২০১৪ সালের ১৫ই জুলাই। আজ আমার কলেজ নেই। কলেজ থাকার কথাও না। কারন আজ সরকারি ছুটির দিন। অফিস আদালত সব কিছু বন্ধ।
আমরা, বাংলাদেশ নামক এক অভাগা দেশের ১৬ কোটি মানুষ বছরের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দিনটিকে অতি সারম্ভরে স্মরণ করছি।
করবই না কেন? আজ আমাদের মহান রাষ্ট্রপতি গোলাম আজমের জন্মদিন। গত বছর ঠিক এই দিনে এক নখদন্তহীন, ভুল চেতনায় সপ্নবিলাসী সরকার উনাকে নতুন করে বাচার সুযোগ করে দিয়েছিল, দিয়েছিল নতুন এক পুনর্জন্ম।
তাই আমাদের রাষ্ট্রপতি সাহেব তার আসল জন্মদিন থেকেও এই দিনটিকে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন, আর তাই আজ সারাদেশে চলছে আনন্দের বন্যা। দেশের মানুষ আজ আনন্দের সাইক্লোনে ভেসে যাচ্ছে।
এই বিশেষ দিনে আমাদের জন্যে বিনোদনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এজন্যে আজ বিকেল তিনটার দিকে গোলাম আজম চত্বরে সমবেত হতে বলা হয়েছে। বলে রাখা দরকার এই গোলাম আজম চত্বরের পূর্বনাম ছিল প্রজন্ম চত্বর। যা ছিল কিছু বকে যাওয়া, কম্যুনিস্ট ছেলে মেয়ের অনুরবর মস্তিস্ক কর্তৃক প্রসূত নাম। যারা নাকি এখানে একসাথে জড় হয়ে বেলাল্লাপনা করত। তাদেরকে অবশ্য উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হয়েছে। ঘাড়ে ধরে মুক্তিযুদ্ধের ভূত মাথা থেকে নামানো হয়েছে।
আমরা একে একে প্রজন্ম চত্বরে প্রবেশ করছি। চত্বরের প্রবেশমুখে ঝলমলে এক গেট বানানো হয়েছে। গেটের ছাদে আমাদের রাষ্ট্রপতি গোলাম আজমের ছবি। তিনি আমাদেরকে তার মধ্যমা প্রদর্শন করছেন। আমরা উনার এত সুন্দর ছবি দেখে আবেগে প্রায় কাদু কাদু হয়ে যাচ্ছি।
বিশাল এক স্টেজ সাজানো হয়েছে। স্টেজে অনেকগুলা মানুষ। অনেক কষ্ট করে খেয়াল করে দেখলাম, তাদের বুকে সাইনবোর্ডের মত কিছু একটা ঝুলছে। অনেক কষ্ট করে ওখানের লেখা গুলা পড়তে পারলাম। 'আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার নাম হারু মিয়া। আমি একজন জঘন্য অপরাধী। আমার বিচার হওয়া প্রয়োজন। '
এরকম প্রত্যেকটা মানুষের বুকে লেখা।
সবার সামনে সুন্দর এক গদিওয়ালা চেয়ারে আমাদের মহান রাষ্ট্রপতি চুক চুক করে দুধ খাচ্ছিলেন। উনাকে আজ অন্যান্য দিনের চেয়েও অনেক বেশি প্রসন্ন মনে হচ্ছে। অবশ্য খুশি হওয়ারই কথা। আজ একটা বিশেষ দিন।
এমন সময় কেউ একজন আমার হাতে একটা লিফলেট ধরিয়ে দিল। এতে লেখা
'হে মানব সন্তানেরা, মহান রাষ্ট্রপতি গোলাম আজমের আশীর্বাদধন্য দেশবাসী, আজকের এই মহান দিনে এই মহান মিলনস্থলে আপনাদের স্বাগতম। আপনাদের প্রতি নির্দেশ, মাইকে যখন ঘোষনা দেয়া হবে তখন আপনারা ২ মিনিট সজোরে করতালি দিবেন আর ২ মিনিট নিজের বৃদ্বাঙ্গুলি মুখে পুরে ললিপপের মত চুষতে থাকবেন। এরকম করবেন থামার নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত। আপনাদের সুন্দর সময়ের প্রত্যাশায়। ধন্যবাদ।'
তিনটে বাজার সাথে সাথে শুরু হল অনুষ্ঠান। গোলাম আজমের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের লাইন করে দাড় করানো হল। তাদের ঠিক দুই হাত সামনে অস্র তাক করে দারিয়ে আছে সুপ্রশিক্ষিত গোলাম বাহিনী।
একসময় সাইরেন বেজে উঠল। শুরু হল মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে গুলি। পেছন থেকে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে 'দেশবাসী, আপনারা নির্দেশ মত কাজ করুন। করতালি দিন আর বৃদ্বাআঙ্গুলি চুষতে থাকুন।
আমরা এতই বিনদিত হচ্ছিলাম যে নির্বাক হয়ে গেলাম। ৪৩ বছর পর ১৯৭১ সালের বেঈমানদের, পাকিস্তানের শত্রুদের বিচার হচ্ছে। ব্রাশফায়ার করে এদের হত্যা করা হচ্ছে। আমরা এতই বিনোদিত হচ্ছি যে করতালি দিতে ভুলে গেলাম।
মাইকে আবার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে নির্দেশ না মানলে আমাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনা হবে।
আমরা হাততালি দিচ্ছি। হাততালির শব্দে গুলির আওয়াজ ঢাকা পরে গেছে। আমরা আরও জোরে হাততালি দিচ্ছি যাতে আমাদের গুলির শব্দ শুনতে না হয়।
আমরা চোখ বন্ধ করে আছি। কিন্তু তাও আমাদের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ে যাচ্ছে।
আমরা জানি না কিসের জন্য এই অশ্রু বিসর্জন?
এটা কি এক পঙ্গু জাতির অসহায়ত্বকে স্মরণ করে নাকি নিজেদের অক্ষমতাকে স্মরণ করে নাকি শুধুই দুঃখের এক বাতাবরণ।
আমরা সত্যিই জানি না