আমি পিনাক। জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিক বলে একটা কথা আছে না? আমি হচ্ছি তার প্রকৃষ্ট উদাহরন। ৫ ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বাবা মারা গেছেন প্রায় ৪ বছর আগে। তখন থেকেই পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে আমার উপর। তিনটা টিউশনি করি, যা বেতন পাই তার ৪ ভাগের ৩ ভাগ বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হয়। যা থাকে তা দিয়ে জীবন চলে না। যা পাঠাই তা দিয়ে পরিবারও চলে না। প্রায়ই মা কল দিয়ে কান্না কাটি করেন। আমি শুধু শুনে যাই। তা ছাড়া আমার আর কিছু করারও নেই।
জানেন, আমি শেষ বার খেয়েছিলাম গতকাল দুপুরে। এখন আরেক দুপুর পেরিয়ে বিকাল হবে হবে করছে কিন্তু পেটে এক চিমটি দানা পানি পড়েনি। মাসের শেষ। হাতে একটা কানা কড়ি নেই। টিউশনির টাকাও পাচ্ছি না। মেসে যে যাব তারও কোন উপায় নেই। মালিক দেখলেই শুধু টাকা টাকা করছে। গতকাল তো সবার সামনে অপমানই করে বসল। আর ভাল লাগে না জানেন। মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মহত্যা করি, কিন্তু অভাগী মায়ের মুখটা মনে পড়লেই কেন জানি আর সাহস পাইনা।
তবে আজ আমি অনেক খুশি। অনেক দিন পর আমার দুঃখ, অভাব ঘোচানোর একটা বুদ্ধি খুজে পেয়েছি। কিভাবে? বলছি।
মহান সৃষ্টিকর্তা আমায় টাকা পয়সা না দিলেও একটা জিনিস দু'হাত ভরে দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে 'রূপ'। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেরই প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে। আর আমি ছাত্র হিসেবেও বেশ ভাল। এই দুইটা জিনিসের কারনে ভার্সিটির অনেক মেয়েই আমার সাথে সম্পর্ক করার আগ্রহ দেখিয়েছে। তার মধ্যে 'অন্যা' একজন। অন্যা যে খুব সুন্দরি তা বলা যাবে না কিন্তু আমি অন্যাকেই বেছে নিব ঠিক করেছি। কারন ওই হবে আমার উপরে উঠার সিঁড়ী। অন্যা তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। মা অনেক আগেই মারা গেছেন। অঢেল ধন সম্পত্তির মালিক অর বাবা। ওকে বিয়ে করলে ভবিষ্যতে যার মালিক হব আমি। কথাটা মনে হতেই আনমনে আমার ঠোঠের কোনায় হাসি ফুটে উঠল।
এই মুহূর্তে আমি অন্যার জন্যে অপেক্ষা করছি, ওদের বাসার সামনে একটা চায়ের দোকানে। আজই আমি ওকে আমার ভালোলাগার কথা বলব। ও নিশ্চয়ই আনন্দে আটখানা হয়ে যাবে। আমিও আনন্দে আটখানা নয় ষোলখানা হব, তবে ওকে পাওয়ার আনন্দে নয়, অর সম্পত্তি পাওয়ার আনন্দে।
ওই তো অন্যা আসছে, রিকসা করে। আমি সামনে এগিয়ে গেলাম
-হাই, অন্যা
-আরে পিনাক, তুমি এখানে?
-তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। খুশি হয় নি বুঝি?
-না, না কি বল, বাসায় এলেই পারতে।
-অন্য আরেকদিন আসব,
-তুমি আর আসবে, এত বলি, একবারও তো আসো না।
-অন্যা
-বল
-তোমার সাথে আমার খুব important একটা কথা আছে
- খুব serious কিছু মনে হচ্ছে।
-হ্যা
-ওকে, চল কোন রেস্টুরেন্টে বসে কথা বলি।
আমি ভাবলাম, আহ এই তো চাই, পেটও ভরবে, আমার ভবিষ্যতের স্বপ্ন বোনাও হবে
-হ্যা, হ্যা চল
আমরা বিশাল এক চায়নিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। সত্যি বলছি এরকম জায়গায় এর আগে আমি কখনো আসিনি। আমার কেমন জানি শিরশির করতে লাগল। আমরা একটা টেবিল নিয়ে বসলাম। অন্যা এরপর অনেক ধরনের খাবারের অর্ডার দিল। খাবারের কথা শুনে আমার পেটে কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে খাইনি। কিন্তু, অন্যাকে আমি তা বুঝতে দিলাম না, তারচেয়ে আমি অন্যাকে আমার কথা বলার প্রস্তুতি নিলাম।
-অন্যা
-হ্যা বল, তুমি আমাকে কি জানি বলবে
-অন্যা আমি খুবই দরিদ্র একটা ছেলে, বলতে গেলে আমার কিছুই নেই। ওই যে রাস্তার ফকিরটাকে দেখছ মনে হয় অর চেয়েও আমার টাকা পয়সা কম। এটা তুমি জান
-এভাবে বলছ কেন? টাকা পয়সাই তো সব না, মান সম্মানও একটা বড় ব্যাপার
আহা কি আনন্দ। অন্যা আমার ফাঁদে পা দিতে শুরু করেছে। আমি যা চাইছিলাম তাই হচ্ছে। আমি মোক্ষম কথাটা পাড়লাম এরপর
-তা হয়ত ঠিক। অন্যা, দেখ, আমি আমার জীবনে অনেক কষ্ট করেছি, টাকা পয়সার কষ্ট, খাবার কষ্ট, ভাল কাপড়ের কষ্ট। একসময় আমি চরম হতাশ হয়ে পরলাম। জীবন থেকে কোন কিছু প্রাপ্তির আশা ছেড়ে দিলাম। আমার জীবন হয়ে পড়েছিল সাদা কাল এক রঙ হীন পানশে জীবন। আমি বেচে থাকার কোন অর্থ খুজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু, একদিন তুমি আমার জীবনে এলে। সত্যি বলছি তোমাকে আমি প্রথম যেদিন দেখি আমি নতুন করে বাঁচার প্রেরণা খুজে পেলাম।
(আমি কথা বলছিলাম আর অতি সন্তর্পণে অন্যার চোখের দিখে তাকাচ্ছিলাম। আমি দেখলাম ওর চোখ আস্তে আস্তে পানিতে ভরে উঠছে। আমি নিজের অভিনয়ে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম, আর ও তো একটা বোকা মেয়ে মানুষ।)
-তুমি কি বলতে চাচ্ছ?
-আমার হয়ত কিছুই নেই, কিন্তু আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি তোমার জন্যে আমার ভালোলাগার কোন কমতি নেই। জানি আমার মত একটা মানুষের তোমাকে পাওয়ার আশা করা বোকামি তার পরও এই বোকামিটা করতে আমার খুব ভাল লাগছে। অন্যা আমি তোমায় অনেক টাকা পয়সা ধন দৌলত দিতে পারব না সত্যি কিন্তু তোমার ভালবাসার কখনো কমতি হবে না। আমি তোমার অনেক অনেক ভালবাসি, মনে হয় নিজের জীবনের থেকেও বেশি। আমি জানি তোমার আমাকে ভালবাসার কোন কারন নেই কিন্তু আমি তোমাকে ভালবাসি এবং এই কথাটা তোমাকে বলতে পেরেছি এটাই আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। অনেক ভাল থেক সবসময়। আমি উঠলাম।
(আমার যাও ক্ষীণ সন্দেহ ছিল কিন্তু অন্যার কথায় তাও দূর হয়ে গেল। ও আমার হাত টা ধরে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল )
-পিনাক, টাকা পয়সা দিয়ে আমি কি করব বল,টাকা পয়সা আমার কমতি নেই। এই পৃথিবীতে ভালবাসার বড় অভাব। তুমি সেই দুর্লভ জিনিসটাই আমাকে দেয়ার কথা দিয়েছ, আমার আর কিচ্ছু চাই না। আমিও তোমায় ভালবাসি।
চিন্তা করুন আমার অবস্থা। আমার মারা যেতে ইচ্ছে করছে, তবে এবার দুঃখে নয় খুশিতে। ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। ওর শরীরটা মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে। ও ভালবাসার প্রত্যাশায় কাঁপছে, আর আমি অনেক সম্পদশালী হব এই প্রত্যাশায় মুচকি হাসছি। আনন্দের আতিশহ্যে আমি ওকে আর শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম।
এরপরের ঘটনা খুব সহজ। অর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। ওর বাবা অবশ্য অনেক ঘাইঘুই করেছিলেন। কিন্তু অন্যার প্রবল ইচ্ছের মুখে তা আর ঠিকেনি। বিয়ের পর আমি ওকে আমার মেসে উঠাতে চাইলাম, না , বলা ভাল উঠানোর ভাব দেখালাম। ওর বাবা স্বভাবতই তা মানতে রাজি হলেন না। যার জন্যে আমি হাসি হাসি মুখ করে ওদের বাসায় গিয়ে উঠলাম। অর্থাৎ ঘরজামাই হলাম। ওরা খুশি আর আমিতো মহাখুশি।
এরপর শুরু হল আমার আসল প্ল্যান। আমি মনে প্রানে অন্যাকে ভালবাসার অভিনয় করে যেতে লাগলাম। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমার ব্যাংক ব্যালান্সও বাড়তে লাগল। একসময় আমার মনে হল অনেক তো হল এবার পালিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু আমার লোভী মন এখন আর অল্পতে তুষ্ট নয়। সে আরও অনেক কিছুই চায়। হ্যা, আমি প্ল্যান করলাম, এই পুরো সম্পত্তিটাই আমি নিজের করে নিব।
শুরু হল আমার নতুন পরিকল্পনা। তার অংশ হিসেবে আমি ঠিক করলাম আমি আমার শ্বশুড় মানে অন্যার বাবাকে খুন করব।
আমি সুযোগের অপেক্ষায় থাকলাম। একসময় তা এসেও গেল। একদিন রাতে আমি চুপিচুপি আমার শ্বশুড়ের রুমে ঢুকলাম। বয়সের বাড়ে আর সারাদিন পরিশ্রম করে উনি ক্লান্ত। নাক ডাকিয়ে মনের সুখে ঘুমাচ্ছিলাম। আমি একটা বালিশ নিয়ে আস্তে করে উনার নাকে মুখে চাপ দিলাম। বেশ কষ্ট হল কিন্তু একসময় কাহিনি খতম হল। আমার জীবনের প্রথম খুন কিন্তু আমার একটুও খারাপ লাগল না, আমি তখন টাকার নেশায় যে অন্ধ হয়ে গেছি।
এদেশে টাকা হলে সবকিছুই সম্ভব করা যায়। টাকা দিয়ে এই ঘটনাকে স্ট্রোক বলে চালিয়ে দিতে আমার একটুও কষ্ট হল না। আমার প্রিয়তমা বউ আমার ঘাড়ে মাথা রেখে কান্না জড়ানো কণ্ঠে তা মেনেও নিল।
এরপরের টার্গেট হল অন্যা। এর জন্যেও আমার অনেক দিন অপেক্ষা করতে হল। একসময় সেই সুযোগও এসে গেল। বিয়ের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অন্যা বায়না ধরল ও রাঙ্গামাটি বান্দরবানে বেড়াতে যাবে। আমি প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু হঠাৎ করে আমার মনে হল আরে আমি আমার ২য় ইচ্ছেটা তো ওইখানে গেলেই পূরণ করতে পারি। আমি খুশি খুশি মনে রাজি হয়ে গেলাম।
বান্দরবানে আসার আজ দুই দিন হল। আমি ভাল কোন সুযোগ পাচ্ছিলাম না। কারন ও পাহাড়ের উপর উঠতে ভয় পায়। তবে আমি ধৈয্য হারালাম না। এতদিন যখন অপেক্ষা করেছি আর কিছুদিন নিশ্চয় অপেক্ষা করতে পারব।
আমি ওকে বুঝাতে লাগলাম। রাঙ্গামাটি এসে পাহাড়ে না উঠলে বেড়ানোটাই তো বৃথা। ও কিছুতেই রাজি হবে না। একসময় আমি অধৈয্য হয়ে উঠলাম। যখন আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি তখন ও রাজি হয়ে গেল।
এরপরের কাহিনি খুব সহজ। ও আর আমি পাহাড়ের উপরের উঠলাম। তারপর খুব হালকা একটা ধাক্কা। তাতেই কাহিনি শেষ। পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে ও কেমন জানি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আর আমি ? আমি তখন মুক্তির অনন্দে, চূড়ান্ত প্রাপ্তির আনন্দে হু হু করে হাসছি।
****************************************************************************
-ভাইজান, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কি দেখছেন? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি।
আমি চমকে পেছনে তাকালাম। চায়ের দোকানের মামা।
আমি বললাম। কিছু বললেন?
-না, অনেকক্ষণ ধরে আপনি এখানে দাড়িয়ে ওই আপা আর ভাইজানের দিকে তাকিয়ে আছেন তো তাই বললাম।
আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম এক কাল রঙের কারের গায়ে হেলান দিয়ে একটা ছেলে একটা মেয়ের সাথে গল্প করছে। মেয়েটা হচ্ছে 'অন্যা'
পেছন থেকে মামা বলে যাচ্ছে, 'আপনি মনে হয় মেয়েটাকে ভালবাসতেন। দুঃখ কইরেন না , ওই ছেলেটাকে আপামনি ভালবাসে। আমার দোকানের পাশদিয়েই প্রতিদিন যায়। নেন চা খান, আপনার টাকা লাগবে না'
আমি হু হু করে হাসতে লাগলাম। আশা ভঙ্গের কষ্টে নাকি অজানা কোন আনন্দে, ঠিক জানি না।
(গল্পটি আমার এক প্রিয় গল্পকার 'রাকিব হাসানের' একটি গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত)