কা কা শব্দে অন্তুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। এটা অবশ্য নতুন কিছু না। প্রতিদিন এভাবেই ওর ঘুম ভাঙ্গে। আড়মোড়া ভেঙ্গে চোখ কচলাতে কচলাতে অন্তু ঘর থেকে বের হয়ে এল। কালো আকাশটা হাসতে হাসতে একটু একটু করে নীল হয়ে যাচ্ছে। লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া সূর্যটা চারিদিকে কেমন জানি এক রহস্যময়তা ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই অদ্ভুত আলোয় ওদের ঘরের ঠিক পাশেই সগর্বে দাড়িয়ে থাকা আম গাছটাকে কেন জানি আরও বেশি রহস্যময় মনে হচ্ছে। তারই এক হাড় লিকলিকে ডালে বসে এক চোখওয়ালা কাকটা অনবরত ডেকেই যাচ্ছে, যেন ওকে পৃথিবীতে পাঠানোই হয়েছে কা কা করার জন্যে। অন্যদিন হলে অন্তু এক ঢিল মেরে তাড়িয়ে দিত, কিন্তু আজ কেন জানি কাকটার উপর খুব মায়া লাগছে। কেন জানি মনে হচ্ছে এই কা কা শব্দটা এক করুন আর্তনাদ, কেন জানি মনে হচ্ছে কাকটা ওর মতই দুঃখের জালে আটকা পড়ে আছে।
এমন সময় দারুন এক সুঘ্রানে ওর চিন্তায় ছেদ পড়ে গেল। তাকিয়ে দেখে ওদের ছোট্ট ঘরটার সামনের রেল লাইনের উপর বসে মা কি জানি রাঁধছে।
মিষ্টি হেসে মা বললেন
-কি গো বাপজান, ঘুম ভাঙল?
-হ। কি রাঁধো মা?
-কেন গন্ধ পাও না?
-পাই তো, পোলাও নাকি?
-হ
-কেন?
-আজব কান্ড, আইজকা যে ঈদ, তোমার কি তা মনে নাই?
অন্তুর ছট করে মনে পড়ে গেল, আরে তাই তো আজকে তো ঈদ। মুহূর্তেই মনটা ভাল হয়ে গেল। বলা যায় সারাটা বছর ও এই দিনটার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। এই দিনটা অন্তত খাওয়ার কষ্টটা থাকে না। মা কিভাবে কিভাবে জানি পোলাও, মুরগি আরও নানা জাতের ভাল ভাল খাবার জোগাড় করে ফেলেন।খাওয়ার কষ্ট যে কি জিনিস তা অন্তু ভাল করেই জানে।প্রায়ই ওকে শুধু জল খেয়ে কাটাতে হয় তো তাই। বড়লোকের বাচ্ছারা কেন জানি খেতে চায় না। অন্তু মাঝে মাঝে পার্কে গেলে দেখে মা রা খাবার নিয়ে বাচ্ছাদের পেছন পেছন ঘুরে। বাচ্ছারা দৌড়ে পালায়, কখনও কখনও কান্না কাটি শুরু করে দেয়। একসময় মা রা বিরক্ত হয়ে খাবার ফেলে দেয়। অন্তু ভেবে পায় না খাবার পেয়েও অই বাচ্চাগুলা খায় না কেন। ওদের মনে হয় আল্লাহ পেটটা ছোট করে বানিয়ে দিয়েছেন। তাহলে আল্লাহ অন্তুর পেট বড় করে বানিয়ে দিয়েছেন কেন, ওর শুধু ক্ষিধা পায়। অথচ ও খেতে পায় না। কি জানি।
মজার ব্যপার হল, এই দিন ওকে কাগজ টোকাতেও যেতে হয়না, এমনকি ও সারাদিন ঘুরে বেড়ালেও মা কিচ্ছু বলে না।
ওর বাবা একসময় রিক্সা চালাতেন, কয়েক বছর আগে এক্সিডেন্ট করে উনার পা টা ভেঙ্গে যায়। তার পর থেকে ওর বাবার মেজাজটা সব সময় খিটখিটে হয়েই থাকে। কারনে অকারনে অন্তুকে গালাগালি এমনকি মারামারিও করেন। একসময় অন্তু খুব কান্নাকাটি করত কিন্তু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে তো তাই কান্নাকাটি করে না। দাতে দাত ছেপে বসে থাকে। কিন্তু, ওর বাবা যখন মা কে মারেন তখন ও আর সহ্য করতে পারে না। মনে হয় মনে হয় বাবাকে মেরেই ফেলে। ওর কাছে একটা খুব ধারালো চাকু আছে। একদিন রমনা পার্কে কাগজ কুড়োতে গিয়ে পেয়েছে। কিন্তু, মার জন্যে পারে না। একদিন ও মাকে বলেছিল ওর চিন্তার কথা। এ কথা শুনে মার সে কি কান্না, বাবা নাকি গুরুজন, এসব নাকি বলতে হয় না। অন্তুর খুব অবাক লাগে। বাবাটা একসময় কত ভাল ছিল। ওকে কাধে করে ঘুরত, রিক্সায় করে মা আর অন্তুকে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতে যেত। অন্তু স্কুলে যেত, যেই না বাবা পঙ্গু হল তার পর থেকে শুরু হল অভাব। বাবা একটার পর একটা অসুখে ভুগতে লাগল। একপর অন্তু আর ওর মা মিলে কাগজ কুড়াতো, ফুল বিক্রি করত আরও কত কি, তখনো ভালই চলছিল। চুড়ান্ত দুর্ভোগটা দেখা দিল যখন মাও অসুস্থ হয়ে পড়ল। এখন ওকেই একা একা কাগজ কুড়াতে যেতে হয়।
ঈদের দিন ওর বাবাও অনেক ভাল হয়ে যান, অন্তত অন্যান্য দিনের মত অকারনেই গালাগালি করেন না।
-আব্বার শরীরটা আইজকা একটু ভাল, মা?
-হ। অন্তু, বাবা যাওতো গোসলটা করে এস। তারপর আমার বিছানার উপর মাথার কাছে দেখবা একটা ব্যাগ আছে। ওইখানে তোমার জন্যে একটা পাঞ্জাবি রাখা আছে ওইটা পইড়া আমার পাশে এসে বসতো।
নতুন পাঞ্জাবির কথা শুনে অন্তুর মনটা আনন্দে লাফ দিয়ে উঠল।
-এত তাড়াতাড়ি? নামাজ তো দেরি আছে।
-তা আছে, তবু বাপজান তুমি যাও, গোসল করে আম্মার পাশে এসে একটু বস। সারাটা বছরতো কষ্ট কর, আম্মার পাশে তো বসার সুযোগ হয় না।
অন্তু আর কথা বাড়ায় না। ও গোসল করে এসে মার পাশে বসে। মা টুক টূক করে রান্না করছেন, আগুনের লালচে আভা মা’র মুখে এসে পড়ছে। কেন জানি মাকে অনেক বেশি সুখি সুখি মনে হচ্ছে, ঠিক অনেকদিন আগের সেই মায়ের মত।
এভাবে অনেক্ষন পার হয়ে গেল। একসময় অন্তুর বাবা এসে বললেন
-অন্তু, উঠ উঠ নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে তো।
পেছনে তাকিয়ে অন্তু ওর বাবাকে দেখতে পেল। সাদা রঙের পাঞ্জাবি পড়ে দাড়িয়ে আছেন। বাবাকেও আজ অন্য রকম মনে হচ্ছে। আজ চারিদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ঈদের আনন্দ।
অন্তু আর ওর বাবা মসজিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্তুর বাবা ক্রাচে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে যাচ্ছেন, পাশেই অন্তু। ও শক্ত করে ওর বাবার ডান হাতটা ধরে আছে। যেন সুখটাকেও পরম যত্নে আগলে রেখেছে। হারিয়ে যাতে না যায়। পরম আরাধ্য সুখ, যাকে টাকা দিয়েও কেনা যায় না।
একসময় ওরা মসজিদে পৌঁছে গেল। নামাজ পড়ল। সবাই সবার সাথে কোলাকোলি করছে। চেনা অচেনা, ধনী, গরীব সবাই সবার সাথে। কি আনন্দ! কি আনন্দ!
আসার সময় অন্তুরা রিক্সায় করে এল। দরজায় মা দাড়িয়ে আছেন, নতুন লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে। মাকে ঠিক নতুন বউয়ের মত মনে হচ্ছে। কতদিন মাকে নতুন শাড়িতে দেখে না।
-বাপজান, চলে আসছ?
-হ্যা, আম্মা
- হাত মুখ ধুয়ে খেতে আস
অন্তু খাটের উপর বসে আছে, ওর পাশেই ওর বাবা। বাবা পরম যত্নে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মা এক এক করে খাবার নিয়ে আসছেন। অন্তুর আর তর সইছে না। এক বছর ঠিক এক বছর এরকম খাবারের জন্যে ও অপেক্ষা করে থাকে। আহা খাবার এর জন্যেই জগতে এত কষ্ট, এত লীলাখেলা, এত কিছু। অথচ একেই কেউ না চাইতেই পেয়ে যায়, কেউ বা হাজার চেষ্টা করেও খেতে পায় না।
অন্তু অনেক চেষ্টা করেও মুরগির রানটাকে বাগে আনতে পারছে না। ওর আবার সামনের দাঁতটা গত সোমবারে পড়ে গেছে। এজন্যেই এত সমস্যা, তারপরও ও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পোলাওটা যা মজা হয়েছে না! রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া অইসব বাসি, এঁটো পোলাও এর থেকেও অনেক ভাল। গরুর মাংসটাও অসাধারন হয়েছে। ও খাচ্ছে আর ওর মা আস্তে আস্তে করে বাতাস করে যাচ্ছেন।
একসময় ওর পেটটা ভরে উঠল। তারপরও ও জোর করে আরও কিছু খেল। এরকম খাবার তো আর সচরাচর পাওয়া যায় না।
একসময় ওর খাওয়া শেষ হল। পেটের প্রতিটি কোনা ভরে উঠেছে। আহ! কি শান্তি। পাশে তাকিয়ে দেখে ওর বাবা হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। ও হাত ধুতে যাবে এমন সময় মা বলে উঠলেন
- কি রে বাপজান, খাওয়া শেষ? পোলাও আরেকটু নে
‘না মা, পেট ভরে গেছে, আর খাব না’
*********************************************
-কি রে অন্তু উঠ, কাজে যাবি না?
অন্তু, ধড়পড় করে ঘুম থেকে উঠল।
-কিরে এত ঘুমাচ্ছিস যে, নবাবের মত। বলি, কাজে যেতে হবে না?
-মা, আজ না ঈদ?
-হ্যা, আজ ঈদ। তাইতো আজ চাইলেই বড়লোকেরা অনেক কিছু দিবে। আমি যাকাতের শাড়ির জন্যে যাব আর তুই কাগজ কুড়োতে যাওয়ার আগে মানুষের বাড়ি বাড়ি যাবি। ভাল ভাল খাবার দিবে।
অন্তু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, মাকে আজ অনেক সুখি সুখি মনে হচ্ছে কিন্তু এই সুখের সাথে অনেকদিন আগের সুখের অনেক অমিল। কেন জানি এই সুখের সাথে অনেক বেশি অসহায়ত্ব মিশে আছে, অনেক বেশি তাচ্ছিল্যতা লেগে আছে, অনেক বেশি না পাওয়ার হাতছানির ইঙ্গিত আছে। অন্তু কখনো এরকম করে সুখকে পেতে চায়নি।
অন্তু চোখ কচলাতে কচলাতে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। চারিদিক কেমন জানি বিচ্ছিরি রকম অন্ধকার হয়ে আছে, সূর্যটাকে কেমন জানি অসহ্য লাগছে, ঘরের পাশের আম গাছটাকে উৎপাত মনে হচ্ছে। এটা না থাকলে ওদের ঘরটা আরেকটু বড় হতে পারত। গাছের ডালে একচোখা কাকটা সেই কখন থেকে ডেকেই যাচ্ছে। অন্তু অনেক বড় একটা ইটের টুকরা হাতে নিল। তারপর কাকটার দিকে ছুড়ে মারল।
-শালার কাক, সারাক্ষন শুধু কা কা
ঘর থেকে অন্তুর মায়ের গলা শোনা গেল
-কি রে অন্তু, নবাবজাদা, দাত মাজতে এত সময় লাগে? তাড়াতাড়ি এসে দু’টা খেয়ে তারপর কাজে গিয়ে আমাকে উদ্বার কর।
অন্তু ঘরে এসে দেখে মা প্লেটে একমুঠো পান্তা ভাত বেড়ে বসে আছেন। ওর রাতের কথা মনে পড়ে গেল। মা ভাত খাননি। খাবেন কি করে ভাত যে ছিল না। একথা মনে হতেই অন্তুর কেন জানি আর খেতে ইচ্ছে করল না। এক গ্লাস পানি খেয়ে কোন মতে শার্টটা গায়ে দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। পেছন থেকে মা চিৎকার করলেন
- কি রে খাবি না?
‘না মা, পেট ভরে গেছে, আর খাব না’
অন্তু রেল লাইন সরু লাইনটা ধরে হেটে যাচ্ছে। ও অনেক চেষ্টা করছে ব্যালান্স ধররে রাখতে, কিন্তু যার জীবনটাই জীবন নামক পথ থেকে ব্যালান্স হারিয়ে অনেক আগেই পড়ে গেছে সে কি করে এখনই বা সফল হবে।
অন্তুর খুব কান্না পাচ্ছে। পরাজয়ের কান্না, অভিমানের কান্না। অন্তু জানে না এই অভিমান কার উপর।
হয়ত পরম করুণাময়ের উপর যিনি সপ্ত আসমান থেকে অথবা অন্তুর ঠিক পাশে বসে মানুষের ভাগ্যের খেলা খেলছেন। যার প্রতিটি ঘুঁটিতে, প্রতিটি চালে লুকিয়ে আছে সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা।
অন্তুর মা বলেন আল্লাহর কাছে নাকি অভিযোগ করতে নেই, উনি যা করেন ভালর জন্যেই করেন।
অন্তুর খুব জানতে ইচ্ছে করে এই যে অন্তু খেতে পাচ্ছে না, ওর মায়ের একখান ভাল শাড়ি নেই, ওর বাবা পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছেন এতে কি ভাল লুকিয়ে আছে?
অন্তু হাঁটছে আর অবাক হয়ে ভাবছে, সপ্নে আর সপ্ন ভাঙ্গার পড়ে ওর মাকে বলা ‘না মা, পেট ভরে গেছে, আর খাব না’ কথাটার মধ্যে প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে মিল। কিন্তু, অর্থের দিক থেকে মিশে রয়েছে কতই না অমিল।
আজ ঈদ। চারিদিকে আনন্দ বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু, অন্তুর মত অনেকেই এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তাদের মাথার উপর বিরাজমান দুঃখের আচ্ছাদন। অন্তুরা পাওয়া না পাওয়ার, মিল আর অমিলের হিসেব মেলাতে ব্যস্ত।
[ঈদের দিন আমার খুব ছোটবেলার এক ফ্রেন্ড তার বাসায় দাওয়াত দিল। রাতে জার্নি করায় দিনে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে যেতে যেতে বিকেল হয়ে গেল। ওর বাসা আমার বাসার পাশেই। রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় একটা দৃশ্য দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটা বাচ্চা রাস্তার পাশে বসে কান্না কাটি করছে ‘মা, খানি দেও, খানি দেও, খুব ভোগ লাগছে (মা, খাবার দাও, খাবার দাও, খুব ক্ষুধা লাগছে)এই বলে। পাশেই তার অভাগী মা হাত পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে,আর চোখ দিয়ে পড়ছে অঝোর ধারায় পানি ।পকেট হাতড়ে ৫০ তাকার বেশি পেলাম না। টাকাটা দিতেই তার চোখে যে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠেছিল, তা আমার অনেকদিন হয়ত সারাজীবন মনে থাকবে]