১
আমার চার পাশে অসংখ্য জিনিসপত্র। তবে নেয়ার মত দুইটা ল্যাপটপ, ৩ টা মোবাইল আর একটা নোট থ্রি। কিন্তু এত কিছু নেয়া যাবে না।
হুমম, অনেক চিন্তা করে দেখলাম নোটটা নিব আর একটা মোবাইল। এক্সপেরিয়া জেড মোবাইলটা আসলেই সুন্দর। কিছুক্ষন পর এটা আমার হয়ে যাবে ভাবতেই জানি কেমন লাগছে।
সুযোগটা আসলে হঠাৎ করেই এসে গেল। আমি বাথরুমে গেছি গোসল করতে, হঠাৎ খেয়াল করলাম ট্যাপের সাথে কি জানি পেঁচিয়ে আছে। হাতে নিয়ে দেখি চাবির রিং। আমার চিনতে একটুও কষ্ট হল না। এটা পাশের রুমের অন্তুর চাবি। আনমনেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
এরপর………সঠিক সময়ের জন্যে অপেক্ষা।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্যে অন্তুদের রুমে গেলাম।
সবুজ (অন্তুর রুমমেট) হেসে জিজ্ঞেস করল
-কি রে পিনাক, কি অবস্থা?
-এই তো রে, তোর কি অবস্থা?
-ভাল।
এরপর টুকটাক কিছু কথা বার্তা হল। একসময় অন্তু পাশের বেড থেকে কথা বলে উঠল
-কি রে পিনাক, পরশুদিন তো পরীক্ষা, সব নিশ্চয়ই পড়া শেষ
-আরে না, কিছুই পড়ি নাই রে দোস্ত।
-শালা আঁতেল তুমি পড় নাই না? সব শেষ করে এখন আমাদের রুমে এসে গল্প করছিস। তোর রুমমেটদের কি অবস্থা? ওদেরও কি সব শেষ নাকি?
শালা তোরা সবগুলা আঁতেল। এত পড়িস কেমনে রে দোস্ত?
আমি কি আর বলব। হাসলাম।
আমার আসলেই পড়তে ভাল লাগে, আর ভাল লাগে মানুষের জিনিসপত্র চুরি করতে। সত্যিকার অর্থে আমি নিজেই জানি না কেন যে আমি চুরি করি, মাঝে মাঝে মনটা কেমন জানি অস্থির লাগে, কেমন জানি হাফিয়ে উঠি, মনে হয় মনে হয় খুব সাহসী, অ্যাডভেঞ্চারাস কিছু করি। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত নাচন অনুভব করি। তখনই আমি চুরি করার সিদ্ধান্ত নেই। সবসময় অবশ্য পারি না, তবে মাঝে মাঝেই সুযোগ চলে আসে। কখনো কখনো অবশ্য কোন প্ল্যান ছাড়াই চুরি করি। হয়ত কোথাও বেড়াতে গেছি, সামনে ভাল কোন জিনিস দেখলাম চট করে পকেটে ঢুকিয়ে দেই। কিন্তু কেন যে এমন করি জানি না। মাঝে মাঝে খুব কান্না পায়।
তবে ব্যাপার সেটা না। এখন আমি একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত। অন্তু তার চাবির ব্যাপারে কিছু বলছে না কেন? নাকি আমি চিনতে ভুল করলাম? এটা অন্য কারো?
ঠিক তখনই কাকতালীয়ভাবে অন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করল
-দোস্ত, আমার চাবিটা দেখছিস নাকি?
-আমি কিভাবে দেখব? আমি কি তোর রুমে থাকি নাকি?
–আরে তা না, আসলে দুপুর থেকে চাবিটা পাচ্ছি না,
-রুমে ভাল করে খুজছিস?
-হ্যাঁ, বাথরুমেও খুজলাম। আমি তো প্রায়ই বাথরুমে ফেলে আসি। পেলাম না। একটু লেট করে গেছিলাম অবশ্য। চিন্তায় পড়ে গেলাম রে
-হুম, সাবধানে থাকিস, চারিদিকে যেভাবে চুরি হচ্ছে
-হুম
তারপর কিছুটা রিস্ক নিয়েই নিজের উপর থেকে সন্দেহ উঠানোর জন্যে বললাম, দোস্ত, পারলে নতুন একটা তালা কিনে নে যদিও জানি ব্যাটা কিনবে না, বাপের এত টাকা কিন্তু ব্যাটা অনেক কিপটা।
-কিনব, আগে আরেকটু ভাল করে খুঁজে দেখি।
-হুম, দেখ ভাল করে খুঁজে দেখ।
এরপর আমি খুশি মনে বের হয়ে এলাম। যাক ভুল হয়নি, এবার শুধু সুযোগের অপেক্ষা।
এরপর বিকেল গেল, রাত গেল, এরপর দিন সকাল গেল, দুপুরে আমি মন ভাল করা খবরটা পেলাম। ওরা দুই রুমমেট মিলে বাইরে খেতে যাবে। যা ব্যাটারা তোরা পেট পুজো করে আয়, আমি আমার মন পুজো করি।
২
হাবিবুর রহমান হলের, ১২৫ নাম্বার রুম। সন্ধ্যে ৭ টার মত বাজে। চারটে টিউব লাইট প্রানপন অন্ধকার তাড়ানোর চেষ্টা করছে।
আমার খুব পিপাসা পেয়েছে, এক গ্লাস পানি খেতে পারলে ভাল লাগত। একটু পর পর হেচকি তুলে শরীরও পানির অভাব জানান দিচ্ছে।
আমি মোটামোটি রুমের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে ১১ টা ছেলে। এদের বেশির ভাগই আমার ক্লাসমেট, তবে জুনিয়রও আছে।
এখানে সবাই জড়ো হওয়ার কারণ হল আমার বিচার হবে, চুরির বিচার। ব্যপারটা আমাকে খুব একটা ভাবাচ্ছে না। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করছি মানুষ কত হিংস্র হতে পারে। আশিক, যে ছেলেটাকে আমি খুব শান্ত শিষ্ট ছেলে হিসেবে জানতাম, যে ক্যান্টিনে বসে সিগারেট খাওয়ার আগেও তিন বার চিন্তা করে সময়ের প্রয়োজনে কত সহজেই না পশুর মত আচরন করে। আমাকে প্রথম থাপ্পড়টা ওই মারল। ওর হাত যে এতো শক্ত ভাবতেই পারিনি।
তনুজ নামের জুনিয়রটা যে কিনা একটু আগে লাথি মারতে উদ্যত হয়েছিল, খুব বেশি না ৩-৪ দিন আগে আমি ক্যান্টিনে বসে আছি, আমাকে এসে বলল, দাদা সকালে নাস্তা করিনি, কিছু খাওয়ান না। আমি পাশে বসিয়ে ওকে খাওয়ালাম। ওর চোখে আমি যে ঘৃনা দেখতে পারছি সত্যি বলছি নিজেকে খুব ক্ষুদ্র কীট-পতঙ্গ মনে হচ্ছে।
মানুষের চোখ খুব অদ্ভুত একটা জিনিস। মানুষের আবেগ তা ভালোবাসা হোক বা ঘৃনা সম্ভবত চোখেই আগে প্রকাশ পায়।
আমি আমার রুমমেট এবং রিডিং পার্টনার শাহিন এর দিকে তাকিয়ে আছি। ও আমার গায়ে হাত তুলেনি। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি
কি রাগ, লজ্জা ওর মধ্যে লুকিয়ে আছে।
আদর , মায়া, মমতা কত সহজেই না ঘৃনায় পরিণত হয়ে যায়।
এখন বিরতি চলছে। খুব সম্ভবত চিল্লাচিল্লি করে ও মারতে মারতে ওরা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। একটু পর আবার শুরু হবে। এই ফাঁকে বলি আমি কিভাবে ধরা পড়লাম।
খুব সম্ভবত, ওরা বুঝে ফেলেছিল আমার চুরির অভ্যাসটা। আসলে আমি বাথরুমে অন্তুর চাবিটা পেয়েছিলাম তা ছিল প্ল্যান করা। এরপর যা হবার তাই হল, আমি বোকার মত ধরা খেলাম।
আবার শুরুটা করল তানজিম, এও আমার ক্লাসমেট। ও আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করছে, কেন আমি চুরি করি? কেন?
আমি কি বলব? সত্যি বলছি আমি নিজেও জানিনা কেন চুরি করি। এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তাই নিশ্চুপ থাকলাম। ও বারবার জিজ্ঞেস করছে, আমি চুপ করে আছি।
খুব সম্ভবত বার বার প্রশ্ন করেও আমার নির্লিপ্ততা দেখে ও রেগে গেল। ঠাস করে আমার বা গালে থাপ্পড় মারল। আমি রীতিমত ছিটকে মাটিতে পরে গেলাম। ও আমাকে টেনে তুলল। আবার আমাকে চড় মারার জন্যে উদ্যত হল। আমি চোখ বন্ধ করে আছি।
আরে থাম তোরা (রবিনের গলা)
কি করছিস, হাজার হোক ও তো আমাদের ক্লাসমেট। হয়ত একটা ভুল করে ফেলেছে, তাই বলে এভাবে অপমান করবি? অপমান করছিস করছিস আবার মারছিসও। কি রে তোরা কি পশু হয়ে গেছিস নাকি?
তানজিম বলল, হ্যাঁ তাই হয়ে গেছি, তুই জানিস ও আমার কি ক্ষতি করেছে? গত মাসে আমার ২০ হাজার টাকা চুরি করেছে, বাসায় বলেছি বাবা বিশ্বাস করেনি। চিন্তা কর আমি কত কষ্ট করে কাটিয়েছি। তারপর তনুজ নতুন ল্যাপটপ কিনেছে ওটা চুরি করেছে, আলমের মোবাইল চুরি করেছে, এমনকি লিটনের হাত ঘড়িটা পর্যন্ত মেরে দিয়েছে। চিন্তা কর ও কত নিচে নেমেছে। আরও কত জনের কত কিছু চুরি করেছে। তারপরও বলছিস ওকে মারব না, জামাই আদর করব? তুই কি বুঝবি? তোর তো কিছু চুরি যায়নি
-দোস্ত, আমারও অনেক কিছু চুরি গেছে। সবই বুঝলাম, কিন্তু হাজার হোক ও তো আমাদের ব্যাচমেট। এরকম করে মারাতো উচিৎ হচ্ছে না। ব্যাপারটা
অন্যভাবে হ্যান্ডেল করা যেত
-তাই তো করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু হারামজাদা কোন কথাই বলে না, চুপ
করে থাকে, তাই রাগ উঠে গেছিল।
-আচ্ছা, ঠিক আছে দাঁড়া আমি দেখছি।
এরপর রবিন আমার সাথে কথা বলতে শুরু করল। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘পিনাক, বলত তুই কেন চুরি করিস? আমার জানা মতে তোরা গরিব না, তুই ছেলে হিসেবেও ভাল। কিন্তু এমন করিস কেন? আমাকে বল, খুলে বল। তোর কি কোন সমস্যা চলছে? আমাদের বললেই পারতি, আমরা সাহায্য করতাম’
‘রবিন, আমি নিজেই জানি না রে কেন আমি চুরি করি, সত্যি বলছি। আমি
জানি এটা খারাপ কাজ। কিন্তু কেন জানি, নিজেকে সংবরণ করতে পারি না। অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়না। আর আমি তো তনুজের ল্যাপটপ নেই নি এমন কি তানজিমের টাকাও না। সত্যি বলছি’
তানজিম চিৎকার করে উঠল, ‘ওই চুপ, রবিন দেখছিস, শালা কি বলে, ও নাকি জানেনা, আমি আগেই বলছিলাম। ওকে এভাবে বললে কাজ হবে না, ওর আসল ট্রিটমেন্ট হচ্ছে মাইর, দেখ, আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
‘আরে তুই থাম। দেখ, যাই হোক ও হয়ত ভুল করে ফেলছে কিন্তু আমাদের ভুল করলে তো চলবে না। চিন্তা করে দেখ ব্যাপারটা যদি বাইরে জানাজানি হয় আমাদের ব্যাচের মান সম্মান বলে কিছু থাকবে? সবাই বলবে যে এই ব্যাচের একটা ছেলে চোর। আর তোরা কি শুরু করছিস এই সব জুনিয়র টুনিয়র নিয়ে এসে’
‘তা অবশ্য তুই ঠিক বলছিস। আচ্ছা কি করা যায় বলত’
‘ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দে, আমি দেখছি। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব।’
‘এরপর যদি ও চুরি করে এর দায়-দায়িত্ব কে নিবে, তুই?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিব, এতো পাগল হচ্ছিস কেন? বললাম তো আমি বুঝিয়ে বলব ওরে’
‘ওকে, যা, তুই এই হারামজাদা রে নিয়া যা’
৩
রবিন। আমার ক্যাডেট লাইফের ফ্রেন্ড। ও আমার অনেক ভাল বন্ধু, কিন্তু এতোটা, আমি কখনো বুঝতেই পারিনি। আমি অদ্ভুত কৃতজ্ঞতায় ওর হাত চেপে ধরলাম। ও আমাকে হলের ছাদে নিয়ে গেল।
-পিনাক, দোস্ত, আমাকে বলত, তোর আসলেই কি সমস্যা?
-দোস্ত, আমি জানি না, আমি কেন এমন করি, সত্যি জানি না
-হুম, তুই আসলেই ইচ্ছে করে চুরি করিস না?
-না
-আচ্ছা, ঠিক আছে, কাল তোকে আমি এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবো।
-কেন?
-এমনি, যাবি তো?
আমি বুঝতে পারলাম ও কি বুঝাতে চাচ্ছে। আমি একটা মানসিক রোগী, এটা চিন্তা করতেই কষ্ট হচ্ছে। আমার আসলে কিছু করার নেই ওর কথায় রাজি না হওয়া ছাড়া।
-হ্যাঁ যাবো। কিন্তু, তোকে আমার আরেকটা উপকার করতে হবে
-কি, বল?
-আমার এই ব্যাপারটা যেন কেউ জানতে না পারে, এমনকি রুমিও(আমার গার্লফ্রেন্ড) না, দোস্ত, আমি তাহলে মুখ দেখাতে পারব না রে, এমনকি আমার রিলেশনটাও টিকবে না
-আরে এ নিয়ে তুই চিন্তা করিস না।
তারপর কিছুক্ষন নিরবতা। একসময় আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম
-আচ্ছা দোস্ত, তুই আমার জন্যে এতো কিছু করলি কেন?
ও আমাকে একটা গল্প শুনালো
-পিনাক তোর মনে আছে, আমরা তখন জাস্ট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছি, কারো সাথে খুব বেশি চেনাজানা নেই। মা বাবাকে ছাড়া প্রথম বার বাইরে এসেছি। অদ্ভুত এক একাকীত্বে মন খারাপ হয়ে থাকত। এরকম এক সময়ে এক বড় ভাইয়ের রুমে আমার ডাক পড়ল। আমার অপরাধ আমি বড় ভাইয়ের কাপড় ঠিক মত ধুয়ে দিতে পারিনি, কিভাবে পারব বলত, এর আগেতো কখনো কাপড় ধুইনি। এর কারণে তার নাকি ড্রিল টিচারের কাছে অনেক মার খেতে হয়েছে। ওই ঝাল সে আমার উপর ঝাড়তে লাগল। সেই কি মার, মেরেই যাচ্ছে, মেরেই যাচ্ছে। কেউ এগিয়ে আসছে না। এমন সময় তুই কই থেকে এলি, এসেই ভাইয়ের পা ধরে ‘ওকে ছেড়ে দেন, ওকে ছেড়ে দেন’ বলে কাঁদতে লাগলি। তুই আমার এমনই বন্ধু, এই তুই আজ বিপদে পড়েছিস, আমি কিভাবে চুপ করে থাকি বল
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।
৪
ডাঃ আব্দুল বাতেনের চেম্বারটা বেশ বড়। আমার বেশ পছন্দ হল। নরমালি ডাক্তারদের চেম্বারে যেরকম ভিড় থাকে এখানে এমন না।
অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। একসময় ডাক পড়ল।
ডাক্তার সাহেব বেশ তরুণ, আমি একটু বয়স্ক কাউকে আশা করেছিলাম।
-তা কেমন আছেন, মিঃ......
-পিনাক
-হ্যাঁ, মিঃ পিনাক
-ভাল
-হা হা হা, ভাল হলে কি আর মানুষ ডাক্তারের কাছে আসে?
আসলেই তো, নিজের বোকামিতে নিজেই হাসলাম
-কফি খাবেন?
-না
-আরে খান, যত পারেন আপনার টাকা উসুল করে নেন, হা হা হা
না, ডাক্তারকে ভালোই মনে হচ্ছে।
-বলেন তো আপনার কি সমস্যা। তার আগে বলেন, আপনার কি কোন তাড়া আছে?
-না তো
-গুড, আমারও নেই। ভালোই হল, আপনার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করা যাবে। আপনি ধীরে সুস্থে বলেন।
আমি আমার সব কথা খুলে বললাম, সব শুনে উনি বললেন
-আপনাকে প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই আমার কছে আসার জন্যে, নরমালি এরকম সমস্যা নিয়ে কেউ আসে না, কিছুটা লজ্জা কিছুটা ভয়ের কারণে। আপনি যে সমস্যায় ভুগছেন তার নাম ‘ক্ল্যাপ্টোম্যানিয়া’।
-এর প্রগনোসিস কেমন?
-খুবই ভাল, জানেন আমাদের সমাজের প্রতি হাজারে ৬ জন এতে আক্রান্ত। আপনি আমাকে সহযোগিতা করবেন, আমিও আপনাকে করব, আসা করি খুব দ্রুতই আমরা ফল পাব, আচ্ছা আপনি তো মনে হয় স্টুডেন্ট?
-হ্যাঁ
-কোথায় আছেন?
-রাজশাহী ইউনিভার্সিটি
-গুড, সব চেয়ে ভাল হয় আপনি যদি কয়েকদিনের জন্যে ছুটিতে চলে যান।
বাসা তো রাজশাহী শহরেই নাকি?
-হ্যাঁ
-ভেরি গুড। আপনি মাঝে মাঝে আমার সাথে এসে দেখা করে যাবেন, আমি কিছু মেডিসিন দিব, নিয়ম করে খাবেন, আর কোন সমস্যা হলেই আমাকে জানাবেন, ঠিক আছে?
-হ্যাঁ
আমি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে এলাম। হুম, আসলেই কয়েকদিনের জন্যে ভার্সিটি না যাওয়াই ভাল। রবিনের সাথেও এই ব্যাপারে কথা বললাম, রবিনও তাই বলল।
৫
আজ পাঁচ মাস পর ভার্সিটি এলাম। গত কয়েকটা মাস নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি, অবশেষে বাবা মায়ের ভালোবাসা, ডাঃ আব্দুল বাতেনের সহযোগিতা আর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় নিজেকে শুধরাতে সক্ষম হয়েছি।
আজ নিজেকে অনেক নির্ভার, অনেক মুক্ত মনে হচ্ছে।
আমি রবিনের খোঁজ করতে লাগলাম, এই মানুষটার কাছেও আমি অনেক কৃতজ্ঞ।
রবিনকে খুঁজে পেলাম না। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম সবাই আমার দিকে কেমন অদ্ভুত চোখে থাকাচ্ছে, তাদের দৃষ্টিতে কেমন এক অবজ্ঞা, কেমন এক রাগ মিশে আছে। এমনকি আমার ক্লাসমেটরাও আমার সাথে ঠিক মত কথা বলছে না।
আমি হলে ফিরে গেলাম। ক্যান্টিনে রবিনের সাথে দেখা।
-কি রে কি অবস্থা?
-ভাল, তুই?
-তুই তো অনেক পাল্টে গেছিস রে
-হ্যাঁ, দোস্ত, আমি ভাল হয়ে গেছি।
ও আমাকে ওর রুমে নিয়ে গেল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম
-রুমি কেমন আছে রে?
-ভাল
-ওর নাম্বার কি বন্ধ নাকি? আমি অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না, এমনকি ফেবুতেও ওকে পেলাম না
-হ্যাঁ, ও নাম্বার চেঞ্জ করেছে।
-কেন?
-জানি না। বাদ দে, তোর কি অবস্থা বল
-এই তো, দোস্ত, একটা ব্যাপার বুঝলাম না ভার্সিটিতে গেলাম, সবাই কেমন জানি করছে, অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে, এমনকি আমাদের পোলাপাইনও ঠিক মত কথা বলছেনা, কেন রে?
উত্তরে ও যা বলল তাতে আমি প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম
-দোস্ত, তোর ব্যাপারটা সবাই জেনে গেছে
আমি প্রায় কান্না কান্না গলায় বললাম
-কেন? আমি না তোদের কে অনুরোধ করেছিলাম কাউকে না বলতে
-দোস্ত, তোর কি মনে হয় আমি কাউকে বলব? খুব সম্ভবত জুনিয়র কেউ অথবা তানজিমরা কেউ বলে দিয়েছে।
আমার মনটাই ভেঙ্গে গেল। এতো কষ্ট, পরিশ্রম সব কি তাহলে বৃথা গেল? মনে করেছিলাম আবার নতুন করে সব শুরু করব কিন্তু মনে হচ্ছে তা আর হল না। এজন্যেই রুমি আমার সাথে কোন যোগাযোগ করেনি। রুমির সাথে আমার এতো দিনের পরিচয়, এতো ভালোবাসা, এতো প্রতিশ্রুতি, এতো স্বপ্ন কোথায় গেল সব, সবই কি মিথ্যা ছিল, এতো ঠুনকো ছিল। ছিল হয়ত, তা না হলে এতো সহজে কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারে না। হতাশা আমাকে পুরোপুরি গ্রাস করল।
আমার এহেন অবস্থা দেখে রবিন আমার কাঁধে হাত রাখল, ‘দোস্ত, বাদ দে, যা হবার তা তো হয়েই গেছে, আবার নতুন করে শুরু কর, আমি তোর পাশে আছি, দরকার হলে আমি আবার সবাইকে বোঝাবো, সব ঠিক হয়ে যাবে, তুই ভেঙ্গে পড়িস না, প্লিজ’
হ্যাঁ, আমাকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে, কে বলেছে আমার কেউ নেই, আমার বাবা মা আছে, রবিনের মত একটা ভাল বন্ধু আছে, আর কি চাই। আমি নতুন উদ্যমে আবার ঝাপিয়ে পড়লাম।
৬
সব কিছু বেশ ভালোই চলছিল। সব কিছু আবার ঠিক হয়ে আসছিল, সবাই আমাকে সহজভাবে নিতেও শুরু করেছিল। কিন্তু এক দিনের এক ঘটনা আমার জীবনে আবার অশনি সংকেত হয়ে এল। প্রীতম, আমাদেরি এক ব্যাচমেট ওর ৫০০০ টাকা চুরি হয়ে গেল, কেউ খুব বেশি কিছু বলল না, কিন্তু আমার দিকে সেই আগের মত চাইতে শুরু করল, তারপর আবার আরেকজনের মোবাইল চুরি হয়ে গেল, আরেকজনের আইপ্যাডটা পাওয়া গেল না, কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি এসবের কিন্তু কিছুই জানতাম না।
একদিন, আবার আমাকে নিয়ে বিচার বসল। এবার হল সুপারকেও জানানো হল।
আমি যতই বলি আমি কিছুই জানি না, আমি ভালো হয়ে গেছি কেউ মানতে রাজি হয় না। সবার একই কথা আমি যখন ছিলাম না তখন তো চুরি হয়নি, আমি আসার পর শুরু হয়েছে, তাহলে অবশ্যই আমি এর সাথে জড়িত।
এতদিন রবিন আমার সাথে ছিল, আজ রবিনও কিছু বলল না। কিভাবেই বা বলবে, কতই আমাকে সাপোর্ট দিবে।
আমার বাবা মাকে জানানো হল। এবং বলতে গেলে গলাধাক্কা দিয়ে আমাকে হল থেকে বের করে দেয়া হল।
৭
আমি ভার্সিটি আসা ছেড়ে দিলাম। মোটামোটি বন্ধী জীবন যাপন করতে লাগলাম। বাবা, মা, আমাকে বুঝালেন। ডাঃ বাতেনের কাছে গেলাম কিছুতেই আর কাজ হল না। এতো অপমান, এতো লজ্জা আমার সহ্য হল না। প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে কুড়েকুড়ে খেতে লাগল। আমি চূড়ান্ত মাত্রায় হতাশ হয়ে গেলাম।
একসময় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমি আত্মহত্যা করব। কিন্তু, ব্যাপারটা এতো সহজ ছিল না। আত্মহত্যা করতেও সাহস লাগে, আমার তা নেই, তাই তা আর আলোর মুখ দেখল না।
এরপর কোন এক দুপুরে বাবা আর আমি খেতে বসেছি। এমন সময় হঠাৎ করে মা এসে বাবাকে বললেন
‘শুনছ, আমার ব্যাগে যে ২০০০ টাকা ছিল, তা না পাচ্ছি না’
সাথে সাথে বাবা আমার দিকে একবার তাকালেন, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের সময়ের জন্যে। আমি জানি এটা ছিল সম্পূর্ণই আনইন্টেনশনালি কিন্তু লজ্জায়, অপমানে আমার ভিতরটা পুড়ে যেতে লাগল।
ঐদিন রাতে আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমি আত্মহত্যা করব, করতেই হবে।
৮
তারপর কয়েকটা দিন গেল কিভাবে আত্মহত্যা করব এই চিন্তা করতে করতে। আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় শান্তি পাই নি অন্তত মৃত্যু টা শান্তিময় হোক। অনেক ভেবে দেখলাম ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে শান্তিময় মৃত্যু।
দিনের চেয়ে আমার রাত ভাল লাগে। আবার রাতের কালো আকাশ থেকে দিনের নীল আকাশই আমার বেশি পছন্দ। তাই কোন এক শান্ত, স্নিগ্ধ, ঘুমঘুম দুপুরে হাতে তুলে নিলাম অনেকগুলা বেনজোডায়াজেপিন এবং বারবিচুরেট।
মানব জীবন বড়ই অদ্ভুত। বেঁচে থাকতে দু হাত ভরে কষ্ট দেয় কিন্তু ছেড়ে যাওয়ার সময় কত অদ্ভুত মমতায় আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। আহা! এমন সাধের মানব জীবন আর কি হবে!!
খুব ঘুম আসছে, খুব।
ঘুম, ঘুম,ঘুম।
৯
‘তনুজ, চেয়ারটা দে তো’
‘জ্বি, ভাই, নেন’
রবিনের মনটা আজ খুব ভাল। আজ সব ঝামেলা শেষ হয়েছে। ও এতোটা আশা করেনি, আহ, শান্তি।
‘কি রে, তনুজ, শুভর ল্যাপটপটা বিক্রি করে কত পেলি?’
‘ভাই, ২৬ হাজার’
‘ফাজলামি করিস, আমি নিজে ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলেছি, বলেছে ৩০ দিয়েছে’
‘হে হে ভাই মজা করলাম, নেন টাকা’
‘ফাজিল, আমাকে দেখে কি মনে হয় ঘাস খেয়ে বড় হয়েছি?’
‘কি রে, তাঞ্জিম ঝিম মেরে গেলি যে, আলমের টাকা টা কই?’
‘দোস্ত, পিনাকের জন্যে খারাপ লাগছে, ছেলেটা মারাই গেল? কেমন জানি অপরাধবোধ হচ্ছে’
‘আরে রাখ তোর অপরাধবোধ, আমরা কি ওকে মারছি নাকি?’
‘আচ্ছা, দোস্ত, বল তো তোর ওর উপর এতো রাগ কেন? তুই ই তো বলছিলি, ও তোকে একবার মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল’
‘হ্যাঁ, তা করেছিল, কিন্তু ও আমার যে পরিমান ক্ষতি করেছিল, তার পরিমান উপকারের থেকে অনেক বেশি’
‘কিভাবে?’
‘ও আর আমি পাশাপাশি বাসায় থাকতাম, ছোটবেলা থেকেই আমরা পরিচিত। ও পড়ালেখায় ছিল অনেক বেশি ভাল, সব কিছু পারত, ক্লাসে ফার্স্ট হত, আমার বাবা মা সব সময় ওর সাথে আমাকে তুলনা করত, আমি পারতাম না, ভাই রে আমি এর জন্যে কত যে মার খাইছি, ও তো দেখতেও অনেক সুন্দর ছিল, আমার বাবা মা আমার থেকে ওকেই বেশি মনে হয় আদর করত, আমার হিংসেয় গা জ্বলে যেত, এমনকি স্কুল কলেজের টিচাররা পর্যন্ত আমাকে ওর সাথে তুলনা করে করে কথা বলত, অপমান করত।
সব কিছু সহ্য করেছি। কিন্তু, ওর প্রতি আমার চূড়ান্ত রাগটা হল ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর।
তোরা তো জানতি রুমির প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল। ওকে আমি আমার ভাললাগা জানানোর পর মাগিটা আমাকে পিনাকের উদাহরণ দেখালো, ওর মত ভালো হতে বলল।
কিন্তু, শালী পরে ঠিকই পিনাকের সাথে প্রেম করল।
পিনাক আমাকে এখানেও টেক্কা দিল। আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। আমি তক্কে তক্কে থাকলাম কিভাবে ওকে শায়েস্তা করা যায়।
সুযোগটা হঠাৎ করেই এসে গেল। ওর টাকা চুরির অভ্যাসটা প্রথমে আমার কাছেই ধরা পড়ে। একদিন ও আমার টাকা নেয়ার সময় আমি দেখে ফেলি। তখনই অপমান করতে পারতাম, কিন্তু আমি আরো বড় কিছুর চিন্তা করলাম। অন্তুর সাথে মিলে প্ল্যান করে ওকে ফাঁদে ফেললাম।
এরপর সবার সামনে অপমান করার সুযোগ পেলাম, কিন্তু আমি আরও বড় কিছু করার প্ল্যান করলাম, তাইতো ও যখন রিহ্যাবিলিটেশনে ছিল সুযোগ মত আমিই সবাইকে জানিয়ে দিলাম, সবার আগে রুমিকে জানিয়ে ছিলাম, সাথে আরও অনেক কিছু যোগ করেও বললাম, যেমন ও নেশা করে, মেয়েদের টিজ করা সহ অনেক কিছু, বলতে পারিস আমার জন্যেই ওদের ব্রেকাপ হয়েছে।
-তুই, তুই বলেছিলি রুমি কে?
-হ্যাঁ,
- এই ল্যাপটপ, মোবাইল এইগুলা নিজে চুরি করে ওর উপর দোষ দিলি
-হ্যাঁ, এতে দুইটা কাজ হল, এক, ওর উপর পোলাপাইনের রাগটাও বাড়ল দুই, কিছু উপরি ইনকামও হল, হা হা
-হা হা, দোস্ত, তুই আসলেই জিনিয়াস।