেখে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।স্যান্ডেল’টা বড় জালাচ্ছে।ও আবার সামনে হাঁটতে শুরু করে...
৩
খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে,এই কথা মা কে বলতেই মা খুব রাগ করেছে তিথি’র উপর।ওর সব বান্ধবী’রা কেউ কেউ ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে “বৃষ্টিতে ভিজছি।ওহ্ গড,সারা বছর বৃষ্টি হয় না ক্যান... ফিলিং ভেরি ভেরি এক্সাইটেড।” আবার কেউ ওকে ফোন করে বলেছে, “দোস্ত বাইরে কেমন বৃষ্টি হইতেছে,দেখছোস্?আমি এখন বৃষ্টিতে ভিজমু।এই বৃষ্টি’র একটা নাম দিছি, ‘পাপ ধোয়া বৃষ্টি’।গোসল করলে পাপ ধুয়ে যাবে,সিউর।তুইও যা।”
তিথি ওর মা কে বলেছিল।ওর মা কোনভাবেই রাজি হলেন না।ও মন খারাপ করে কিছুক্ষন ঘরে বসে কান্নাকাটি করে।বাহিরের শীলা বৃষ্টি’র শব্দে ওর কান্না’র শব্দ আর কেউ শুনতে পারে না।
বৃষ্টি থেমে গেলে ও এসে বাড়ান্দায় দাঁড়ায়।এক পশলা বাতাস এসে ওকে ছুঁয়ে দিয়ে যায়।বিক্ষিপ্ত মনকে একত্র করতে দুরের বাড়িগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও।এই সময়টাকে বড় মায়া লাগে ওর।সব জীবজন্তুরই একটা দিক দিয়ে কি অদ্ভুত মিল!একটা সময়ে সবাইকে ঘরে ফিরতে হয়।মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়।
দুরে একটা বাড়িতে কে যেন এক দৃষ্টিতে কম্পিউটারের আলোয় কি যেন করছে।তিথি’র প্রশ্ন জাগে, “আচ্ছা কি করছে লোকটা?” কোন কাজ করছে? নাকি কিছু পড়ছে?নাকি কোন মুভি দেখছে?সে কি ছেলে নাকি মেয়ে?উৎসুক চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে তিথি...
৪
লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।এখন দয়া করে জানালা দিয়ে তাকান।তিথিকে বলুন যে,আপনি আসলে কি করছেন।বেচারী অনেক্ষন থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে আপনাকে দেখছে...
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ ভোর ৪:৪১