প্রায় মাস দুয়েক হতে চলল ভার্জিনিয়াতে এসেছি, কিন্তু নানান কারণে মনে হচ্ছে যেন বছর খানেক পেরিয়ে গেছে। শুরুর দিকের ধাক্কা সামলে এখন সবকিছু মোটামুটি একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসে গেছে। যেমন, ডিম ভাজার সময় উল্টোতে গিয়ে এখন আর গুড়ো হয়ে যাচ্ছেনা, ২৪ ঘন্টা কারেন্ট থাকাটাকেই এখন স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে, ইংরেজিতে কথাবার্তা বলার সময় এখন আর প্রথমে বাংলায় চিন্তা করে তারপর সেটাকে ট্রান্সলেট করার দরকার পড়ছে না, ইউনিভার্সিটির বাসগুলো ইউনিভার্সিটির তরুণীদেরকে চালাতে দেখে এখন আর হা করে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছেনা। এরই মাঝে পুরো এক মাস রোজা এবং একটা ঈদও করে ফেললাম। রোজাটাও আমেরিকান, ঈদও আমেরিকান- সেটারই কিছু হাইলাইটস এই মুহূর্তে বলার চেষ্টা করি। এবারে শুধু রোজার কথা বলব, সামনে সময় পেলে ঈদ নিয়ে লিখব।
আমাদের দেশের মত আকাশে চাঁদ দেখে আমেরিকায় রোজা কিংবা ঈদ পালন করা হয়না। 'ইসনা' নামে এদের একটা কমিটি আছে যেটা আগে ভাগেই ঘোষনা দিয়ে রাখে অমুক দিন থেকে রোজা শুরু। এরা এখানে নামায, রোজা, কিবলা সব কিছুরই তালিকা বানিয়ে রেখেছে, যার দরকার ইন্টারনেটে রুটিন দেখে ধর্ম-কর্ম করবে। আমি অবশ্য এই তালিকার হিসেব-নিকেষ কি করে করা তা এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। যেমন, ওয়ার্ল্ডম্যাপে আমেরিকা থেকে সৌদি আরব আমার কাছে অনেকটা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মনে হলেও, 'ইসনা'র তালিকায় উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করে নামায পড়ার কথা লেখা আছে, এবং আমেরিকার সবাই উত্তর-পূর্ব দিক কেই কেবলা ধরে। চাঁদ দেখা নিয়ে আমরা নতুনেরা প্রথমে উচ্চবাচ্য করলেও পরে চিন্তা করে দেখলাম, একদিন বেশি রোজা রাখলে তো কোন ক্ষতি নেই, বরং লাভ, কারণ দিনের বেলা রান্নাবান্নার ঝামেলাটা অন্তত আর থাকছেনা। এছাড়া শুনেছি আমেরিকার প্রায় প্রতিটি ভার্সিটিতেই মুসলিম স্টুডেন্ট এ্যাসোসিয়েশন থাকে, যারা ছাত্রদের জন্য প্রতি রোজায় ফ্রী ইফতারের ব্যবস্থা করে। খুব দ্রুত ইউভিএর মুসলিম স্টুডেন্ট এ্যাসোসিয়েশন খুঁজে বের করে অতি আনন্দের সাথে সেটার মেম্বার হয়ে গেলাম। এভাবেই রাতের খাবারের চিন্তা থেকে ঠিক এক মাসের জন্য মুক্ত হয়ে গেলাম।
আমি যেখানে থাকি সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে সূর্যদয় হয় ভোর সাড়ে পাঁচটায় আর সূর্যাস্ত হয় রা্ত পৌণে আটটায়। শেষের দিকে আস্তে আস্তে সূর্যাস্তের সময় এগিয়ে আসলেও দিনের দৈর্ঘ্য খুব একটা কমেনি। গড়ে তাই প্রায় সাড়ে চৌদ্দ ঘন্টা রোজা রাখতে হয়েছে। এত দীর্ঘ সময় রোজা রাখার অভিজ্ঞতা খুব একটা আনন্দময় না। আমার একটা প্রশ্ন, পৃথিবীর এত দেশের এত মানুষ রোজা রাখে- কেউ কেউ দশ ঘন্টা, কেউ বারো, কেউ চৌদ্দ, কেউ বিশ! এদের সবাই কি একই পরিমাণ পূণ্য পায়, নাকি পূণ্যের পরিমাণ রোজার দৈর্ঘ্যের সাথে সমানুপাতিক? প্রশ্নটা অবশ্য 'ইসনা'র কাছেও করা যায়, তবে বলা যায়না, সে ক্ষেত্রে তারা হয়তো আগামী বছর থেকে মাগরিবের বদলে আসরের সময় ইফতারের নিয়ম করে ফেলতে পারে! আমেরিকায় সবই সম্ভব।
বাংলাদেশে রোজার দিনে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে মহা সুবিধা। বুয়েটে রোজার দিনে ক্লাস শুরু হতো দেরিতে, শেষ হতো তাড়াতাড়ি, আবার ১ ঘন্টার ক্লাসগুলি ৩৫ মিনিট হবার কারণে স্যারদের বিরক্তিকর লেকচার গুলোও খুব দ্রুত পার হয়ে যেত। আমেরিকায় সে খাতির নেই। পিএইচডি স্টুডেন্টদের রিসার্চের জন্য ধরাবাঁধা কোন রুটিন তো নেইই, বরং হুট করে ছোট্ট একটা ইমেল দেবে- 'ইক্ষুনি এসো, নতুন আইডিয়া পাওয়া গেছে, আলোচনা আবশ্যক।' সবাই মিলে তখন কোন একটা সমস্যার সমাধানের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনার টেবিলে বসে গবেষণা করতে হবে। কখনো কখনো এসব মিটিংয়ে সুস্বাদু খাবার দাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কিন্তু, রোজার মাসে এই খাবার গুলোর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন কিছুই করার ছিলনা। সবাই খেতে খেতে কাজ করছে, আর আমি খাবারের প্রতি কোন আগ্রহ দেখাচ্ছিনা বলে সবাই আমাকে একজন নিবেদিত প্রাণ রিসার্চার মনে করত। তাদের ভুল আমি কখনও ভাঙ্গাতে যাইনি।
সারাদিন পড়াশোনা, গবেষণা, আর অনুশোচনা শেষে ইফতারের সময় হলেই ইউনিভার্সিটির কাছেই মসজিদে চলে যেতাম। সেখানে মাগরিবের পর জম্পেস খাওয়া দাওয়া হয়। প্রতিদিনের মেনুতে পোলাউ, রোস্ট, ভেজিটেবল, সালাদ এসব কমন। খাবারের পর ডেজার্টের জন্য কেক, পেস্ট্রি এসব তো আছেই। এখানে একেকদিন একেকটা ফ্যামিলি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করে। কোনদিন তাই আরবী, কোনদিন আমেরিকান, কোনদিন বাংলাদেশি- এককথায় সব ধরনের ইফতারিই খেয়েছি। পরিবেশটাও বেশ সুন্দর- মসজিদের একটাই ঘর, ঠিক মাঝখানে কয়েকটা লম্বা টেবিলে খাবার সাজানো থাকে, ছেলেরা একপাশ থেকে আর মেয়েরা অন্য পাশ থেকে পছন্দ মত খাবার তুলে নিয়ে বুফে সিস্টেমে খাওয়া-দাওয়া করে। এভাবে সবাই একসাথে বসে খাবার মাঝে একটা আনন্দ আছে। এখানেই পরিচয় হলো বাংলাদেশী মুহাইমিন, পাকিস্তানী ওমর, ইন্ডিয়ান আলী, আফগানী শাহেদ, লেবাননের সামির, জামাইকার আবু বকর, আহমেদ সহ আরো অনেকের সাথে। মেয়েদের মাঝে শুধু ইজিপ্টের মেয়ে লুশেইনার নামটা মনে আছে। লুশেইনা সাইকোলজির ছাত্রী, মানুষের সাথে কথা বলে তাদের মনস্তত্ত্ব বোঝা তার হবি। আমাকে দেখে তার বোধহয় মানসিক রোগী মনে হয়, নচেৎ নিজে থেকে কোন রূপসী তরুণীর আমার সাথে কথা বলার আমি কোন কারণ দেখিনা। লুশেইনা ছাড়া পাকিস্তানী একটা মেয়ে ও সিরিয়ার একটা মেয়ে প্রায়ই আমাদের সাথে তানিয়া আপার গাড়িতে মসজিদ থেকে ইউনিভার্সিটি যাবার পথে লিফট নিত। এক সাথে এত যাওয়া আসা করলেও আফসোসের বিষয় যে, তাদের নামটাও কখনও জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আগামী রমজানের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আর কোন গত্যন্তর নেই।
প্রতিদিন যে এমন স্বাদের ইফতার কপালে জুটেছে তা নয়। হিসেব করে দেখা যাবে এবার বিচিত্র বিচিত্র জায়গায় ইফতার করতে হয়েছে। যেদিন এসিএম প্রোগ্রামিং কনটেস্ট এর মিটিং থাকত, সেদিন ইফতার করতে হতো ফ্রী পিৎজা দিয়ে। এখানে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার প্রতি কোন স্টুডেন্টেরই বিন্দুমাত্র কোন আকর্ষণ নেই। সবাই মূলত ফ্রী পিৎজা খেতেই আসে। আমি এখানে আসার পরই এসিএমের সাথে জড়িয়ে পড়ি। পরে দেখা গেল কাজটাতে বেশ লাভই হয়েছে। আমেরিকার "ফ্রী" পিৎজা গুলো আসলেই বেশ সুস্বাদু, টাকা দিয়ে খেতে এত্ত মজা লাগেনা। কোন কোন দিন আবার ইফতার করেছি শপিং মল গুলোতে। প্ল্যান ছিল শপিং শেষে মসজিদের ডিনারে যোগ দেব, কিন্তু আমেরিকার শপিং সেন্টার বলে কথা- একবার ঢুকলে শুধু পুরোটা একচক্কর ঘুরতেই দু'ঘন্টা পেরিয়ে যায়। এভাবে প্রায় বেশ কিছু উইক এন্ডে শপিং সেন্টারে ইফতার করতে হয়েছে- কোনদিন কেক, কোনদিন জাভালাঞ্চে, কোনদিন ফ্রাপাচিনো, আবার কোনদিন শুধু পানি খেয়ে। ফ্রাপাচিনোটা আমার খুব দারুণ লেগেছে। এটা একধরনের ঠান্ডা কফি, যেটার ভেতর আইসক্রীম, কফি, ফোম এই কি কি যেন থাকে। জিনিসটা এত ঠান্ডা যে, এক চুমুক খেলেই মাথার খুলি পুরোটা ঠান্ডায় জমে যায়। বিশ্বাস করানো মুশকিল, তবে বাংলাদেশে এটা বানানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের এটসেট্রার কফি ওয়ার্ল্ডে এর কাছাকছি একটা পানীয় পাওয়া যায়। সেটাকে ডীপ ফ্রিজে রেখে একমাস পর বের করে সাথে সাথে খেলে হয়ত ফ্রাপাচিনোর স্বাদ পাওয়া যেতে পারে।
রোজা কি জিনিস এটা এখানকার অনেকেই জানেনা। আমার বিচিত্র খাদ্যাভ্যাস তাদের অনেককেই তাই অবাক করেছে। আমার অফিসরুমে পাশের কিউবিকলে তাইওয়ানের একটা ছেলে বসে। ওর নাম 'চিহাউ'। আমার মতই সে একজন ফার্স্টইয়ার গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট। একই রুমে থাকায় তার সাথে আমার বেশ ভাব হয়ে গেছে। সে প্রায়ই আমাকে তার এ্যালগোরিদম কোর্সের নানান সমস্যা সমাধানের জন্য দেয়। চ্যালেঞ্জ রক্ষার্থে প্রায় প্রতিবারই কোন না কোন একটা সমাধান দিয়ে তাকে অবাক করে দিই। রোজার মাঝে একদিন দুপুর বারোটায় আমাকে সে বলল- নির্জন, চলো লাঞ্চ করে আসি। আমি বললাম, আমি আজকে যেতে পারছিনা। আমাকে সে ইতিমধ্যে একটু হলেও চিনে ফেলেছে। ফ্রী খাদ্য, অথচ আমি যেতে চাচ্ছিনা, এটা ওকে খুব অবাক করল। সে বুঝে উঠতে পারছিলনা, আমার কি হয়েছে। পরে বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হলো, 'আমি রোজা। আজকের দিনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু খাওয়া আমাদের ধর্মে নিষেধ আছে।' ওকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য এটাও যোগ করলাম, 'গোটা সেপ্টেম্বর মাসেই আমি দিনের বেলা কিছু খাব না।' সে অতি মাত্রায় অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'সারাদিন কি করে একটা মানুষ না খেয়ে থাকবে? আমি তো একবেলা না খেয়ে থাকলেই মরে যাব।' আমি তাকে বললাম, ' আমাদের দেশে কোটি কোটি মানুষ সারা বছরই না খেয়ে থাকে, এক মাস তো আমাদের জন্য কোন ব্যাপারই না।' সে যাবার সময় বলতে লাগল, 'সারা বছর? ভেরী ইন্টারেস্টিং- এটা কেমন রীতি? আমি পুরো কাহিনী তোমার কাছে শুনতে চাই।' ... সেদিন বেশ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসলাম। চিহাউ-এর এবারের প্রশ্নটা আমার জন্য বেশ কঠিন হয়ে গেছে। এর উত্তর যারা জানেন, তাদের জন্যও বোধহয় চিহাউকে বুঝিয়ে বলা বেশ শক্ত।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ১১:৫০