-দেখেন ভাই, শেষ দাম ঐ পঞ্চাশই। এর বেশি চাইলে অন্য কোথাও দেখতে পারেন।
-আর পাঁচটা হাজার বাড়ানো যায় না, ভাই?
-তুমি মিয়া বেশি কথা কও। এমনেই চোরাই মাল। সিস্টেম কইরা তোমার থাইকা এমনেই মালটা নিতে পারতাম। তোমারে ভদ্রলোক মনে হইতাছে তাই করলাম না। যদিও ভদ্রলোক চুরি করে না।
মাহিন বুঝলো এর চেয়ে বেশি পাওয়া সম্ভব না। এমনিতেই লোকটা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। আরো তর্ক করলে সব ভেস্তে যেতে পারে। কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে গেল সে। ঝকঝকে মোটরসাইকেলটার রুপার চেইনের চাবির রিংটা লোকটার হাতে দিয়ে দিল।
-আচ্ছা, টাকাটা কিন্তু এক্ষুণি দরকার। নির্দ্বিধায় বলে ফেলল মাহিন।
-এখনই হবে। আমি ঝক্কি-নক্কির কাজ করি না। সোফায় বসুন, চা খান। ততক্ষণে টাকা ম্যানেজ করে ফেলছি।
সদ্য কেনা চাবির রিংটা আঙ্গুলের ডগায় ঘোরাতে ঘোরাতে মাহিনকে কথাগুলো বলে লোকটা বেরিয়ে গেল।
দুইহাত দূরের মখমলের কভার লাগানো মোটা গদিতে একরকম গা ছেড়ে পড়েই গেল মাহিন। শার্টের আস্তিন দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বুকের দুইটা বোতাম খুলে দিল সে। মোটরসাইকেলটা মাহিনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু সজীবের। বিকেলের দিকে সজীবের কাছ থেকে নিয়েছিল সিমিকে নিয়ে একটু ঘুরতে যাব-এই বলে। সজীবের বাবার অনেক টাকা, এর চেয়েও দামি তিনটা বাইক আছে ওর। সবসময় চাওয়া মাত্রই বাইকের চাবি মাহিনের হাতে তুলে দিত সজীব। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
তবে শুধু এইকারণে নয়, মাহিন আর সজীব –দুইজন জানের দোস্ত সেই ক্লাস থ্রি থেকে। সেই সজীবের মোটরসাইকেলটা মিথ্যা বলে চুরি করে দিতে হচ্ছে মাহিনকে। কিছুক্ষণ আগেই সে সজ়ীবকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে কিছু ছিনতাইকারী ওর মোটরসাইকেলটা ছিনতাই করেছে। সজীব অবশ্য দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করেনি মোটরসাইকেল নিয়ে। শুধু জিজ্ঞাসা করেছে মাহিন আর সিমি ঠিক আছে কি না! মাহিন অবশ্য অবাক হয়নি। সে জানে সজীব তাকে কতটুকু বিশ্বাস করে। নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হলেও চোখের সামনে মাহিন মিথ্যা বলে মোটরসাইকেলটা চুরি করে বিক্রি করা ছাড়া আর কোন পথ খুজে পায়নি।
-চা নেন।
একটা টোকাই মত ছেলে এসে মাহিনকে চা দিতে এসেছে। শুধু চা, কাপের মুখে আর পিরিচে কালো পিপড়া হেটে বেড়াচ্ছে। চা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিল সে।যতটা ভেবেছিল অতটা খারাপ হয়নি চা। তবে এই পরিস্থিতির সাথে ওর হাতে চায়ের কাপ এটা যেন ও নিজেও মানতে পারছে না। কাপটা রেখে দিল পিরিচের উপর।
সিমির কথা মনে পড়ছে খুব। সিমির সাথে ওর সম্পর্ক আর সাত বছর। এই মূহুর্তে সিমির কি অবস্থা এটা ভেবে আবারও ঘামতে থাকল মাহিন। নিজের উপর আবারো রাগ হতে থাকল মাহিনের। সাত বছর ধরে সে সিমির হাত ধরা আর চুমু খাওয়া ছাড়া আর কোনভাবেই এগোয়নি। সম্পর্কের উপর আস্থা আর নিজেদের সততার ব্যাপারে কোন ছাড় দেয়নি দু’জনই। এই সাত বছরে মাহিন সিমির মনের সাত স্তর গভীরে ছুয়ে এসেছে। কিন্তু শরীরের ব্যাপারে কেউই অতি লোভ দেখায়নি কোনদিন। অন্তত বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক কখনই না এটা দু’জনই কঠোরভাবে মানত।
কিন্তু কে জানত দু’জন একই দিনে একই সময়ে দূর্বল হয়ে পড়বে। গত শনিবারের দিনটার কথা ভাবছে মাহিন।
-এই মাহিন, আমাকে তুমি শুধু মনেই চিনবে? শরীরে চিনবে না?
এই চরম অসহায়বস্থায়ও সিমির চোখের কামনার সেই দৃষ্টি মাহিনের চোখে ভাসছে।
-চিনতে তো চাই সুন্দরী। কিন্তু কি করব, পণ করেছি। বিয়ের আগে শরীর নয়।
-দু’জনের পণ দু’জন ভাঙ্গলে কার কি আসে যায়! হুম? ,সিমি আবারও টিপ্পনি কাটল
মাহিনের লোভে পেল। বিয়ে তো ওরা করবেই। আগে আর পরে- নিজেকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে রাজি করালো সে। সিমিও কেন যেন জোর করেই হোটেলটায় যেতে চাইল, মাহিনও না করল না। কফিশপ থেকে সোজা নোংরা আবাসিক হোটেলটায় যেতে রিকসা ভাড়া করল। বন্ধুদের কাছে জায়গাটার ব্যাপারে যতদূর শুনেছে ওটাই নাকি শহরের সবচেয়ে নিরাপদ। সেটাই কাল হল।
নিজের মুখে নিজেই থু থু দিতে ইচ্ছা করছে মাহিনের। সিমিরও দোষ ছিল, কিন্তু ও না চাইলেই সিমি অফ যেত।
সর্বনাশটা সে বুঝতে পারল পরদিন সকালে তার কাছে আসা একটা ফোন কলে।
-হ্যালো, মাহিন সাহেব বলছেন?
-জ্বি, বলছি। কে বলছেন?
-আমার পরিচয় জানার দরকার নেই। গতকাল আপনার আর আপনার বান্ধবীর কুকর্মের একটা ভিডিও আমার কাছে আছে। কি যেন নাম আপনার বান্ধবীর?
-মানে?
বিছানা থেকে এক লাফে উঠে বসল মাহিন। তার মানে রুমটাতে ক্যামেরা সেট করা ছিল? একবার ভাবল হোটেলের মালিককে ধরবে যেয়ে। একবার ভাবল পুলিশে বলবে। সবই বোকামি ছাড়া কিছু হবে না কারণ ওরা নিজেরাই অবৈধভাবে ছিল হোটেল রুমটায়, তৎক্ষণাৎ ভাবল মাহিন। লোকটা ব্ল্যাকমেইল করতেই মাহিনকে ফোন দিয়েছে, বুঝতে বাকি রইল না ওর।
-কি চান বলুন?
-ষাট দিলেই চলবে। ডিস্কটা তখন আপনার হয়ে যাবে।
ওপাশ থেকে হাসিজড়ানো কন্ঠে ভেসে আসল।
-এত টাকা কই পাব! আর কাজটা আপনি ঠিক করছেন না। এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
-ভুল ঠিক বুঝিনা। কাল সন্ধ্যার মধ্যে টাকাটা দিবেন, ডিস্কটা নিবেন। নইলে আপনি আর আপনার বান্ধবী ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াইয়েন।
বলেই ফোনটা খট করে রেখে দিল ওপাশের লোকটা। সিমির হলের সামনে ওকে বলার পর মেয়েটা চোখের পানি আটকাতে না পেরে দৌড়ে পালিয়েছে মাহিনের সামন থেকে।
চারপাশে কোন উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সজীবের মোটরসাইকেলটাই চুরি করতে হলো তাকে। সিমিকে যতদূর ও চেনে ইন্টারনেটে ভিডিওটা গেলে সুইসাইডের এক মিনিটও দেরি করবে না সে। এই জিনিসটা নিয়েই ভেতরে ভেতরে কাপছে মাহিন। ডিস্ক ফেরত পেলেও ওটা নেটে ছড়াবে এ ব্যাপারে ও ভয় করছে খুব। ভয়টা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য না। ভয়টা সিমির জন্য। মেয়েটা নির্ঘাত আত্মহত্যা করবে। আহ্, আর কিছু ভাবতে পারছে না মাহিন।
-এই নিন আপনার টাকা।গুণে নিন, টাকা গুণে নেয়া সুন্নত।
লোকটা বাদামী রংযের একটা প্যাকেট মাহিনের হাতে দিল। গুণে দেখল, একশটা পাচশ টাকার নোটই আছে। ওর পকেটে বারো হাজার আছে, এর ওর কাছ থেকে ধার করেছে। মোট ষাট হাজার প্যাকেটটায় পুরে উঠতে যাবে তখনই ওর ভয়টা সত্যি হয়ে গেল!
সজীব ফোন করেছে।
-দোস্ত, কে জানি তোর আর সিমির একটা স্ক্যান্ডাল নেটে আপ করছে। সিমির অবস্থা সিরিয়াস।
মাহিন বুঝতে পারল ওরা ডিরেক্টলি খবরটা দিতে চাইছে না। তবুও মাহিন বুঝতে চাইল না, ছোটবাচ্চার মত আকুতি করতে থাকল ফোনে।
-সিমি বেচে আছে তো, না? তাইলে ঠিক হয়ে যাবে। তাই না?
-দোস্ত, তুই তাড়াতাড়ি আয়।
হাত থেকে ষাট হাজার টাকার প্যাকেটটা পড়ে গেল মাহিনের। অবশ্য এসব নিয়ে আর কোন অনুভূতি নেই ওর। এই মূহুর্তে একটা কথাই ভাবছে মাহিন ওর বেচে থাকার উৎস হারিয়ে গেছে।
চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে মাহিনের। মাহিন চাইছে এটাই ওর শেষ চোখ বোজা হোক। খুব মরে যাওয়া দরকার মাহিনের, খুব।