স্থানঃ আমেরিকায় নিজ গৃহে।
সময়ঃ ডিসেম্বর ১৩, গভীর রাত।
আগের একটি পর্বে লিখেছিলাম ‘তালগাছের আড়াই হাত’। লাইনটি লিখবার সময় বোধহয় ঈশ্বর মুচকি হেসেছিলেন, ‘আড়াই হাত কাহাকে বলে সেটা তোমাকে টের পাওয়াচ্ছি বাপধন।’
হংকং থেকে প্লেন ছাড়বার কথা ছিল বিকেল চারটেয়, সেটা ছাড়লো পাঁচটারও পরে। আমার গন্তব্য সানফ্রান্সিস্কো, সেখানে প্লেন বদলাতে হবে আমার শহরটিতে যাওয়ার জন্যে। তার জন্যে হাতে তিন ঘন্টা সময় রাখা ছিল, কিন্তু সেটা কমে এখন দাঁড়ালো দু ঘন্টায়।
আমি তাতে খুব বেশী দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হইনি। দুঘন্টায় প্লেন আগেও বদলেছি অনেকবার, ব্যাপার না।
পাইলট সাহেব অবশ্য বললেন যে পথে নাকি তিনি একটু টেনে প্লেন চালাবেন যাতে করে এই নষ্ট হওয়া ঘন্টার অন্ততঃ কিছুটা হলেও যেন উদ্ধার করা যায়। ভাল ভাল।
প্লেনের ভিতরে বসে অবশ্য প্লেন জোরে চলছে না আস্তে চলছে সেটা বোঝার কোন উপায় নেই। এতো আর গাড়ী না যে রাস্তার দুপাশের গাছপালার সরে যাওয়া দেখে গতি আন্দাজ করা যাবে। তার উপর বাইরে তখন অন্ধকার হয়ে আসছে।
সাধারণতঃ এজাতীয় ব্যাপার নিয়ে আমি খুব একটা দুশ্চিন্তাতাড়িত হইনা। প্রথমেই নিজেকে প্রশ্ন করি,‘এখানে কি আমার করবার মতো কিছু আছে?’ সে প্রশ্নের উত্তর যখন না-সূচক আসে, তখন গা এলিয়ে দেই। যা হবার হবে, তা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করে লাভটাই বা কি?
অতএব আমি প্লেনে আমার কাজ-টাজেই ব্যস্ত থাকি। খাতা দেখি ঘাড় গুঁজে, সামনের ছোট পর্দায় ‘গেট স্মার্ট’ ছবিটি দেখতে হেসে উঠি (খুব বেশীবার না), আর তা না হলে ল্যাপটপে দু লাইন লিখবার চেষ্টা করি।
এর মধ্যেই পাইলট সাহেবের বাণী ভেসে আসে ইন্টারকমে। প্লেনের সামনে আজকে নাকি একট শক্তিশালী হেড-উইন্ড রয়েছে, এবং তাতে করে খুব বেশি জোরে প্লেন চালানো যাচ্ছেনা। ফল হিসেবে সানফ্রান্সিস্কোতে খুব বেশী আগে যাওয়া যাবে না।
আমি এ ঘোষণায় কান দেইনে তেমন। ওহি হোতা হ্যায়, যো মোনযুরে খোদা হোতা হ্যায়।
পূব দিকে উড়ছি বলে রাতটি বড় ছোট্ট। দেখতে দেখতে সূর্যদেব আবার দেখা দেন আকাশে। টুথব্রাশ হাতে লোকেরা বাথরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দেয়। জুসের গেলাস হাতে দেখা দেয় বিমানসেবকেরা।
শেষমেশ ঘড়িতে যখন বেলা বারোটা (সানফ্রান্সিস্কো সময়) বাজে, তখন আবার ঘোষণা এলো যে আমরা প্যাসিফিক প্রায় পাড়ি দিয়ে ফেলেছি, এবং ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাবো। ভাল, খুব ভালো।
আরও পয়তাল্লিশ মিনিট পর ঘোষণা এলো,‘সানফ্রান্সিস্কো বিমানবন্দর ঘন মেঘ এবং কুয়াশা দিয়ে ঢাকা, তাই কোন প্লেনই নামতে পারছেনা। আর দশটা অবতরনইচ্ছু প্লেনের মতোন আমরাও বিমানবন্দরের উপরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আকাশ পরিষ্কার হলেই ঝুপ করে নেমে পড়বো।’
ঝুপ করে নেমে পড়ার আশায় আশায় কাটলো আরো মিনিট বিশেক। এর পর ঘোষণা আবারও,‘আমাদের প্লেনের জ্বালানী প্রায় শেষের দিকে। এইভাবে আমরা বেশীক্ষন উড়ে বেড়াতে পারবো না। তাই আমরা পাশের ওকল্যান্ড এয়ারপোর্টে নামছি, সেখানে তেল-টেল নিয়ে আবার আমরা ফিরে আসবো সান ফ্রান্সিস্কোতে। এবং তখন আমরা আর অনেকক্ষন ধরে আকাশে অপেক্ষা করতে পারবো।’
তাইই করা হোল। যাইহোক-শেষমেশ আমরা যখন সানফ্রানসিস্কোতে নামলাম, তখন ঘড়িতে বাজে তিনটে পনেরো। আমার কানেকটিং ফ্লাইটটি ততক্ষণে চলে গেছে। যাকগে-আমাকে তাহলে আর তাড়াহুড়া করতে হবে না।
ইমিগ্রশনের সামনে বেজায় লম্বা লাইন। সব সময়েই তাই হয়। আস্তে আস্তে কচ্ছপের গতিতে আমি এগোই। আমেরিকায় থাকবো, আর এই সব ঝামেলা সামলাবো না তা, কি করে হয়?
ইমিগ্রেশন অফিসারটি বেশ হাসিখুশি চেহারার। আমার সাথে বেশিক্ষন প্রশ্নোত্তর চালালেন না। হাতের ফর্মটিতে দ্রুত একটা সীল মেরে আমাকে চলে যেতে বললেন। যাক বাবা-পয়লা পুলসেরাত পার হ’লাম।
গেটের কাছে মুশকো চেহারা এক কালো আমেরিকান। সে আমার ফর্মটি দেখে হাত দিয়ে দেখালো হল ঘরের অন্যপ্রান্তকে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাই।
‘কেনরে বাবা, আবার কি হোল?’
‘তুমি এখন ওই কোনার ঘরটিতে যাবে। সেখানে তোমাকে এবং তোমার কাগজপত্রকে আবার চেক করা হবে।’
‘কেন? একবারতো চেক করাই হোল? আবার চেক করার কি দরকার?’
কালু ভাই আমার কথার কোন উত্তর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেনা। সে শুধু নীরবে আবার কোণের ঘরটির দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
মনে মনে গজরাতে গজরাতে আমি হাতের মোটাসোটা ব্যাগটিকে টানতে টানতে রওনা দেই। শালার আমেরিকার গুষ্টি কিলাই!
ঘরটি ছোট, কিন্তু লোকে পরিপূর্ণ। সবদেশীয় লোকই এখানে আছে। ভারতীয়, চৈনিক, জাপানী, সাদা, মেক্সিকান। প্রথমে আমার একটা ধারণা হয়েছিল যে মুসলিম নামের কারণেই আমাকে দ্বিতীয়বার চেক করা হবে।
কিন্তু এঘরে এসে বুঝলাম যে আসলে ব্যাপারটি বোধহয় তা নয়। ওরা বোধহয় গোটা যাত্রীদের মাঝখান থেকে কিছু লোককে তুলে এনেছে। আমাদের সবার মধ্যে কোন জিনিসটি সমস্যার ছিল, তা জানিনে। হয়তো কিছুই ছিলনা।
হাতের কাগজপত্র জমা দিয়ে বসে আছি চুপচাপ। জ্ঞানী মানুষেরা বলেন যে আমেরিকাতে চুপচাপ থাকাটাই ভাল, খামাখা গ্যাঞ্জাম করে এনাদের বিরক্ত করে কোন লাভ নেই।
কিছুক্ষণ পরে খেয়াল করলাম যে কোন কিছু ঘটছেনা, সবাই চুপচাপ বসে আছে। একটি ভারতীয় দম্পতির বাচ্চাটি কান্না জুড়ে দিল, কিছুক্ষণ পরে তাতে যোগ দিল একটি জাপানী শিশু। সবাই একটু উসখুস করছে। কিন্তু কেউ কোন উচ্চবাচ্য করছে না। ঘহরের এক কোণায় বড় বড় করে লেখা ‘হোমল্যান্ড সিকিউরিটি’। বাবারে-বাবা, ওদেরকে ঘাঁটাবে কে?
একসময় একটি সাদা ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। বোধহয় তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে ততক্ষণে। কাউন্টারের পুলিশী পোষাক পরে থাকা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন যে এত দেরী হবার কারণটি। তার কথা শুনে মনে হোল ভদ্রলোক ইউরোপীয় বংশউদ্ভুত।
কাউন্টারের লোকটি একটু আমতা আমতা করে জবাব দিল,‘আমাদের কম্পিউটরটি বর্তমানে ডাউন আছে। তাই আমরা কিছু করতে পারছিনা।’
‘তো তোমাদের ব্যাকআপ সিস্টেমটা ইউজ করছো না কেন?’
সে তখন আরো আমতা আমতা করে বললো,‘আমাদের আসলে কোন ব্যাক আপ সিষ্টেম নেই।’
সাদা ভদ্রলোক রাগে গরগর করে ওঠেন,‘হোয়াট? এত পয়সা খরচ করে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট খোলা হোল, এখন তাতে কোন ব্যাক আপ সিস্টেম নেই। এইই হচ্ছে আমাদের সিকিউরিটি সিস্টেম?’
কাউন্টারের লোকটি ম্লান হাসে শুধু।
আমি এসব কথায় খুব একটা কান দেইনা। ওহি হোতা হ্যায়, যো মনযুরে খোদা হোতা হ্যায়!
ঘন্টা দুয়েক পরে আমার ডাক আসে। গুটিগুটি পায়ে গেলাম কাউন্টারে। কি অপরাধ আমার?
কিছুই না, নীরবে আমার পাসপোর্ট আর অন্যান্য কাগজপত্র আমার হাতে তুলে দেওয়া হোল। ‘ওয়েলকাম টু দ্য ইউ এস এ।’
ওয়েলকামের গুষ্টি কিলাই!
ব্যাস-এখানেই গল্প শেষ! তারপর ঘরে ফিরেছি অনেক রাতে। সবাই দেখি জেগে আছে আমার জন্যে। হাতের মাল-সামান নামিয়ে আমি সোফায় গা এলিয়ে দেই। ওফ- গত কয়দিন যা গেলো আমার উপর দিয়ে।
এখনো জেটল্যাগ কাটেনি। ঘুমুচ্ছি অসময়ে, জেগে উঠছি গভীর রাতে।
এখন আমাদের এখানে রাত দেড়টা বাজে। বাইরে বরফ পড়ছে ঝুরঝুর করে। রেডিওতে বলছে তাপমাত্রা শূন্যের নীচে নেমে যাবে আজকে রাতে। কাল সকালে খুব দরকার না পড়লে রাস্তায় যেন না বেরুই।
ভাগ্য ভাল কাল রবিবার।