স্থানঃ হংকং এয়ারপোর্ট
সময়ঃ ডিসেম্বর ৭, দুপুর দুটো।
রিকশা থেকে আই বি এ র সামনে নামতেই হইহই করে হীরা এগিয়ে এলো।
‘এটা তোর আসবার সময় হোল? আসবার কথা ছিল দশটায়, আর এখন বাজে প্রায় এগারোটা। সাড়ে বারোটায় আমার একটা মিটিং আছে।’
আচানক এমন তরো আক্রমনে আমি ঘাবড়ে যাই। কালকে কথা হয়েছিল, যে সকালের দিকে আমরা ক’জন হীরার ওখানে যাবো, তারপর কিঞ্চিত গল্প-গুজব হবে। ঢাকার অতিস্বল্প অবস্থানের ফলে হাতে আমার সময় এমনিতেই কম, তার উপর ঢাকার ট্র্যাফিক জ্যামের কথা ভুক্তভোগীরা তো জানেনই।
নাহয় আমার একটু দেরী হোলই বা। তাই বলে মিটিং এর কথা বলে আমাকে শাসানো!
‘কি সবাই কি এসে গেছে নাকি?’
‘আর কে কে আসবে তা নিয়ে তো আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। আমি সেই সাড়ে নয়টা থেকে তোর জন্যে বসে আছি। কতকাল তোর সাথে বসে কথা বলা হয়নি।’
‘আমার আর নতুন কথা কি? সেই পুরনো কাসুন্দী, একই চাকরি, একই সংসার, একই রকম সবকিছু।’
‘চল আমার অফিসে চল। সেখানে গিয়ে তোকে ধোলাই দেবো।’
হীরা সাহেব এখন একটা নতুন প্রোগ্রামের কর্ণধার। চারতলাতে অফিস। কিন্তু সেখানে আমরা ঢুকলাম না।
‘চল, আমার বিশ্রামের ঘরে গিয়ে বসি।’
‘তোর আবার বিশ্রামের ঘর আছে নাকি?’
‘আছে আছে, আরো অনেক কিছুর ঘরই আছে হে।’
‘শালা বিহারী, তোকে সেই একাত্তর সালেই ঝেঁটিয়ে বার করা দরকার ছিল।’
হীরা হাসে।
কিছুক্ষন পরে আরো কয়েকজনে জমায়েত হয়। সিংগাপুর থেকে আসা ইফতিখার, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের আমলা সজীব, কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারী করা কবীর আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোয়ার। তারা গোল হয়ে আমাকে ঘিরে ধরে।
‘তোর আজকে খবর আছে। ডুবে ডুবে পানি খাও, না?’
‘আমি আবার কি করলাম?’
‘ও-তুমি এখন ভাজা মাছটাও উলটে খেতে পারোনা, তাই না?’
‘ভাইরে-আমি মাছই খাইনে। বিশ্বাস না হয়, আমার বৌকে জিজ্ঞেস কর।’
হীরা গম্ভীর গলায় বলে,‘চুপ করে বস। আমাদের কাছে পাকা খবর আছে। তুই আগড়ম বাগড়ম বকলেও কোন লাভ নেই।’
‘আরে ভাই-ব্যাপারটা কি তাইই তো এখনো পর্যন্ত জানলাম না।’
‘শোন, তুই নাকি ইন্টারনেটে কি কি সব লিখে বেড়াচ্ছিস আমাদের নামে?’
আমি আচানক বিষম খাই। কাশতে কাশতে বলি, ‘কি সব বাজে বকছিস? আমি আবার লিখলাম কোথায়?’
‘তুমি নিজেকে বড় চালাক ভাবো, তাই না? ভেবেছ নিজের নাম, আর আমাদের নাম বদলে দিলেই কেউ আর কোনকিছু টের পাবেনা।’
বুঝলাম অস্বীকার করে তেমন কোন লাভ নেই, বরঞ্চ চোট দেখানোই ভাল।
বুক ফুলিয়ে বললাম,‘হ্যাঁ লিখেছি তো কি হয়েছে। লেখকের স্বাধীনতায় তোরা হস্তক্ষেপ করবি নাকি? আমি আমার যা ইচ্ছে তাই লিখবো। তোদের আসল নামতো আর ব্যবহার করিনি। তোদের সমস্যা কোথায়?’
‘সমস্যা এখনো হয়নি, কিন্তু হ’তে কতক্ষণ?’
‘কি সমস্যা?’
‘মানলাম তুই এখনো পর্যন্ত আমাদের নামে খারাপ কিছু লিখিসনি, কিন্তু লিখতে কতক্ষণ? কোথায় কি কি অপকর্ম করেছি, তা তো তোর সবই জানা। কি লিখতে আবার কি লিখে দিবি, তখন হবে মহা ঝামেলা।’
আমি এবারে হাসি। ‘আরে সেটাই তো আমার প্ল্যান। লোকে লিখে পয়সা কামায়, আর আমি না লিখে কামাবো।’
‘তার মানে?’
‘মানে হচ্ছে এই যে তোরা তোদের কথা না লেখার জন্যে আমাকে পয়সা দিবি। খুবই সাধারণ ব্যাপার।’
‘আমাদের প্ল্যান হচ্ছে আমাদের নামে কোনকিছু আজেবাজে লিখলে আমরা তোকে ধোলাই দেবো। এটাও খুব সাধারণ ব্যাপার।’
আমি আর কথা বাড়াইনে। এই বয়সে ধোলাই খাওয়াটা পোষাবে না।
দুপুরে জম্পেশ খাওয়া হোল। আই বি এ র চারতলাতে একটি চমৎকার ঘর আছে, চারদিকে কাঁচ দিয়ে ঘেরা। পাশের গাছটি যখন বাতাসে দুলে ওঠে, তখন দৃষ্টিবিভ্রম হয়। মনে হয় যেন আমরাই দুলছি।
খাওয়ার পর হীরা চুপিচুপি একটা খবর দিল। ‘তোকে বলা হয়নি, সাজিয়ার কয়েকটা বই বার হয়েছে।’ সাজিয়া হীরার স্ত্রী।
’বলিস কি? এতো দারুন খবর। এতক্ষণ চেপে ছিলি উল্লুক!’
‘বাচ্চাদের বই দোস্ত।’
‘বইয়ের আবার বাচ্চা-বুড়ো কি? বইগুলো কিনতে চাই।’
‘ঠিক আছে, সাজিয়াকে বলে দেখবো।’
‘এতে আবার বলাবলির কি আছে? কোন দোকানে পাওয়া যায় বল, আমি কিনে নেবো।’
‘এসব জিনিস সাজিয়া জানে। আমি ওকে রাতের বেলা জিজ্ঞাসিব।’
‘বিহারীর মুখে শুদ্ধ বাংলা! কলিকালে কত কিই যে দেখবো।’
হাতে এত কম সময়। কার সাথে দেখা করবো ভেবে পাইনে। অমুক ফুপু, না তমুক চাচা, না চাচাশ্বশুর? সময় ভাগ করতে করতে ঘেমে উঠি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সময়ের অংশটুকু নিয়ে নেয় যাতায়াত। ঢাকাতে পয়েন্ট এ থেকে পয়েন্ট বি তে যেতে অনেকক্ষন সময় লাগে।
হঠাৎ করে মনে পড়লো শফিক স্যারের (নির্বাসিতের আপনজন, পর্ব-১৩) কথা। ভেবেছিলাম বিভাগীয় রিইউনিয়নে স্যারের সাথে দেখা হবে। কিন্তু স্যার সেখানে আসেননি। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম স্যারের কথা। তারা ভাল করে বলতে পারলো না।
এক রোদেলা দুপুরে তাই আমি স্যারের আস্তানায় হানা দিলাম।
স্যার যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন। সেই পরিচিত হাসিমুখ, সেই চিরতরুণ মুখখানি। মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মাথার চুল পাতলা হয়ে আসা জায়গাটিতে আনমনে হাত বুলাই। আল্লাহ যারে দেয়----।
পা ছুঁয়ে সালাম করতে স্যার বুকে জড়িয়ে ধরেন। ‘তুমি আসাতে খুব খুশী হয়েছি আমি।’
সোফাতে বসতে না বসতেই স্যার বলেন, ‘কি খাবে? কফি?’
আকেলমন্দ কে লিয়ে ইশারাই কাফি। স্যারের ইংগিত পূর্ণ প্রশ্নে সাথে সাথেই উঠে দাঁড়াই। ‘জ্বি স্যার কফিই খাই তাহলে।’
স্যার হাসেন।‘তোমার মনে আছে তাহলে।’
আমিও হাসি। ‘ওই কফির কথা কি আর ভোলা যায়?’
স্যার ফç্যাটের দরজায় তালা লাগান। ‘চলো তাহলে।’
আবারো শরীরে ঢাকার রোদ, শব্দ আর গন্ধ মেখে আমরা পথ হাঁটি। গন্তব্য আজিজ সুপার মার্কেটের একটিই বিশেষ দোকান। স্যার হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে চলেন। কতকিছু নিয়ে কথা বলেন স্যার। আমেরিকান রাজনীতি, ইকনমি, দেশের কথা, বিজ্ঞানের কথা, ছাত্র আর শিক্ষকদের কথা। সবকিছুতেই স্যার কি সাংঘাতিক পরিমানে আশাবাদী।
’জানো নারায়ণগঞ্জে তৈরী করা জাহাজ আজকে আমরা নরওয়েতে রফতানী করছি। ভাবতে পারো?’
আমি স্যারের কথা শুনিনা ভাল করে, শুধু তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। কি আশ্চর্য্য রকমের প্রাণবান একজন মানুষ।
সেই দোকানটিতে আবার আমরা গিয়ে বসি। স্যার শুধু ইংগিত করেন। এসে যায় ভেজানো চিঁড়ে, দই-কলার অপূর্ব খাবারটি।
খেতে বসে ফাজলামো করি, ‘স্যার-গতবার যে বলেছিলেন এখানে কোথায় নাকি ত্রিশ টাকায় খিচুড়ী পাওয়া যায়? সেটার কি অবস্থা?’
স্যার উৎসাহিত হয়ে নড়েচড়ে বসেন। ‘তুমি যদি বিকেলের দিকে আসতে তাহলে তোমাকে আরো একটা ভাল জিনিস খাওয়াতাম। লুচি আর শব্জী। খেয়ে তুমি পাগল হয়ে যেতে।’
‘নেক্সট টাইম, স্যার।’
‘পরের বার কিন্তু ফ্যামিলিকে নিয়ে আসবে। তোমাদের সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করে।’
এমন মায়া দিয়ে কথা বলেন উনি, যে চোখে পানি এসে যায়।
বিদায় নেবার সময় স্যার আবার বুকে জড়িয়ে ধরেন। ‘ভালো থেকো তোমরা সবাই। আমেরিকার ইকোনমির অবস্থা ভাল নয়। তোমরা যারা ওখানে আছো, তাদের জন্যে মাঝেমাঝেই বড় দুশ্চিন্তা হয়। আমার ছেলেটিও আছে সেখানে।’
‘একবার চলে আসেন স্যার। আপনাকে ওখানে দেখতে আমাদেরও বড় ইচ্ছে করে।’
স্যার সেকথার কোন জবাব দেননা। শুধু হাসেন।
(এতক্ষন ধরে হংকং এয়ারপোর্টে বসে আছি। একটি ছোট টেবিলের উপর পা তুলে ল্যাপটপে টাইপ করছিলাম। টেবিলের উপর চাইনিজ ভাষায় কি যেন লেখা। কি অর্থ কে জানে। একবার পা নামাবার সময়ে দেখলাম যে চাইনিজ লেখাটির ইংরেজী অনুবাদ পাশেই দেয়া আছে। এতক্ষন পায়ের আড়ালে ঢাকা পড়েছিল। বাংলায় অনুবাদ করলে তার অর্থ হয়, ‘দয়া করে টেবিলের উপর পা তুলিবেন না’।
আমি মনে মনে হাসলাম। ওই লেখা দিয়ে যদি আয়েশী বাঙ্গালীকে কব্জা করা যেতো, তাহলে তো হোতই।
পরের প্লেনের সময় হয়ে আসছে। উড়তে হবে বারো-তেরো ঘন্টা। ভাল থাকুন সবাই।)