[১]
অনেকক্ষণ থেকেই ফোন বেজে যাচ্ছে।বন্ধু অনিক ফোন করেছে।অনিকের ফোন মানেই “বিশেষ কিছু”। হয় মদের দাওয়াত,নয়তো গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া।আমি ভয়ে ভয়েই ফোন ধরলাম।কারন,সে আবার বন্ধুদেরকে প্রথমেই “হ্যালো” বলতে পারে না।কোন না কোন গালি দিয়েই শুরু করতে হবে।তবে এবার কিছুটা অবাক হতেই হল।
- হ্যালো বন্ধু,কিবরিয়া কি তোরে ফোন দিছিল? ওর সাথে কি কথা হইছে?
- না তো। ক্যান?
- ও একটু আগে আমারে ফোন করছিল।দেখা করতে কয়।
- ক্যান?কিছু হইছে নাকি?
- তা তো কিছু কয় নাই।তবে নুরা পাগলারে নিয়া কিছু একটা হইতে পারে।
- নুরা আবার কি করল?
- আমি কি জানি?তুই কি হলে?
- না। একটু মার্কেটে আসছি।
- তাইলে একটু দরবারে আয়।আমি আশেপাশেই আছি।কেনা কাটা শেষ?
- হ।থাক তুই,আমি আসতেছি।
- ওকে।আছি আমি।
[২]
নূর মুহাম্মদ।আমাদের নূরা পাগলা।অগোছালো,এলোমেলো,আলা-ভোলা।প্রথমবার ওকে দেখে চোখ বন্ধ করে যে কেউই এরকম কোন একটা বিয়োগাত্বক বিশেষণে বিশেষায়িত করে ফেলবে।জীবন সম্পর্কে নুরের মত উদাসীন ছেলে আমি আর একটাও দেখিনি।ওকে এসব বলতে গেলেই ও স্বভাবমত বলত, “ধুর ব্যাটা,দুই দিনের দুনিয়া।একদিন যদি জীবন নিয়েই ভেবে পার করে দেই,বাকি থাকে আর একদিন।বাদ দে না এসব”।অভাব কাকে বলে,সেটা দেখার জন্য সুদান বা অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।আমাদের নূরা কে দেখলেই চলত। ওর অভাব ছিল দেখার মত।সারা বছরই ওর অর্থের অভাব লেগেই থাকবে।বাড়ি থেকে হয়ত টাকা কম দিত,কিংবা ও নিজেই চাইত না।যাও বা দিত,তা মাসের প্রথম দশ দিনেই শেষ।পরের বিশ দিন ওর চলতে হত বন্ধুদের উপর দিয়ে।আমরাও ওকে যতটুকু পারা যায়,যে ভাবেই হোক,কোন এক ব্যবস্থা করে দিতাম।ও অবশ্য প্রতিবারই টাকা নেবার সময় বলত, “দে শেষবারের মত।একদিন দেখিস,তোগোরে টাঙ্কি ভইরা টাকা দিমুনে”।
আমরা যেখানে একটু ভাল ভাবে সবার সামনে নিজেকে উপস্থাপনের জন্য ভালো কাপড় পরতাম,চেহারার জৌলুশ প্রকাশ করার জন্য সাবান ঘষে এটা সেটা মাখতাম,সেখানে নূরের উদাসীনতা ছিল বর্ণনাতীত।ওর সব মিলে দুইটা প্যান্ট।সেগুলোও আবার মধ্যাকর্ষণের সূত্র মেনে খুলে খুলে পড়ত।সারা দিন নূরের প্রধান দুটি কাজের মধ্যে একটি হল সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া,আর খুলে যাওয়া প্যান্টটা টেনে উপরের দিকে তোলা।এই কাজে ওর ছিল সীমাহীন দক্ষতা।একবার ৪দিন অনুপস্থিতির জন্য স্যার ওকে ক্লাশে দাঁরা করিয়ে রেখেছিল,সেবার ক্লাশের সারাটা সময় ও প্যান্ট ঠিক জায়গায় রাখাতেই কাটিয়ে দিয়েছিল।আমরা ওকে সেদিন বলেছিলাম, “ভার্সিটিতে উঠেও এভাবে স্কুলের বাচ্চার মত দাঁড়িয়ে থাকতে লজ্জা লাগেনি তোর?” ও বলেছিল, “নাহ,ভার্সিটিতে উঠেও স্কুলের ফ্লেভার পাওয়া আর কয়জনের ভাগ্যে জোটে?”এবার আমি আর অনিক ঠিক করেছি,আসছে মাসে ওর জন্মদিনে ওকে একটা প্যান্ট আর বেল্ট কিনে দিব।
নূরের চেহারা ছিল একেবারেই বাউন্ডুলে ধরনের।মাথায় যে কয়টি চুল আছে,তারাও আজকাল “যাই যাই” করছে।এসব নিয়ে ওর ভাবনা ছিলনা কখনই।তবে কোন এক হিন্দি ছিনেমাতে নায়ক নাকি মাথার মাঝখানের চুলগুলো উপরের দিকে ঢিপির মত করে রেখেছিল।প্রিয় নায়কের সেই স্টাইল দেখে নূরা পাগলাও ঠিক করে যে,সেও সেরকম স্টাইল করবে।ওর সেই “স্টাইল” দেখে আমাদের হেসে লুটোপুটি খাওয়ার মত অবস্থা।মাথার মাঝখানে চুল না থাকার কারণে ওর সেই ঢিপি নিছক ২০/২৫টা চুলের মিলনমেলা ছাড়া আর কিছুই মনে হত না।আমাদের শত অত্যাচারেও ও অনেকদিন সেই কিম্ভূতকিমাকার “স্টাইল” অব্যহত রেখেছিল।
গার্লফ্রেন্ড তো দুরের কথা,নূরা’র কোন বান্ধবীও ছিল না।থাকবেই বা কেন! কোন মেয়ের সাথে কথা বলার চেয়ে ওর নাকি রাস্তার পাশের চা-এর দোকানে চা-সিগারেট খেতেই ভালোলাগে।ও আসলে মেয়েদের সাথে কি করে কথা বলতে হয়,সেটাই তো জানত না।আমার এক বান্ধবী একবার ক্যাম্পাসে-ফোনে কোথাও আমাকে না পেয়ে সামনে নূরাকে পেয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল।নূরা নাকি ওকে সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছিল, “গোল্ডলীফের দাম কয় টাকা,সেটা জিজ্ঞেস করো,উত্তর দিতে পারব।এর ওর খবর আমি কিভাবে রাখব?” আমরা যখন গোল হয়ে ছেলে মেয়ে আড্ডা দিচ্ছি,নূরা তখন নাদিম এর দোকানে চা খাচ্ছে আর রাস্তায় ছুটে যাওয়া গাড়ি দেখছে।ওর খুব সখ,ও একটা গাড়ি কিনবে।আমাদের নিয়ে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াবে।সেই জন্য ও নীলখেত থেকে একটা ট্যুরিস্ট গাইড আর বিশাল সাইজের বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আনাচে কানাচে রাস্তার একটা ম্যাপ কিনেছে।
ভালো কথা,আমাদের নূরা কিন্তু একটা মেয়েকে ঠিকই পছন্দ করত।ওই পছন্দ পর্যন্তই।সেই প্রথম সেমিস্টারে থাকতেই আমাদের থেকে এক সেমিস্টার উপরে পড়া এক আপুকে ওর কি কারণে যেন খুব ভালো লেগেছেল।সে কি যেনতেন ভালোলাগা?আমাকে একরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলে কি,
- দোস্ত,এই মাইয়ার কি অন্য কোন কাজ নাই?
“কোন মাইয়া?”- আমি ঘুম ঘুম চোখে অবাক হয়ে বলি।
- আরে, জিনিয়া’র কথা বলতেছি।“
- ক্যান?সে আবার কি করছে তোর?
- আর বলিস না।স্বপ্নে আইসা হাত থাইকা বিড়ি টান দিয়া নিয়া কয় যে,”অই ছ্যামড়া,বিড়ি খাস ক্যান এত?”
- তুই কি স্বপ্নেও সিগারেট খাস নাকি!
- ওইখানে কি আর আমার হাত আছে নাকি?যাই হোক, আর খামু না দোস্ত।বাদ দিমু সব। বিশ্বাস কর,মাইয়াডা এমুন ধমক দিছে,একটু হইলেই বিছানাতেই মুইতা দিতাম।
[৩]
এখন বিকেল।আমি,অনিক,কিবরিয়া,নূরা সহ আরও কয়েকজন ট্রাকে করে বেড়াতে যাচ্ছি।বেড়াতেই তো।কতদিন পর এই যান্ত্রিক কোলাহল থেকে একটু দম ফেলবার ফুরসত মিলল।হাইওয়ে ধরে দ্রুত ছুটে চলছে ট্রাক।ফুরফুরে বাতাস।রাস্তার পাশে গাছের ফাঁক দিয়ে হালকা সূর্যের আলো এসে পড়ছে আমাদের গায়ে।আমাদের মধ্যে সবথেকে সুন্দর গান গাইতে পারে নূরা।কিন্তু আজ সে ই সবথেকে চুপ।আমরাও ওকে গান গাওয়ার জন্য বলতে চাচ্ছি না।শালা,সব সময় বেশি ভাব মারে।শুনলাম না আজ তোর গান।তার মধ্যে আজ আবার ওর জন্মদিন।আমি আর অনিক ওর জন্য কেনা উপহার নিয়েই এসেছি।ওটা অনিকের কাছেই আছে।সুযোগ পেলেই ওকে উপহার দিয়ে চমকানোর "মহা পরিকল্পনা" করা আছে।
প্রধান সড়ক ছেড়ে গ্রামের মেঠো পথ ধরে এগুছি আমরা।মাইল খানেক যাওয়ার পর নূরা’র বাড়ি।ওর বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই ওর বৃদ্ধ বাবা এগিয়ে এলেন।তাকে আগেই খবর দেয়া হয়েছিল।আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে খুব যত্ন করে ট্রাক থেকে নূরের খাটিয়া নামালাম।ওর মা বিলাপ করতে করতে ছুটে এল, “আমার বাজান কই রে?আমার সোনা বাজান কি সোন্দর কইরে ঘুমায় রে।আহা রে আমার সোনা বাজানরে।আমারে আর মা কইয়া ডাকবি না বাজান?অ বাজান,ওঠ ওঠ।আইজ তোর বাপে চিকন চাউল আনছে।ভাত খাবি না বাজান? আহারে... কে আমার বাজান রে এই ভাবে মাইরে ফেলছে?অগোরে মনে কি একটুও দয়া মায়া হইল না?তোমরা কেউ আমার বাজানডারে বাঁচাইতে পারলানা?”
কেউ একজন জানতে চাইলেন কি ভাবে এসব হল।কিবরিয়া সংক্ষেপে বলল,রাজনৈতিক দুটি ছাত্রদলের ক্যাম্পাস দখল নিয়ে আজ সকালে হাতাহাতি হয়েছিল।পরে সেটা বিকট আকার ধারণ করে।দুপক্ষের মধ্যে গোলাগুলিও হয়েছিল।নূর গিয়েছিল চা খেতে।সে পড়ে যায় গোলাগুলির মধ্যে।হঠাৎ কোন এক দলের একটা গুলি এসে লাগে ওর বুকের ঠিক ডান পাশে।অনেক্ষন রাস্তায় ওভাবেই পড়েছিল।মারা যাওয়ার আগেও নাকি একটু পানি খেতে চেয়েছিল।কে আর তখন সেই অবস্থার মধ্যে ওকে পানি দিতে যাবে?অবস্থা শান্ত হলে কয়েকজন মিলে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।ডাক্তাররা ওকে মৃত ঘোষণা করে।
আমার সারা পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে। স্তব্ধ হয়ে শুধু শুনে যাচ্ছিলাম। অনিক একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।আমার খুব গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে, “নূর,এখন থেকে তোর সব সিগারেটের টাকা আমি দিব,আমার সব প্যান্ট তুই পড়বি,তোকে আর চুল নিয়ে খ্যাপাবো না,রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে যখন স্বপ্নের কথা বলবি,তখন আর বিরক্ত হব না।কথা দিচ্ছি বন্ধু।এই দ্যাখ,তোর জন্য বেল্ট আনছি,প্যান্ট কিনে আনছি।ওঠ বন্ধু।সব সময়তো মা মা করতিস, একটূ চোখ মেলে দেখ না,তোকে তোর মা’র কাছে নিয়ে আসছি।ওঠ না দোস্ত একবার...”
নূর’রা খুব কম সময়ের জন্য আসে,এক সময় হারিয়েও যায়।এরা হয়ত বাকি সবার মত প্রাত প্রদীপের আলোয় থাকেনা বা থাকতে চায়ওনা। কিন্তু,নিজেদের চারপাশে একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে রাখে।যেই গন্ধের টানেই আমরা বারবার ওদের কাছে যাই,গন্ধের মায়া শেষ হয়ে গেলে আবার তাদের ছেড়ে চলেও যাই।ওরা আমাদের মত সব জায়গাতেই স্বার্থ খোঁজেনা বলেই হয়ত আমরা ওদের সঠিক সময়ে দাম দেই না।যখন হারিয়ে যায়,তখন বুঝি যে,কিছু একটা নাই।
নূর শুয়ে থাকবে অন্ধকার কবরে। রাতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না'র আলোয় ওর কবরের পাশে বসে থাকবে একজন প্রৌড়া রমনী,দশ মাস গর্ভ ধারনের দাবীতে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদবেন!!!