১)
আমি যখন ব্লাড টেস্টের রিপোর্টটা হাতে পেলাম, মনে হল মুহূর্তের মধ্যেই আমার পৃথিবীটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার মনে হল চারপাশের সব কিছুই যেন ঘুরছে। আমার মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল। আমি দপ করে চেয়ারে বসে পরলাম।
আমার সামনে একজন ডাক্তার বসে আছেন। তিনি আমাকে কিছু একটা বললেন, বোধহয় সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। আরও কি কি জানি বলছেন। আমার কান দিয়ে কিছুই ঢুকছে না।
আমার জীবন শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে, ব্যপারটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না।
এত সাধের মানব জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাবে, আমাকে আমার মা, বাবা, ভাই বোনকে ছেড়ে চলে যেতে হবে।
আমি এখনো মরার জন্যে প্রস্তুত নই। আরও আরও অনেক দিন, অনেকটা বছর এই সুন্দর পৃথিবীর আলো ছায়ার মাঝে হেসে খেলে বেড়াতে চাই।
আমার বোধ শক্তি কেমন জানি লোপ পাচ্ছে। চারিদিক কেমন জানি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আমি কি মারা যাচ্ছি? এত তাড়াতাড়ি?
২)
আমি নিশু। কয়েকদিন আগের কথা। সন্ধ্যা বেলা। গল্পের বই পড়ছিলাম, আর মোবাইলে গান শুনছিলাম। এমন সময় একটা কল এল।
-হ্যলো, কে বলছেন?
-আমি 'রুহুল আমিন ক্লিনিক' থেকে বলছি
-হ্যা, বলুন
-আপনি কি তাসকেরা হক নিশু?
-হ্যা
-আপনি আমাদের এখানে কয়েকদিন আগে এক পেশেন্টকে ব্লাড দিয়ে গিয়েছিলেন
-হ্যা
-আপনি সম্ভবত এইচ আই ভি পজিটিভ, প্লিজ চেক করে দেখবেন।
লাইন কেটে গেল।
আমি ভাবলাম কেউ একজন আমার সাথে মজা করছে। আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ডও হতে পারে। তাই ব্যপারটাকে খুব একটা পাত্তা দিলাম না। কিন্তু মনটা কেমন জানি কুতকুত করতে লাগল। কয়েকদিন বেশ ঝামেলায় কাটল। তারপর সময় করে আজ ব্লাড টেস্ট করালাম।
৩)
আমি অনেক চিন্তা করে পেলাম না কি করে এমন হল। আমি একটা ছেলের সাথে প্রেম করি, কিন্তু ওর সাথে আমার কখনো physical relation হয়নি। তাহলে?
হঠাৎ করে আমার মনে পড়ে গেল, গত বছর আমরা কিছু ফ্রেন্ডরা মিলে বান্দরবান ঘুরতে গিয়েছিলাম । যাওয়ার পথে আমাদের গাড়িটা accident করে। কারো খুব বেশি চোট লাগে না কিন্তু আমার কিভাবে জানি পেটের দিকে মারাত্তকভাবে কেটে যায়। অনেক ব্লিডিং হয়। আমাকে বান্দরবান স্থানীয় এক ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্লিডিং খুব বেশি হওয়ায় রক্ত দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমার রক্তের গ্রুপ AB- হওয়ায় সহজে খুজে পাওয়া যায় না। তখন আমার এক ফ্রেন্ড কোথা থেকে এক লোককে ধরে নিয়ে আসে।
আমি শিওর হয়ে যাই যে, অইখান থেকেই এই মরনঘাতি জীবাণু আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
৪)
আমার জীবনটা নরক হয়ে গেছে। আমার খেতে ভাল লাগে না, ঘুমাতে ভাল লাগে না। কিচ্ছু করতে ভাল লাগে না। আমি আমার বাবা মার চোখের দিকে তাকাতে পারি না, কেন জানি মনে হয় তাকালেই উনারে বুঝে ফেলবে। তখন তো আমাকে আর কেউ সহজভাবে নিবে না, বলা যায় না আমাকে একঘরে করেও ফেলতে পারে। ভার্সিটিতে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছি। আমার সময় কাটে আমার এই ছোট্ট ঘরে কান্নাকাটি করে করে।
ডাক্তার বলেছে আমার CD4+helper T CELL না কি জানি আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে আমার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও একসময় কমে যাবে। একসময় দেখা যাবে সাধারন ইনফেকশনেই আমি মারা যাবো।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার আয়ু আর কতদিন আছে?
ডাক্তার বলল, ঠিক নেই, ৬ মাস হতে পারে, এক বছর হতে পারে আবার ১০ বছরও হতে পারে।
কিন্তু, ডাক্তারের এই কথা আমাকে স্বস্তি দেয় না। কি এক অজানা ভয় আমাকে আমাকে সারাক্ষন আঁকড়ে ধরে। কেন জানি মনে হয় একটু পরই আমি মারা যাবো। মৃত্যু ভয় আমাকে সারাক্ষন গ্রাস করে রেখেছে।
৫)
আমার পৃথিবী আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে। আমি বুঝতে পাড়লাম আমি যদি ১০ বছর বাঁচিও আতঙ্ক, ভয়, অনিশ্চয়তা আমাকে ভাল ভাবে বাঁচতে দিবে না।
আমার আসলে কিচ্ছু করার ছিল না। আমি নিরবে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
একসময় আমার মনে হল আরে আমার কি অপরাধ ছিল, আমাকে কেন এভাবে মারা যেতে হবে? আমি তো অন্যায় কিছু করিনি, তাহলে আমার এই পরিণতি কেন? আমার এই পৃথিবীর উপর, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের উপর রাগ হতে লাগল।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, হ্যা আমি সিদ্ধান্ত প্রতিশোধ নিব। চরম প্রতিশোধ।
৬)
এরপর আমার দিন কাটতে লাগল কিভাবে প্রতিশোধ নেয়া যায় এই ভেবে। আশাব্যঞ্জক কিছু খুজে পাচ্ছিলাম না।
একদিন পত্রিকায় দেখলাম আমেরিকার এক লোক গুলি করে স্কুলের অনেক গুলা ছেলেমেয়েকে মেরে ফেলেছে। আমি চিন্তা করে দেখলাম ব্যপারটা খারাপ না, কিন্তু পরক্ষনেই বুঝতে পারলাম জিনিসটা কত কঠিন। আমি একটা মেয়ে, আমার পক্ষে একটা বন্দুক জোগাড় করা অনেক কষ্ট সাধ্য একটা ব্যপার হবে। তাই বাধ্য হয়েই এই চিন্তা বাদ দিতে হল।
তারপর হঠাৎ করেই আইডিয়াটা আমার মাথায় এল। হাসির একটা সূক্ষ্য রেখা আমার মুখে ফুটে উঠল। অবশেষে সহজ কিন্তু দারুণ কার্যকরী কিছু একটা আমি খুজে পেলাম।
৭)
মোবাইলে রিংটোন বাজার শব্দে আমার চিন্তায় ছেদ পড়ল। তাকিয়ে দেকি সালেহ, আমার বয়ফ্রেন্ড কল দিয়েছে। সালেহ বেশ ভাল একটা ছেলে, কিন্তু এখন ভাল মন্দ হিসেব করার মত মন মানসিকতা আমার নেই। আমি ঠিক করলাম ওই হবে আমার প্রথম শিকার।
-হ্যালো
-হ্যালো, নিশু, কি অবস্থা, তোমার কোন খোজ খবর নেই অনেকদিন থেকে, কি হয়েছে?
-কিছু না, তুমি ভাল আছ?
-তা আর তুমি থাকতে দিলে কই?
-সালেহ
-বল
-তোমার সাথে আমার কথা আছে
-বল
-আমি ওই জিনিশটা করতে চাই
-কোনটা?
-তুমি যেটা করতে চাইতে, আমি রাজি হতাম না
-আমি ঠিক বুঝতে পারছি না
-physical relation, তোমার কোন আপত্তি না থাকলে আমি রাজি আছি
-oh my god, আমি তোমায় এত করে বলেছি, তুমি রাজি হও নি, আজ হঠাৎ?
-চিন্তা করে দেখলাম, আমরা তো অনেক বড় হয়েছি, আর বিদেশে তো এগুলা অহরহই হয়, নিজেকে কেমন জানি backdated মনে হচ্ছে, আর তোমাকেও আর বঞ্ছিত করতে ইচ্ছে করছে না, তাই
-সত্যি?
-হ্যা, সত্যি
-কবে বল?
-কালই হোক, তোমার পরিচিত কোন জায়গা আছে?
-অবশ্যই, কাল তুমি KFC এর সামনে বিকাল ৪টায় অপেক্ষা করবা, আমি তোমাকে তুলে নিব
-ওকে, রাখি।
আমি লাইন কেটে দিলাম।
এরপর অধির আগ্রহে কালকের দিনটির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
৮)
পরদিন, বিকেল ৪ টা
সালেহ ঠিক সময় মত আমাকে তুলে নিল। এইসব ক্ষেত্রে ছেলেরা মনে হয় কখনো দেরি করে না, অথচ এর আগে যখন ওর সাথে আমি যতবার দেখা করেছি, প্রতিবারই ও দেরি করে এসেছে। কিন্তু, ও নিজেও জানে ও কত বড় ভুল করতে যাচ্ছে। ভাবতেই অজান্তে আমার হাসি পেল।
ও আমাকে ওর কোন এক বন্ধুর বাসায় নিয়ে গেল। বাসায় আর কেউ ছিল না।
এরপর শুরু হল আমার খেলা। ও protection ব্যবহার করতে চাইল, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই আমি তা করতে দিলাম না। বললাম, আমার safe period চলছে। বিশ্বাস করুন কাজটুকু করার সময় আমার একটুও অপরাধবোধ জাগল না। আমার মাথায় তখন প্রতিশোধের চিন্তা।
সবকিছু শেষে, আমি ওকে খুলে বললাম। ও প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইল না, আমি আমার রিপোর্ট ওকে দেখালাম।
একটা তিব্র অবিশ্বাস ওর চোখে খেলা করল, ঠিক যেমনটা ছিল আমার মধ্যে।
human psychology বলে এসব ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে প্রথমে চরম হতাশা কাজ করে, তার পর চরম ক্রোধ, রাগ।
২য় স্টেজে যাওয়ার আগেই আমি ওকে বুঝাতে লাগলাম, দেখ যা হবার তা হয়েই গেছে, এখন যদি তুমি সবার সাথে ব্যপারটা share কর তাহলে তোমাকে কেউ সহজে মেনে নিবে না, তোমাকে এক ঘরে করে রাখা হবে, তুমি হয়ে পরবে অচ্যুত। তোমাকে সবাই করুনা করবে, একসময় তুমি হয়ে পরবে সবার কাছে ঘৃনার পাত্র। তুমি চিকিৎসা করাতে পার কিন্তু তুমি ভাল করেই জানো এর কোন চিকিৎসা নেই। তাই বলছি, চুপ করে থাক।
সব শুনে, ও বলল, 'আমি তোমাকে পুলিশে দিব'
'হ্যা,দিতে পার, কিন্তু, এতে করে তোমার ব্যপারটাও কিন্তু বেরিয়ে আসবে, আমি ভয় পাই না, মৃত্যু চিন্তা আমাকে আর ভয় দেখাতে পারে না'
এবার ও হু হু করে কেঁদে ফেলল।
আমার এত ভালো লাগল।
আমি শব্দ করে হাসতে লাগলাম।
৯)
এরপর আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এই পুরুষ শাসিত সমাজে লোভী কামুক পুরুষদের খুঁজে বের করতে আমার খুব একটা কষ্ট হয় নি।
১০)
কয়েক মাস পরের ঘটনা
ফেসবুকে 'প্রান্তিয় আবির' নামের আমার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড আমাকে মেসেজ করেছে।
-হাই
-হ্যালো
-কেমন আছেন?
-ভালো, আপনি?
-ভালো। আমি আবির
-আমি নিশু
- জানি
-কিভাবে জানেন?
-আপনি তো মোটামুটি একজন ফেসবুক সেলিব্রেটি, আপনার একটা ফটো আপলোড দিলে হাজার হাজার লাইক পড়ে
-হা হা
-আমার বন্ধু হবেন?
-হ্যা অবশ্যই
এই শুরু। এরপর কয়েকদিনের মধ্যেই এই বন্ধুত্ব অনেক দূর গড়িয়েছে। বলা ভালো আমিই তা বাধ্য করেছি।
অবশেষে এল সেই মোক্ষম দিন। আমি চলেছি আরেকটি শিকারের উদ্দ্যেশে। আমার ১৩ তম শিকার।
১১)
বরাবরের মতই সব কিছু হল। সব কিছু শেষে প্রত্যেক বারের মত আমি সব কিছু খুলে বললাম।
কিন্তু, আগের লোকগুলোর মত এর মধ্যে কোন আতঙ্ক বা ভয় কাজ করছে না। লোকটা আমার দিকে নির্লিপ্তের মত তাকিয়ে তাকল।
তারপর কিছু না বলে কাপড় পড়তে লাগল।
চলে যেতে যেতে দরজা খুলতে খুলতে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, 'আমিও এইচ আই ভি পজেটিভ'
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা, আমি ফ্যাল ফ্যাল চোখে ওর চলে যাওয়া দেখলাম।
১২)
এরপর কাহিনি অনেকদূর গড়াল। আমি অনেক কষ্ট করে আবির নামের ছেলেটাকে খুঁজে বের করলাম। ওকে রাজি করালাম এবং ওর সাহায্য নিয়ে ১০ জনের একটা দল গড়ে তুললাম।
এভাবেই আমি আমার প্রতিশোধের ক্ষেত্র চারিদিকে ছড়িয়ে দিলাম। এদের মধ্যে সবাই যে শোধ নেয়ার জন্যে এমন করত তা না, অনেকেই মজার জন্যে আমাদের দলে যোগ দিয়েছিল।
****************************************************************************
একদল ভুল মানুষ, ভুল স্বপ্ন দেখে, ভুল শহরের, ভুল রাস্তায়, ভুল মানুষের খুঁজে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
আপনাকে বলছি, হ্যাঁ আপনাকে, সাবধান আছেন তো?