স্থানঃ প্লেনের ভিতর।
সময়ঃ রাত দশটা-এগারোটা কিছু একটা হবে।
আবার প্লেন চলছে। শেষ অংশটুকু। ছেলেবেলায় একটা কথা শুনতাম বড়দের মুখে, ‘তাল গাছের আড়াই হাত’। এর মানে হচ্ছে তাল গাছের শেষ আড়াই হাত ওঠা বেশ কষ্টের। আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। আর মাত্র ঘন্টাদেড়েক বাকী ঢাকা পৌছুতে। ততক্ষণ কোনমতে টিকে থাকা আর কি?
হংকং এয়ারপোর্টের একটা ঘটনা বলি তার চেয়ে।
আমি চুপচাপ বসে টাইপ করছি। পাশে একটি বাঙ্গালী দম্পতি, সাথে ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে। সে এদিক সেদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। বাবাটি বললেন যে তিনি একটু বাথরুমে যাচ্ছেন। তার ফিরে আসতে একটু দেরী হল। সব মিলিয়ে মিনিট দশেক হবে হয়তো। এর মধ্যে বাচ্চা মেয়েটি বার দুয়েক প্রশ্ন করেছে, ‘আব্বু কোথায়?’
মহিলাটি প্রতিবারই একই উত্তর দিয়েছেন,‘বলেছি না আব্বুকে আব্বু বলে ডাকবে না, বলবে বাপি। আর তুমি কি কিছু খাবে?’
বাচ্চা মেয়েটি মাথা নাড়ে। সে খাবেনা, তার দৌড়ে বেড়ানোতেই মন বেশী। এতক্ষন প্লেনে আটকা থেকে সে বেচারী নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে।
ভদ্রলোক ফিরে আসতেই দুম করে যেন একটা বিস্ফোরন ঘটলো।
‘কি ব্যাপার, তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? সারাক্ষন খালি ঘোরাঘুরি করো কেন এত? আমাদের সাথে বসতে ভাল লাগে না?’
ভদ্রলোক আমতা আমতা করেন,‘ঘোরাঘুরি করলাম কোথায়? তোমাকে না বলে গেলাম যে আমি বাথরুমে যাচ্ছি।’
‘বাথরুমে এতক্ষন? কি করো তুমি বাথরুমে?’
মনেমনে আমি প্রমাদ গুনলাম। বাথরুমে বসে একজন কি করে, তারও হিসেব-কিতেব দিতে হচ্ছে নাকি আজকাল?
ভদ্রলোক বলেন,‘না মানে বাথরুম থেকে বেরিয়ে একটু সিগারেট খাচ্ছিলাম আর কি।’
‘আবার সিগারেট? কিন্তু সিগারেট খাওয়ার ঘরটাতো এই এদিকে। সেখানে তো তোমাকে দেখলাম না আমি।’
‘বাথরুমের পাশে আর একটা ঘর আছে। সেখানে বসে সিগারেট খাচ্ছিলাম।’
‘সিগারেট খেতে এতক্ষণ লাগে? কয়টা সিগারেট খেয়েছো? দশটা?’
‘কি সব আজগুবী কথা বলো? দশটা সিগারেট কেউ একবারে খায় নাকি?’
‘একটা সিগারেট খেতে তো এতক্ষণ সময় লাগার কথা না।’
‘ওই ওখানে দেখা হোল একজনের সাথে। তার সাথে একটু কথা-টথা বলছিলাম আরকি।’
‘এই কথাটা প্রথমেই পরিষ্কার করে বললে কি হয়? তোমার কাছ থেকে কথা বের করা আর নারকেল ভেঙ্গে শাঁস বের করার মধ্যে কোন তফাত নেই।’
‘সমস্যাটা কি আমাকে একটু খুলে বলবে প্লিজ। এমন খটখট করে কথা বলছো কেন?’
মহিলার মুখভঙ্গি এবারে বদলে যায়। তিনি এবারে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন,‘ঘটনা কি জানতে চাও? ঠিক আছে, তাহলে শোন। তুমি যে এখানে এই বিদেশ-বিভুই এসে বৌ-বাচ্চাকে ফেলে রেখে কার না কার সাথে বসে একসাথে বিড়ি-সিগারেট ফুঁকছো, এই জিনিসটা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছেনা। এদিকে তোমার মেয়েটি পানি খাবে বলে ছটফট করছে।’
‘তা তুমি ওকে পানি দিলেনা কেন? ব্যাগের ভিতরে পানির বোতল তো আছেই।’ ভদ্রলোক অবাক হন।
‘আমার হাতে পানি খেলেতো হতোই। উনি তার আব্বুরর কাছে ছাড়া অন্য কারো কাছে পানি খাবেন না।’
ছোট্ট মেয়েটি এই সময়ে খুট করে ভুল ধরিয়ে দেয়। ‘বলেছি না, আব্বু কে আব্বু বলে ডাকবে না। বাপি বলবে।’
মহিলাটি সে কথায় বাচ্চাটিকে একটি প্রবল ধমক দেন। ‘একদম চুপ। যেমন বাপ, তেমন মেয়ে।’
আমার মনটি খারাপ হয়ে যায়। কেন আমরা সবাই এত তুচ্ছ কারণে এত বেশী খ্যাচম্যাচ করি? কি দরকার ছিল মহিলাটির খামাখা মিথ্যে কথা বলার। আমি তো দেখেছি বাচ্চাটি একবারও পানি খেতে চায়নি।
স্থানঃ ঢাকা।
তারিখঃ নভেম্বর ২৮
সময়ঃ সকাল সাতটা।
সকালে ঘুম ভেঙেছে সূর্য্য ওঠার আগেই। চুপচাপ জানালায় বসে দেখছিলাম বাইরের গাছপালা, সকালে হাঁটতে বেরোনো মানুষদের।
গতকাল প্লেনে ল্যাপটপের ব্যাটারী ফুরিয়ে গেছিল। তাই অত বেশী কিছু লেখা যায়নি। যাই হোক- ভাল ভাবেই দেশে নেমেছি গত রাতে। কালকে কাস্টমস পার হবার সময়ে একটা জিনিস খেয়াল করলাম। হাতের ফর্মটি জমা নিচ্ছিলেন একজন কর্মকর্তা। তার পাশে একটি বড় স্ক্যানার যন্ত্র। বেরুবার আগে সবাইকে ওটার ভিতর দিয়ে মালামাল পরীক্ষা করতে হবে, যদি কোন ট্যাক্সেবল জিনিসের কর ফাঁকি দিয়ে কেউ চলে যায়, তাহলে তাকে ধরে ফেলা হবে।
আমার ফর্মটি নেবার সময়ে কর্মকর্তা টি বললেন,‘আপনি কোথা থেকে আসছেন?’
যখন শুনলেন যে আমি আমেরিকা থেকে আসছি, তখন উনি একটু হেসে হাতের ইশারায় আমাকে চলে যেতে বললেন। আমি খালাশ, আমার মালসামান স্ক্যান করার কোন দরকার নেই। আমি খুশী হয়ে চলে গেলাম। ভাবলাম উনি নিশ্চয়ই আমাকে দেখে ভেবে নিয়েছেন আমি একজন সৎ লোক, ডিক্লেয়ার না করে মাল-পত্র আনবার লোক আমি নই। আর উপর যখন শুনলেন আমি আমেরিকা থেকে আসছি, তখন নিশ্চয়ই ভেবেছেন যে ওখানে থাকা লোকেরা ভাল লোক, ট্যাক্স ফাঁকি দেবেনা।
মনে মনে নিজের উপর বেশ খুশী হয়ে উঠেছিলাম। ভদ্রলোকের উপরও। যাক-সৎ মানুষের মূল্য তাহলে এখনও দেওয়া হয়।
দু কদম হাটঁবার পর আস্তে আস্তে ধারণাটি বদলাতে শুরু করলো। তখন মনে হোল, কারণটি বোধহয় অন্য। ভদ্রলোক আমেরিকা শুনেই নিশ্চয়ই মনে মনে বলেছেন, ভাই, থাকেনতো আমেরিকায়। ট্যাক্স আর অন্য জিনিসের খরচা মেটাতে মেটাতে আপনার জীবন যে কালি কালি, সেতো আমরা জানিইই। তার উপর এখন ওখানকার অর্থনৈতিক অবস্থার যে কথা শুনি তাতে সুটকেস ভর্তি করে টন-টন সোনা-রূপো আনবার মতো অবস্থায় আপনি নেই। যান-ভাই, আমরা জানিই আপনার সুটকেসে কি আছে। আছে ওয়াল মার্ট আর টার্গেট থেকে কেনা শার্ট-প্যান্ট (মেড-ইন বাংলাদেশ), আছে দুটো সস্তা পারফিউম, আছে সের দরে কেনা হ্যালুয়িন ক্যান্ডি (যা কিনা হ্যালুয়িনের পরের দিন পানির দরে বিকোয়)।
দু মিনিট আগের খুশী খুশী মনটাতে এবারে রাগের বন্যা বয়ে যায়। একবার ভাবলাম, ফিরে যাই। গিয়ে ভদ্রলোককে বলি,‘শুনুন, আমি হ্যালুয়িনের পরের দিন ক্যান্ডি কিনিনা। যদি বিশ্বাস না হয়, আপনি আমার সুটকেস চেক করে দেখতে পারেন।’
পরক্ষণেই নিজের চিন্তায় নিজেই হেসে ফেললাম। কি সব আগডুম-বা¦ডুম চিন্তা করছি! বুঝলাম, বয়েস হচ্ছে। সাথে সাথে আরো বুঝলাম যে আমেরিকায় রেখে আসা পরিবারের লোকদেরকে মিস করছি। ওরা সাথে থাকলে আরো অনেক বেশী ভাল লাগতো। একা একা দেশে আসাটা কেমন যেন পানসে, আর বিবর্ণ! বুঝলাম সংসারের শিকড় চলে গেছে অনেকখানি ভিতরে।
তারিখঃ ১লা ডিসেম্বর
স্থানঃ ঢাকা
মাঝখানে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল। ঘটনাবহুল। ভ্রমনবহুল। মানুষবহুল।
২৯ তারিখে ছিল আমাদের বিভাগের পঞ্চাশ-বছর পূর্তি আর রিইঊনিয়ন। ভোরবেলা গেলাম চীন-মৈত্রী মিলনায়তনে। সেখানেই হবে সবকিছু।
শুরুতেই দেখা হোল একজনের সাথে। প্রায় পচিশ বছর পর। যদিও সে আমেরিকাতেই থাকে কিন্তু আমাদের ভিতরে যোজন যোজন দূর এর ফারাক। মাঝেসাঝে ই-মেইল বিনিময় হয় বটে, কিন্তু সামনাসামনি বসে কথা বলা, কারণে অকারনে ঘর ফাটিয়ে হেসে ওঠা হয়নি কতকাল।
দেখা হলে মুহুর্তে ফিরে পাই সেই পুরনো দিনগুলোকে।
‘কি রে, তোর চুল-টুলের একি অবস্থা।’
‘আমার চুল নিয়ে তোর এত চিন্তা কেন? হেয়ার কাটিং এর দোকান খুলেছিস নাকি?’
‘তোর মতো এত কম চুলওয়ালা খদ্দের আরো ক’টা পেলে এতদিনে দোকান খুলে দিতাম। ঘন্টায় তোদের মতো পনেরো জনকে নামিয়ে দেয়া কোন ঘটনা না।’
‘সেটা আমার আগে থেকেই বোঝা উচিত ছিল যে পয়সা কামানো শিখতে গিয়ে তুই আরো অনেককিছু কামানোই শিখে গেছিস।’
দুজনেই হা হা করে হাসি। আশপাশের জুনিয়র ছেলেমেয়েরা কি আমাদের কথা শুনতে পেয়েছে? লজ্জার ব্যাপার তাহলে।
‘তুই কবে এলি?’
‘আমি এসেছি গত পরশু। তুই?’
‘আমি এসেছি চার দিন আগে, অবশ্য চলে যাবো আগামী কাল রাতে।’
‘এত জলদী?’
‘ক্লাস চলছে, থাকি কিভাবে?’
‘বুঝি। আমিও আজকাল সন্ধ্যেবেলা পড়ানো শুরু করেছি। আমার একই সমস্যা, তবে আমার একটা কনফারেনস আছে তিন-চারদিন পর। সেটা শেষ করে তারপর যাবো।’
‘তুইও পড়ানো শুরু করেছিস? খুব ভাল। মনে আছে যেদিন আমি আর তুই এখানে একসাথে মাস্টারীতে জয়েন করেছিলাম?’
‘কিভাবে ভুলি? আমার কাছে কলম ছিলনা, তোর কাছ থেকে কলম নিয়ে তারপর সাত কপি জয়েনিং লেটার লিখেছিলাম।’
‘মনে থাকবেনা কেন? সেদিন আমার কলমটা তুই আর ফেরত দিসনি। মেরে দিয়েছিলি। কি ভাল ছিল কলমটা।’
‘কি করবো? তখন তো আমার কলমচুরির বদভ্যাস ছিল। এখন ভাল হয়ে গেছি অবশ্য।’
‘হ্যাঁ- তুই আর ভাল হয়েছিস! কলমচুরি হয়তো বাদ দিয়েছিস, কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে অন্যকিছু একটা চুরি করা শুরু করেছিস।’
দুজনে এদিক সেদিক তাকাই। কত অচেনা মুখ, কত অচেনা মানুষ। এরই মাঝে দু একটা শিক্ষকদের দেখতে পাই।
সময়ঃ ৩রা ডিসেম্বর, রাত সাড়ে বারোটা
স্থানঃ ঢাকা শেরাটন
গত কয়েকটা দিন যেন ঝড়ের বেগে চলে গেল। রিইউনিয়ন সেরে রাতের বাস ধরে সোজা খুলনা, সেখানে দুদিন থাকলাম, তারপর মাকে সাথে নিয়ে আবার ঢাকায় ফেরা।
পথের মধ্যে মা আর আমি টুকটুক করে গল্প করছি, কিনে খেয়েছি ঝালমুড়ি। আমি একটু ভয় পাই, এসব খেয়ে আবার শরীর খারাপ করবে নাতো? মা হাসেন, ‘তুই এতো ভীতু হলি কবে থেকে?’
পথে সন্ধ্যে নামে। বাতাসে কি যেন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ।
মাকে দেখাই পশ্চিম আকাশ। সেখানে দুটি উজ্জ্বল তারার মাঝে একফালি চাঁদ তৈরী করেছে একটি চমৎকার ত্রিভুজ। যেন আকাশের মাঝে একটি অনন্য হাসিমুখ।
এ কয়দিন সমস্যা ছিল নেটে ঢোকা নিয়ে। আজ শেরাটনে থাকার কারণে সে সমস্যের সমাধান হয়েছে। আগে জানতাম না এখানে নেটের স্পীড দারুন ভাল। বাংলাদেশে আছি বোঝাই যায় না। শেরাটনে আছি কনফারেনসের বক্তা বলে। ওইটুকু সুবিধে পেয়েই আমি মহাখুশী।
কনফারেনস খুব ভাল লাগছে। সবাই কি দারুন উৎসাহী। বাংলাদেশের ভবিষ্যত উন্নতির জন্যে কত সুন্দর সুন্দর আইডিয়া। আজকে আমার প্রেজেন্টশন ছিল বিকেলে। অন্যদের তুলনায় আমারটা তেমন ভাল হয়নি। কেমন ম্যাড়মেড়ে লেগেছে। দেখি কালকে কোন ফিডব্যক পাওয়া যায় কিনা।