স্থানঃ আমেরিকার একটি শহর।
দিন ঘনিয়ে আসছে দ্রুত পায়ে। অথচ একগাদা কাজ জমে আছে। জানি হয়তো শেষমেশ সবগুলোই সারা হবে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তা হচ্ছে ততক্ষণ অবধি তারা গলার কাঁটা হয়ে সর্বক্ষণ তাগাদা দিচ্ছে। আর তাদের চাবুকের ভয়ে আমি দৌড়ে বেড়াই এদিক-ওদিক।
এবারের দেশে ফেরাটি একটু অন্যরকম। এর আগে যতবারই গিয়েছি, সেগুলো ছিল বেড়াতে যাওয়া। ওখানে গিয়ে কোন কাজ করা নেই, শুধু মাস খানেকের অবসর, এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি আর শুধু খাওয়া-দাওয়া।
প্রতিবারেই আমেরিকাতে যখন ফিরে আসার সময় হয়, তখন চোখ বড় বড় করে খেয়াল করি যে কোমরে প্যান্টের বোতাম লাগছেনা। সারা শরীরে জমেছে আলস্যের ভার আর কাজের প্রতি প্রবল অনীহা। শুধু গল্প করতে ইচ্ছে করে, শুধু বই হাতে বিছানায় গড়াগড়ি করতে ইচ্ছে করে। বুঝি আমেরিকাতে ফিরে গিয়ে কষ্ট হবে আবার ঝাঁকের কইয়ের সাথে মিশে যেতে।
এবারে ব্যাপারটি ভিন্ন। এবারে কাজে যাচ্ছি, একা যাচ্ছি আর খুব অল্পদিনের জন্যে যাচ্ছি। মেরেকেটে সাত-আট দিন হয়তো থাকা হবে দেশে। আজকাল সন্ধ্যেবেলা বাড়ীর কাছের কলেজে পড়াই বলে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে। সেখানকার খাতা দেখতে হবে, গ্রেড দিতে হবে। তা না হলে হয়তো আরও দিন কয়েক বেশী থাকা যেতো।
দেশে এবারে একটি কনফারেনস হচ্ছে সামনের মাসে। কিভাবে যেন সেখানে একটি পেপার পড়বার আমন্ত্রন এলো। জানতাম ঝামেলা হবে, কিন্তু তারপরেও রাজি হয়ে গেলাম। এখন মনে হচ্ছে সে সময়ে না করে দেওয়াটাই উচিত ছিল, অল্প ক’টা দিনের জন্যে এত লম্বা ভ্রমন পোষায়না। কিন্তু এখন আর সে কথা লাভ কি? মরদ কা বাত, হাতী কি দাঁত। বলেছি যখন, তখন তো যেতেই হবে।
কনফারেনসের সাথে আরও একটা ব্যাপার আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার বিভাগটির এবারে পঞ্চাশপর্ষ পূর্তি উৎসব হচ্ছে একই সময়টিতে। সেখানেও একদিন যেতে হবে। পুরনো বন্ধুগুলোর সাথে দেখা হবে হয়তো,যদিও বেশীর ভাগেরাই এখন দেশের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা হয়তো আসতে পারবে না।
বুকের মধ্যে দুপদুপ করতে থাকে। পরিবারের সবাইকে এখানে রেখে আমি চলে যাচ্ছি, সেটা ভাল লাগছে না। একা একা ছুটি কাটানোর মতো যেন। ওতে কি আরাম হয়? দুশ্চিন্তায় মাথার পিছনটাতে কেমন যেন করতে থাকে। ওরা সবাই এ কয়দিন ভাল থাকবে তো? কোন ঝামেলা হবে নাতো? সপ্তাহের ট্র্যাশ মনে করে ফেলবে তো?
ভাবখানা এমন যেন আমি না থাকলে এদের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। আমরা সবাই বোধহয় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে ভাবতে ভালবাসি। আসলে কারো জন্যে কি কোন কিছু আটকে থাকে? এই পৃথিবী শূন্যস্থান পছন্দ করেনা, কিভাবে যেন সবকিছুই আবার আগের মতোই চলতে থাকে।
আজকাল কাজের ব্যস্ততা এতো বেড়েছে যে আর কোন কিছুই করা হয়না। ব্লগে লেখা তো দূরের কথা, আর দশ জনের লেখাটি পড়বার সময় পর্যন্ত পাইনে। হাওয়াই এর উপর লেখাটি মাঝপথে এসে ঝুলে রয়েছে। মাথার ভিতরে না লেখা কাহিনীগুলো মুখ গোমড়া করে বসে থাকে, আমাকে দেখে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়। শরীরে আমার হাজার ক্লান্তির ধূলো, কাজের ফিরিস্তির তালিকাটি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ডুবে যাই কাজে। ব্লগে লিখে আর কিই বা হবে?
তারপরেও আজকে কিবোর্ডের সামনে বসলাম। এ যাবত তো আমি কেবলই দেশ ছাড়ার গল্প বলেছি। দেখি তো এবারে দেশে ফেরার গল্পটি বলা যায় কিনা। সাথে করে ল্যাপটপটি যদি নিয়ে যাই, তাহলে হয়তো পথের যাত্রা বিরতিতেও দু চার কলম লিখে সাথেসাথেই পোস্ট করে দেওয়া যাবে। আর তা না হলে কালি-কলম তো রয়েছেই।
এত কাজের মধ্যে তারপরেও ভাল লাগছে। দেশে ফেরাটাই বোধহয় এরকম। মার সাথে দেখা হবে। ছোট বোনটির মেয়েটি নাকি খুব পাকাপাকা কথা বলা শিখেছে, তাকে কোলে বসিয়ে আদর করা হবে। ছোট ভাইটি এখন মস্ত সরকারী আমলা হয়েছে, তার পাশে দাঁড়িয়ে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠবে। মস্ত আমলা বলে নয়, একজন সৎ মানুষের সাথে দেখা হওয়ার আনন্দে।
জানি মা মৃদুস্বরে বলবেন,‘আর দুটো দিন বেশী কি থাকা যেতোনা? কতদিন পর তোকে আবার দেখলাম।’ ব্যর্থ মানুষের মতো আমি মাথা নীচু করে থাকবো। তখন মা হয়তো বলবেন,‘জানি তুই ব্যস্ত মানুষ, সবসময় দৌড়ের উপর থাকিস। শরীরের দিকে খেয়াল রাখিস কিন্তু।’
চোখের জল লুকোতে আমি হয়তো তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে চলে যাবো।
আজ এটুকুই থাক। যে পেপারটি পড়তে হবে, তার অনেকগুলো স্লাইড তৈরী করা এখনো বাকী। হাতে সময় মোটে আর অল্প ক’টা দিন।
(চলবে)