১
-সুস্মিতা, মনে কর, তোমার খুব খিদে পেয়েছে কিন্তু খাওয়ার মত পকেটে কোন টাকা নেই, হাত দিয়ে দেখলা যে মাত্র ২ টাকা আছে। কি করবা বলত?
-আমার ভালো লাগছে না পিনাক, প্লিজ বাদ দাও।
-আহা, এমন করছ কেন? শুনই না। তুমি কি করবা জানো, ২ টাকা দিয়ে বাদাম কিনবা। তারপর কিছু লবণ নিবা। বিট লবণ না কিন্তু, ঐ যে লবনের সাথে লাল মরিচের গুঁড়া মেশানো থাকে ওইগুলো। তারপর একটা একটা করে বাদাম খাবা আর একচিমটি লবণ। সবার শেষে একগ্লাস পানি। আহ, শান্তি। দেখবা পেট ভরে গেছে।
-পিনাক, এরকম করে হয় না। তুমি অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখ। জাবেদ,মিতু বা শাকিল, মৌ বা আরও যারা আছে। ওরা কত সুন্দর সুন্দর জায়গায় প্রেম করতে যায়, সপ্তাহে একদিন ভালো কোন হোটেলে খেতে যায়। একে অন্যকে কত সুন্দর সুন্দর গিফট কিনে দেয়। আর তুমি আমাকে সবসময় একই জায়গায় নিয়ে এস, তারপর খা খা রোদের মাঝে কতক্ষণ বসিয়ে রাখ। আমার আর ভাল্লাগে না। আমারও তো ইচ্ছে করে ওদের মত করে একটু ঘুরতে, ভালো ভালো জায়গায় যেতে, তোমার কাছ থেকে সুন্দর সুন্দর গিফট পেতে।
-দেখ, সুস্মিতা আমি হয়ত তোমাকে ওদের মত করে সুখী করতে পারিনি কিন্তু ভালবেসেছি নিজের মত করে। ওদের ভালবাসায় হয়ত অর্থের ঝনঝনানি আছে কিন্তু আমার ভালবাসার মত সমৃদ্ধি নেই। ভালোবাসা তো টাকা পয়সা দিয়ে লাভ করা যায় না তাই না। এই যে তুমি রেগে গেলে নাকে বিন্দু বিন্দু মুক্তোর মত ঘাম জমে, তোমার হাতের একটু স্পর্শ বা তোমার আমার একসাথে কাটিয়ে দেয়া অনেকগুলো সুখের মুহূর্ত এগুলো তুমি টাকার অঙ্কে কিভাবে পরিমাপ করবা।
-ফিলোসফি দিয়ে জীবন চলে না পিনাক। আমি গেলাম।
-এত তাড়াতাড়ি? এই তো মাত্র এলে।
-ভাল্লাগছে না, তুমি থাকো।
অনেক চেষ্টা করার পরেও সুস্মিতাকে আটকে রাখতে পারল না। তবে পিনাক জানে ওর এই রাগ সাময়িক। কালই এসে হাতটা ধরে কান্না কান্না কণ্ঠে আজকের জন্যে ক্ষমা চাইবে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে ধূয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাবল, ‘না জীবনটা খারাপ না’।
২
আজ সুস্মিতার জন্মদিন।
রাত ১২:০১ এ পিনাক কল দিয়ে উইশ করল।
-থ্যাঙ্ক ইউ, জানু
-ওয়েলকাম
-কিন্তু এত লেট করলা কেন?
-কই লেট করলাম, ঠিক ১২:০১ ই তো কল দিলাম
-আচ্ছা, ঠিক আছে। শুনো কাল আমি আমার চার পাঁচটা ফ্রেন্ডকে আমার জন্মদিন উপলক্ষ্যে কে এফ সি তে খাওয়াবো। খাওয়ার টাকা আমি দিব কিন্তু তোমাকেও একটু কষ্ট করতে হবে জানু। তুমি বড় একটা কেক এর অর্ডার দিবা মি: বেকার থেকে।
-ওকে, কিন্তু কত লাগতে পারে?
-২৫০০-৩০০০ এর মধ্যে হয়ে যাবে আশা করি। দেখ, কাল কিন্তু কোন ধানাই পানাই করবা না। ওরা কিন্তু অনেক বড়লোক পোলাপাইন। আমার মান সম্মানের ব্যাপার এর সাথে জড়িত।
-সবই ঠিক আছে কিন্তু আমি মনে হয় পারব না। মাসের শেষ, হাতে একদম টাকা নাই। আমি স্যরি।
-কি? তুমি পারবা না?
-আমি তোমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিতে পারি কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমি আসলেই পারব না। কারো কাছে চাইতেও পারব না। কারণ এরমধ্যেই অনেকের কাছেই টাকা নেয়া হয়ে গেছে। আমি সত্যিই দুঃখিত।
-তুমি......... তুমি.........এই তুমি ফোন রাখ
-কেন?
-রাখ বলছি।
টুট টুট আওয়াজে কল কেটে গেল। তারপর একরাশ নিরবতা। পিনাকের অনেক খারাপ লাগছে কিন্তু ওর সত্যিই কিছু করার নেই।
পরিবারের বড় ছেলে ও। বাবা নেই। মা, ছোট দুইটা বোন নিয়ে ওর সংসার। দুইটা টিউশনি করে যা টাকা পায় বাড়িতে পাঠিয়ে আর নিজের টুকটাক খরচ শেষে কিছুই থাকে না বলতে গেলে। সুস্মিতা সবই জানে, সব কিছু মেনে নিয়েই ওরা প্রায় তিন বছর ধরে প্রেম করে আসছে।
এত দিন সব ঠিকই ছিল। ও আর সুস্মিতা মিলে অঞ্জন দত্ত আর বেলা বোসের মত নীল দেয়ালের ছোট্ট একটা ঘরের স্বপ্ন দেখত, পরস্পরের হাতে হাত ধরে কল্পনার রঙ ছড়িয়ে দিত।
কিন্তু, ইদানিং সুস্মিতা কেমন জানি করছে।
যাইহোক প্রতিবারের মত পিনাক সব কিছু সময়ের হাতে ছেড়ে দিল। সময়ই সব কিছু ঠিক করে দিবে।
৩
২১ টা গোলাপ নিয়ে পিনাক ওদের মেডিক্যাল কলেজের চত্বরে বসে আছে। বেশ অনেকগুলো টাকা চলে গেছে। তারপরও এগুলো দেখে সুস্মিতা যে পরিমাণ খুশি হবে তার কাছে ঐ টাকা কোন ব্যাপার না। আশা করি সুস্মিতা ওর প্রিয় ফুলগুলো পেয়ে কেকের দুঃখ ভুলে যাবে। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল সুস্মিতা আসছে না। অনেকক্ষণ ধরে মোবাইলেও ট্রাই করছে কিন্তু কেউ কল ধরছে না। কোন সমস্যা হল নাকি? এসব ভাবতে ভাবতে আবার কল দিল। এবার কল ধরল
-হ্যা,বল
-কি হল তুমি আজ কলেজে আসবা না?
-না
-আজব, আজ না তোমার জন্মদিন। প্রতিবারের মত আজকেও আমরা সারাদিন ঘুরব। আর তোমার জন্যে একটা স্পেশাল জিনিস আছে।
-কি? তুমি কেকের ব্যবস্থা করতে পেরেছ?
-আরে না, তার চেয়েও বড় কিছু
এবার সুস্মিতার গলায় উচ্ছ্বাস ফিরে এল
-কি বল?
-তোমার প্রিয় গোলাপ। ২১ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে ২১ টা গোলাপ। তুমি চিন্তা করতে পারো?
সুস্মিতার কন্ঠ কেমন জানি মিইয়ে গেল
-ও
-ও মানে? তুমি খুশি হও নি?
চিৎকার করে সুস্মিতা বলল
-খুশি হব মানে? শুনো পিনাক, জীবন এত সহজ নয়। জীবন অনেক বড় একটা ব্যপার। এখানে মানুষের কিছু চাওয়া থাকে, কিছু ইচ্ছে থাকে, কিছু স্বপ্ন থাকে। শুধু কথা পিঠে সুন্দর সুন্দর কথা বলে সেই ইচ্ছে বা স্বপ্নগুলোকে পাওয়া যায় না।
-ও, তার মানে তোমার কাছে জীবনের অর্থ এখন পাল্টে গেছে কিন্তু একসময় তো আমরা অন্যভাবে চিন্তা করতাম
-ভুল করতাম। দেখ, পিনাক, আমি তোমার অবস্থা ভালো করে জানি। এও জানি তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাসো। আর এই সবকিছুতে যে তোমার কোন দোষ নেই তাও জানি। কিন্তু এভাবে আর কত দিন। আমরা এখন ফিফথ ইয়ারে পড়ি। এখনি আমার বাসায় বিয়ের আলাপ আসা শুরু হয়েছে। মেয়েদের জীবনটা ছেলেদের থেকে একটু বেশিই কঠিন। আর তুমি ওইদিন বললে না যে, খিদে লাগলে দুই টাকা দিয়ে বাদাম কিনে খেতে বাস্তবতা কি জানো, দুই টাকার বাদামই এখন কিনতে পাওয়া যায় না। এমনি কি রাস্তার একটা ভিক্ষুককে দুই টাকা দিলে তোমার দিকে কেমন করে তাকাবে।
এমন করে হয়না পিনাক। আর কত বল। অনেকতো হল। আমি ক্লান্ত।
-সবই বুঝলাম। কিন্তু আমার কি মনে হয় জানো, জীবনে টাকা পয়সা হয়ত অনেক দরকারি কিন্তু সেটা বিশ্বাস বা ভালবাসার থেকে কোনভাবেই বেশি নয়। আমার উপর বিশ্বাস রাখ, কথা দিচ্ছি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
-না ঠিক হবে না। তোমার অপরাধটা কি জানো তুমি গরীব কিন্তু তোমার অবস্থা পরিবর্তনের কোন চেষ্টা নেই। আমি বললাম, দেখ, তুমি সারাজীবন এরকম হতদরিদ্রই থাকবা। তুমি দয়া করে আমার সাথে আর যোগাযোগ কর না। ভালো থেক।
কল কেটে গেল।।
মুহূর্তের আকস্মিকতায় পিনাক কেমন জানি হতবাক হয়ে গেল। তারপরও ও চিন্তা করে হয়ত পুরা ব্যপারটা একটা ফান ছিল। হয়ত সুস্মিতা ওর সাথে মজা করছে। একটু পরই হয়ত ও এসে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না কান্না কণ্ঠে বলবে ‘আমি স্যরি গো, আমি আসলে রাগ করে কথাগুলা বলেছিলাম।‘
পিনাক অপেক্ষা করে কিন্তু কিছু অপেক্ষা কেন জানি কখনই শেষ হয় না।
৪
১৮ বছর পর
পিনাক। আজ সময়ের প্রয়োজনে বাংলাদেশের তিন জন অন্যতম নিউরো সার্জনের একজন। দেশের সেরা প্রাইভেট হাসপাতালে ডাক্তারি করে।
এই দিনটাতে পিনাক সাধারনত হাসপাতালে যায় না। কিন্তু আজ সকাল থেকে বারবার কল আসছে হসপিটাল থেকে খুব জরুরী একটা অপারেশন করার জন্যে। বাধ্য হয়েই তাই যেতে হচ্ছে।
ও টি ড্রেস, মাস্ক, ক্যাপ পড়ে ও টি রুমে ঢুকবে এমন সময় একজন মহিলা হন্তদন্ত হয়ে ওর দিকে ছুটে এল।
-ডাক্তার সাহেব, যে করেই হোক আমার স্বামীকে বাঁচান, যত টাকা লাগে আমি দিব আপনি জাস্ট ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।
পিনাক অবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখ, সেই ঠোঠ, সেই নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। কিন্তু আগের সেই স্নিগ্ধতা আর নেই।
চোখের নিছে কালি জমে আছে, অনেকটা বেঢপভাবে ফুলেও আছে। হয়তো অনেকক্ষণ ধরে কাদছিল।
-জীবনে টাকা পয়সা হয়ত অনেক দরকারি কিন্তু সেটা বিশ্বাস বা ভালবাসার থেকে কোনভাবেই বেশি নয়। আমার উপর বিশ্বাস রাখুন, কথা দিচ্ছি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
পিনাক ও টি রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আর সুস্মিতা কিছুটা অবাক হয়ে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে।
দীর্ঘ ৫ ঘণ্টার অপারেশনের পর পিনাক ও টি রুম থেকে বের হয়ে এল। সে কথা দিয়েছিল সব কিছু ঠিক করে দেয়ার সে তার কথা রেখেছে। ওর ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে সুস্মিতাকে বলে ‘দেখ, আমি আমার প্রতিটা কথা রেখেছি। যে আমি তোমাকে জন্মদিনের একটা কেক কিনে দিতে না পারার জন্যে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে সেই আমি এখন তোমার প্রতিটা জন্মদিনে মি: বেকারের সবকটা কেক কিনে তোমার জন্যে অপেক্ষা করি। কই তুমি তো আস না। আজ আমার সব আছে, শুধু তুমিই নেই’
কিন্তু ও তা করে না। সব কিছু জুনিয়র ডাক্তারকে বুঝিয়ে দিয়ে দ্রুত বের হয়ে যায়। আজ ওর অনেক কাজ।
৫
সেই পুরনো পার্কের, সেই পুরনো জায়গাটাতে পিনাক বসে আছে। তার সামনে ৩৯ টা পিচ্ছি ছেলেমেয়ে। প্রত্যেকের সামনে একটা করে কেক। উপরে লেখা ‘শুভ জন্মদিন সুস্মিতা’
-স্যার, কেক কাটবেন না?
-না
-কেন?
-যার জন্মদিন সেই তো এখনো আসেনি।
-কখন আসবে?
-জানি না তো, হয়তো আসবেনা।
পিচ্ছিটা এবার হি হি করে হেসে বলল
-কি যে কন না স্যার, তাইলে অপেক্ষা করতাছেন কেন?
পিনাক মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-জানি না রে, হয়তো এই অপেক্ষার নামই ভালোবাসা অথবা হয়ত কিছুই না। তবু মানুষ অপেক্ষা করে, করতে ভালবাসে।
তোরা কেক কাট, আমি আসছি।
(চীনের এক হতভাগ্য মানুষ ওয়াং। প্রেমিকা তার কাছে আবদার করেছিল সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখানোর জন্যে। কিন্তু তার সেই সাধ্য ছিল না। এর জন্যে প্রেমিকা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল ‘তুমি এরকম সারাজীবন হতদরিদ্রই থাকবে।’ সাত বছর পর । কয়েকদিন আগে ট্রান্সফরমার সিরিজের চতুর্থ সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। সেই ওয়াং বেইজিং শহরের সব কয়টা সিনেমা হলের টিকিট কিনে প্রেমিকার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আর মনে মনে বলছেন ‘তোমার ধারনা ভুল ছিল, প্রিয়তমা’। তিনি জানেন এই অপেক্ষার কোন অর্থ নেই। তবুও তিনি অপেক্ষা করেন। কিছু মানুষ তার ভালবাসার মানুষের জন্যে সবসময়ই অপেক্ষা করে। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস এই ওয়াং কে উদ্দ্যেশ্য করে।)