স্থানঃ প্লেনের ভিতর, প্যাসিফিকের উপরে কোথাও।
সময়ঃ এইতো পড়লাম ঝামেলায়, বাইরে রাত এটুকুই শুধু জানি।
প্রায় আড়াই ঘন্টা হয়েছে আমরা উড়ছি। এর মধ্যে একপ্রস্থ খাওয়া হয়ে গিয়েছে। এবারের খাবারটি তেমনটি সুবিধের ছিলনা, কিন্তু কি আর করা? প্লেনের ভিতর যা দেয় তাইই বিনা প্রশ্নে খেয়ে নেওয়া উচিৎ। তবে আমি একেবারে নিরস্ত্র নই। সাথের হাতব্যাগে এক প্যাকেট বোম্বে চানাচুর আছে। যদি অবস্থা খারাপ হয়, সেটাই খেয়ে নেবো।
যাত্রা শুরুর আগে এক বন্ধু উপদেশ দিয়েছিল যাওয়ার আগের রাতে না ঘুমোতে। তাহলে নাকি প্লেনের ভিতর ঘুমটা ভাল হয়। সেই উপদেশ মেনে গোটা পথটিই ঘুমোতে ঘুমোতে এসেছিলাম। এখন ফেরার সময়ে নিয়েছি ভিন্ন তরিকা। যেহেতু প্রতিবারেই আমেরিকায় ফিরবার পরে কমপক্ষে সাতদিন জেটল্যাগের ধকল থাকে, এবারে চিন্তা করেছি যে প্লেনে একদম ঘুমোবো না। দেখি কি হয়। দেখি এভাবে জেটল্যাগের ঝামেলাকে পোষ মানানো যায় কিনা।
প্ল্যান ছিল খাতা দেখার। কিন্তু সেটা করতে ইচ্ছে করছে না। ভাবছি একটু লিখি। আজকাল লিখবার সময় তো একদমই বলতে গেলে পাইনে। যদিও এই লেখাও লেখাও যা, না লেখাও তাই। লিখেও আমার কোন খ্যাতিবৃদ্ধি হচ্ছে না, আর পড়েও পাঠকের কোন বিশেষ জ্ঞানবৃদ্ধি হচ্ছেনা। সময় নষ্ট দু দিকেই। তবে ঘুমকে এড়ানোর জন্যে কিছু একটাতো করা দরকার। তাইই এই কী-বোর্ডের ঠকঠকানী।
প্লেনটি বোয়িং ৭৪৭ সিরিজের, কিন্তু এখানে একটি নতুন জিনিস খেয়াল করলাম। প্রতিটি আসনের সাথে ইলেক্ট্রিক আউটলেট আছে। অতএব ব্যাটারী পাওয়ার ফুরিয়ে গেলেও ভয় নেই। সেটাও একটা কারণ যে নির্ভয়ে লিখছি।
বাঙ্গালী চিরটা কাল মালপত্র বইতে বইতে জীবন কাটিয়ে দিল। আমাদেরও একই অবস্থা হয় প্রতিবার। কিন্তু এবারে যেহেতু আমি একা, তাও শতচেষ্টা করেও মালপত্রের পরিমানটি কমাতে পারলাম না। আসবার সময়ে স্ত্রী একটি লিস্টতো ধরিয়ে দিয়েছিলই, তার উপর নানান জনে আরো জিনিস গছিয়েছে। পারলে গোটা বাংলাদেশটিকেই উঠিয়ে আনতাম।
হাতের ব্যাগে রয়েছে নানান ধরনের জিনিস। আছে ইলেক্ট্রিক তানপুরা, আছে চার রকমের মিস্টি, আছে খুব ভাল কোয়ালিটির চার কেজি খেজুরের গুড়। এর সাথে আছে ল্যাপটপ, আছে পরীক্ষার খাতা, আছে মেয়েটির জন্যে তার নানীর দেওয়া হাতের ব্রেসলেট। চানাচুরের কথা তো বলেছিই। এখানেই শেষ নয়, আছে ক্যামেরা, আছে ওষুধপত্র। বলাই বাহুল্য, এদের ভারে আমার কাঁধ আর হাত দুটো প্রায় ছিঁড়ে যাবার জোগাড়।
এবারে একটু দেশের কথা বলি। চলে আসার ঠিক আগের দিনে সন্ধ্যেবেলা হীরা সাহেব ফোন দিলেন। ‘কিরে তোর কি অবস্থা?’
‘বিদেশযাত্রার আগের রাতে অবস্থা যেমন হয় তেমন। করুণ।’
‘শোন, তোর সাথে একটু দেখা করা দরকার। কখন সময় হবে তোর?’
‘আমার সময় তো নেই বললেই চলে। কি দরকার বল।’
‘কালকে তুই সাজিয়ার বই নেবার কথা বলেছিলি। সে কখানা বই আমার হাতে দিয়ে বলেছে যে এগুলো যেন তোর হাতে পৌছে দেওয়া হয়। আমার সন্ধ্যেবেলা ক্লাশ আছে, রাত ন’টায় সেটা শেষ হবে। তার পর তোর ওখানে আসি? তুই তো আর আসতে পারবিনে।’
‘শুধু বই দেবার জন্যে এতটা পথ আসবি? তারচেয়ে এক কাজ কর, ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দে। আমি না থাকলেও পরে পেয়ে যাবো।’
‘না আমিই আসবো। সাড়ে ন’টার দিকে আসি?’
‘তুই আসার জন্যে এত বায়না ধরছিস কেন? বইটা ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দে। খামাখা রাত-বিরেতে ঝামেলা করিস না।’
কিছুক্ষণ চুপ করে হীরা বললো,‘তোর সাথে বসে সেদিন ভাল করে গল্প করা হয়নি। আরো কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তোর যদি অসুবিধে থাকে তাহলে অবশ্য অন্য কথা।’
কথাটি মাথার ভিতরে আঘাত করে। শেষ কবে কেউ এত আগ্রহ করে শুধু আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে, তা মনে পড়েনা। আমরা সবাই ব্যস্ত, কিন্তু শত ব্যস্ততার মাঝেও একজন অতিব্যস্ত মানুষ তার ক্লান্তিময় দিনের শেষে এতটা পথ আসবে শুধু আমার সাথে দু দন্ড সময় কাটাবার জন্যে।
সুটকেস গোছাতে গোছাতে ফোনে কথা বলছিলাম। আমি উঠে দাঁড়াই সুটকেস ফেলে। জাহান্নমে যাক কাজ, জাহান্নমে যাক বাক্স-প্যাঁটরা বাঁধা।
হীরাকে বললাম,‘তুই আয়। যখন খুশী। আমারও তোরা সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।’
রাত দশটায় বেশীর ভাগ দোকানপাটই বন্ধ হয়ে যায়। বোধহয় ঈদ কাছাকাছি বলে কিছু দোকান খোলা। একটি কফিশপে গিয়ে বসি আমরা। কি এমন জরূরী কথা ছিল আমাদের। কিছুই না। সেই পুরনো দিনের একই কথা। বুঝি বয়েস বাড়ছে আমাদের। স্মৃতিতে আজকাল অনেককিছুই আর ভালকরে ধরা দেয়না। দুজনে দুজনের শূন্যস্থান পূরণ করে চলি ক্রমাগত। মনের ভিতরে খাপছাড়া গল্পগুলো পূর্ণতা পায় অবশেষে।
গল্প করতে করতে যখন উঁচু গলায় হেসে উঠি, তখন নিজেই অবাক হয়ে যাই। শেষবার এমনভাবে হেসেছিলাম কবে? মনে নেই।
এরই মাঝে সাজিয়া ফোন করলো একবার। ‘অ্যাল কাপোন ভাই-আপনার লেখাগুলো পড়েছি। এতসব গল্প বানালেন কিভাবে?’
‘আমি কোথায় গল্প বানালাম সাজিয়া? আর ওগুলো যে আমার লেখা তাইই বা তোমাকে কে বললো? ওগুলো লিখেছেন নির্বাসিত নামের একজন। সে আমি নই। আর তাছাড়া গল্প বানাবে তো তুমি। তুমি হচ্ছো গিয়ে বোনাফায়েড রাইটার।’
‘বাজে কথা বাদ দেন। এবারে আমাদের বাসায় এলেন না। আপনার সাথে দেখা হোলনা।’
’পরের বার সাজিয়া, পরের বার।’
এবারে বাংলাদেশে একটা জিনিসের অভাব বোধ করেছি নিয়মিত। তা হচ্ছে ভাল ব্রডব্যান্ডের অভাব। সব জায়গাতেই একই অবস্থা। এই কারণে আর ইন্টারনেটে যেতেও ইচ্ছে হয়নি খুব একটা। তবে ভাল হাইস্পীড ইন্টারনেট পেয়েছিলাম হোটেল শেরাটনে। সেখানে ব্রাউজিং করাটাকে উপভোগ করেছি রীতিমতো। তার মানে হচ্ছে যে সিস্টেমটি আছে, শুধু সবখানে পাওয়া যায় না।