৮টা বাজতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি। রিকশায় বসেই রাস্তার পাশের টিভি-ফ্রিজের শো-রুমের ঘড়িটা থেকে দেখে নিল আসাদ। দুই সপ্তাহ আগেও সে এমন করে নিজে নিজে সময় দেখতে পারত না। ঘড়িওয়ালা কোন লোককে ‘ভাই টাইম কত?’ জিজ্ঞেস করে তার বিরক্তি ভরা মুখটা দেখতে হতো যেন সে ভিখিরি, ভিক্ষা চাইছে!
আসাদের ঘড়ি দেখতে শেখা তার নতুন বিয়ে করা বউ জরির রাত্রীকালীন শিক্ষাদান কর্মসূচীর প্রথম ধাপের সফলতা। আসাদ নিজে পড়াশোনা না জানলেও তার বউ ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে। রাত নয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত সে বউয়ের কড়া শাসনে পড়াশোনা শিখে। দুই মাসের মাথায় সে অক্ষর চেনা শিখেছে, নিজের নাম লেখা শিখেছে আর ঘড়ি দেখা শিখেছে।
এমনি দিন সে আটটার দিকেই বাড়ি ফেরে। গ্যারেজে রিকশা রেখে বউকে কাচাবাজারে যায়। রাত আর সকালের বাজার করে ফেলে দু’জনে। তারপর বাড়ি এসে গোসল সেরে তরকারি কুটতে থাকা বউয়ের পাশে বসে গল্প করে। একঘন্টা জরি তাকে পড়ায়। সেও খুব মজা নিয়ে পড়ে।
পড়াশোনা তার ছোটকাল থেকেই ভাললাগেনি। তবে জরি মেয়েটার মাঝে কি যেন একটা যাদু আছে। জরি যা বলে আসাদ না করে পারে না, বরং হাসতে হাসতেই করে। তার কপালে এমন বউ জুটবে একথা সে ভাবেনি কখনও।
জরিকে অবশ্য আসাদ আগে থেকেই চিনত। সে গ্যারেজে থেকে কাজ করত সেই এলাকার করিম চাচার বাসায় কাজ করত জরি। করিম চাচা নিজের মেয়ের সাথে জরিকেও স্কুলে দিয়েছিলেন। স্কুল যাওয়ার সময়ই জরিকে দেখত আসাদ। তিনবছর গ্যারেজে কাজ করার পর রিকশা নিয়ে রোজগার করতে নামে। বছর দু’য়েক রিকশা চালানোর পর বেশ কিছু টাকা জমে যায় হাতে। যদিও সে নিয়মিত গাজার আসরে বসত কিন্তু জুয়া-মদের অভ্যাস না থাকায় বেশি টাকা হাত থেকে খসে যায় নি। অবশ্য তার সোনার টুকরা বউয়ের নজরদারিতে গাজার নেশাটাও সে ভুলতে বসেছে।
তখনই করিম চাচা তার গ্যারেজের মালিকের কাছে জরির সাথে আসাদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। নিজের বাবা-মার কথা আসাদের মনে নাই। টোকাইয়ের মতই ঘুরতে ঘুরতে গ্যারেজে এসে ঠাই পেয়েছে। জরিরও বোধহয় অভিভাবক কেউ ছিল না করিম চাচা ছাড়া। পরে অবশ্য বিয়ের দিন জরির বাবাকে দেখেছে আসাদ। তবে নিজে থেকে বাবা-মা নিয়ে কথা তোলে না সে। নিজেরও না, জরিরও না।
আজ জরিকে নিয়ে তার নাইট শো দেখতে যাওয়ার কথা আছে। জরি আসাদকে ঘড়ি দেখতে শিখিয়েছে এজন্য আসাদের পক্ষ থেকে এটা জরির জন্য গিফট। বিয়ের মাসখানেকের মধ্যে হলে রিকশা নিয়ে এতক্ষণ বাইরে থাকত না আসাদ। কিন্তু গ্যারেজের পাশে নতুন একটা ঘর তুলেছে সে নতুন বউ নিয়ে থাকার জন্য। একটা খাট কিনেছে, একটা আলমারি বানিয়েছে। সর্বশেষ মাসখানেক হলো বউয়ের জন্য একটা চৌদ্দ ইঞ্চি কালার টিভি কিনেছে সেকেন্ড হ্যান্ড। এসব খরচের জন্য হাতে আর টাকা নেই আসাদের।
দুইটা ফার্স্ট ক্লাস নাইট শো’র টিকেট অবশ্য একটু আগেই কিনে ফেলেছে আসাদ। কিন্তু আজ তার বউকে নিয়ে হোটেলে কাচ্চি খাওয়ার শখ হয়েছে। জরিকে অবশ্য বলেনি সে কথা। টিকেট কিনে পকেটে দেড়শ টাকার মত আছে। আর পঞ্চাশ-ষাট টাকা ভাড়া খাটতে পারলেই সোজা বাড়ি ফিরবে আসাদ। নয়তো দেরি হয়ে যাবে। এদিকে বউকে বিয়ের শাড়িটা পড়ে সাড়ে আটটার দিকে তৈরী থাকতে বলে এসেছে বিকেলে বের হওয়ার সময়।
টিকেট দু’টো বুক পকেট থেকে বের করে দেখতে যাবে এমন সময় ডাক পড়ল ওর। পাঞ্জাবি পড়া একটা ছেলে ডেকেছে। ছেলেটার হাত ধরে হলুদ শাড়ি পড়া একটা মেয়ে। দেখে মনে হচ্ছে আজ ওদের বিশেষ কোন দিন ছিল।
-এই মামা যাবা?
-কই যাবেন?
-ঘুরব।এক ঘন্টা কত নিবা?
-না, মামা। এক ঘন্টা পারব না। দেরি হয়ে যাবে। আধঘন্টার মধ্যে বাড়ি যাওয়া লাগবে।
আসাদের অবশ্য ইচ্ছে হচ্ছিল ছেলে-মেয়ে দুইটাকে রিকশায় তুলতে। এরকম জুটির সাথে সে ভাড়া নিয়ে কোন কথা বলে না। যা দেয় তাই নেয়। স্কুলের বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও তাই। এগুলো জরি তাকে বলে দিয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে সে জরির কোন কথাই ফেলতে পারে না।
-আচ্ছা, মামা। চলো আধাঘন্টা তোমার রিকশায় ঘুরি তারপর অন্য রিকশা নিব। কত নিবা?
মেয়েটা বলে উঠল। তার মনে হয় হাটতে আর ভাল লাগছে না।
-যা দিবেন তাই। ভাড়া ঠিক করা লাগবে না।
আসাদ ইদানিং প্রেমের জুটিদের এমন উত্তরই দেয়।
ছেলেটা আগে উঠে মেয়েটাকে হাত ধরে ওঠালো রিকশায়। আসাদ প্যাডেল ঘুরানো শুরু করল। কি যেন কারণে মেয়েটা খুব খিলখিল করে হাসছে।
ওরা রিকশার হুড ওঠায়নি। আসাদ জিজ্ঞেস করেছিল হুড তুলবে কিনা? মেয়েটা বলল, থাক মামা। বাতাস খাই। আজকে অনেক বাতাস।
পেছন থেকে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল,
মামা, নাম কি তোমার?
-আসাদ
বাসা যাওয়ার জন্য এত তাড়া যে?
-বউরে নিয়ে নাইট শো দেখতে যাব।
সত্যি কথাটা না বলে থাকতে পারল না আসাদ। অবশ্য এমন জুটি দেখেই বলেছে সে। অন্য কেউ হলে বলত না। এরা প্রেম করে এরা প্রেমের মর্যাদা বোঝে।
‘ওয়াও! কি দারুণ!’ মেয়েটা হাততালিই দিয়ে ফেলল প্রায়।
আসাদের খুব পছন্দ হলো ছেলে-মেয়ে দুইটাকে। এরা শুধু নিজের ভালবাসা না, অন্য সবার ভালবাসাকেই শ্রদ্ধা করে।
দশমিনিট চালানোর পর ভিড় কাটাতে একটা নিরিবিলি রাস্তায় ঢুকে পড়ল সে। এমন জুটি নিরিবিলি আর অন্ধকার রাস্তা পছন্দ করে সে এটা জানে।
কিছুদূর ভেতরে ঢুকতেই সে বুঝল ভুল করে ফেলেছে। রাস্তাটা বেশ ভাঙ্গা আর পানি জমে আছে। আচমকা প্রায় একশ হাত সামনে তিনটা ছায়া দেখতে পেল সে। একজনের হাতে রডজাতীয় কিছু আছে সেটা এতদূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে। ছেলেমেয়ে দুটাও মনে হয় দেখেছে।
মেয়েটা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, মামা যাইও না। ঘুরায় নাও।
কিন্তু ছেলেটা বলল, রিক্সা পিছনে নিয়ে লাভ নাই। তুমি এগোও। তবে থামিওনা। প্যাডেল জোরে ঘোরাতে থাকো।
আসাদ চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করল। ছেলেটাকে রিকশার হুড উঠিয়ে দিতে বলল সে। রিকশায় এত গতি সে কখনও তোলেনি আগে।
ওরা তিনজন না, চারজন আছে। একজন বসে ছিল। দুইজন বাদিকে আর দুইজন ডানদিকে এসে দাড়াল। আসাদ বুঝতে পারছে না কি হবে। চারজন মিলে একটা রিকশা আটকে ফেলা কঠিন কিছু না। আল্লাহকে ডাকা শুরু করল আসাদ। যে কোন ভাবে হোক ছেলেমেয়ে দুইটাকে ভালভাবে নামিয়ে দিয়ে জরিকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতে হবে তাকে।
ছিনতাইকারীরা হাত উচিয়ে রিকশা থামাতে বলল। আসাদ আরও গতি তুলল। রিকশার ডানদিকে ছেলেটি বসে ছিল। ডানদিকের দুইজনের মাঝে একজনকে সে বুক বরাবর লাথি মেরে ফেলে দিল।এটা দেখে আরেকজন তেমন সাহস পেল না এগোনোর।
বামদিকের একজনের হাতে ছিল রডটা। ওদের একজন টেনে ধরতে চেষ্টা করল পেছন থেকে। গতি একটু কমলেও আসাদ তবু থামল না।
হঠাৎ পিঠে একটা রডের বারি খেল সে। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠল সে। ছেলেটা লাথি মারার চেষ্টা করছে ডানদিক থেকে বামদিকের রডওয়ালাকে। আর মেয়েটা হুড টেনে ধরা লোকটার হাতে খোঁচা মারছে সেফটিপিন দিয়ে।
পরক্ষণেই আরেকটা বারি এসে পড়ল আসাদের কোমড় বরাবর। আর থাকতে পারল না সে। রিকশা থেকে কুকিয়ে পড়ে গেল।
-শুয়োরের বাচ্চা থামতে কইছি না!
একজন টলতে টলতে পায়ে লাথি মারতে থাকল ওর।
চারজনই নেশা করা। বুঝতে বাকি রইল না আসাদের। একজন তো আগেই ছেলেটার একটা লাথি খেয়ে পড়ে গেছে। এখন তিনজন আছে। এদের জায়গামত দু’একটা মারলেই পড়ে যাবে। সমস্যা হলো একজনের হাতে রড তো আছেই, আরেকজন একটা ক্ষুর বের করেছে।
ছেলেটাকে ইশারা দিয়ে হাটুগেরে বসে রডওয়ালা ছিনতাইকারীকে পাশের ড্রেনে ধাক্কা দিতে যাবে ঠিক এইসময় যার হাতে ক্ষুর ছিল সে দেখে ফেলল ওপাশ থেকে। রিকশাটা পেরিয়ে এসে আসাদের বুক বরাবর ক্ষুর দিয়ে একটা টান দিল সে। আরেকটা টান দিল ডান কনুইয়ের উপর। শেষ মারটা খেল রডের। একেবারে ঘাড়ের উপর।
আর উঠতে পারল না আসাদ। সেকেন্ডেই শার্ট ভিজে গেল রক্তে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ওর। পকেটে হাত দিয়ে টিকেট দু’টো বের করে আনলো। ক্ষুরের টানে টিকেট দু’টোও ছিঁড়ে গেছে। নাইট শো’র সাদা টিকেট দুটো লাল হয়ে আছে এখন।
আসাদের আর আজ জরিকে নিয়ে নাইট শো দেখতে যাওয়া হলো না। বাসমতি হোটেলে কাচ্চি খাওয়াও হলো না। জরির জন্য খুব খারাপ লাগছে আসাদের। মেয়েটা একা একা সেজেগুজে বসে আছে।
৪/৬/১৩