তাহলে এখন কি হবে?
আমরা সবাই একে অন্যের দিকে তাকাই।
আমাদের চোখের সামনে দিয়ে একে একে লঞ্চগুলো ছেড়ে যেতে থাকে। আংটিহারা জায়গাটি ঠিক কোথায় তা জানিনে, তবে সেদিন মনে হয়েছিল সুন্দরবন নামের একটি স্বর্গভূমির লুকানো চাবিকাঠি রয়ে গেছে এই জায়গাটিতে। এবং আমরা সেখানে যেতে পারছিনা।
লঞ্চ ভাড়া করে যাওয়া যে সম্ভব না, সেটা আমরা সবাইই পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারছিলাম। তাহলে এখন কি হবে?
জামালের মাথা সবচেয়ে ঠান্ডা। সে বললো,"অস্থির হয়ে কোন লাভ নেই। তার চেয়ে চলো, কোথাও গিয়ে আমরা বসি। অন্ততঃ পক্ষে এককাপ চা খাই। তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।"
তার এই কথায় আমাদের সকলেরই খেয়াল হলো যে আমরা এতক্ষণ কেউ কিছু খাইনি।
আবার ফিরতি পথ হেঁটে আসা। রেলস্টেশনটি তখন বেশ ফাঁকা, লোকজনের অত ভিড় নেই। স্টেশনে একটি রেলগাড়ি। জোর আওয়াজে সিটি বাজছে। একটু পরেই ছেড়ে যাবে ট্রেনটি।
মিজান অন্যমনস্কভাবে বললো,"এই ট্রেনটা কোথায় যাচ্ছে রে?"
আমি গলা উঁচু করে দেখলাম ট্রেনটির গায়ে লেখা আছে "পার্বতীপুর এক্সপ্রেস"। বললাম,"পার্বতীপুর।"
"সেখানে এত বড় একটা ট্রেন যাচ্ছে কেন? পার্বতীপুর কি বড় কোন জায়গা নাকি?"
"কি জানি। ট্রেনে করে কোথাও যাওয়া হয়নি অনেকদিন।"
পাশ দিয়ে একজন লোক হেঁটে যাচ্ছিল। আমাদের কথোপকথন শুনে সে বললো,"পার্বতীপুর থেকে লোকে ঢাকার ট্রেন ধরে। এই ট্রেনের বেশীর ভাগ লোকেই ঢাকা যাচ্ছে। যেহেতু এখন বাস ধর্মঘট চলছে, তাই আজ এতো লোকের ভিড়।"
মিজান সে কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো। ট্রেনটি তখন আস্তে আস্তে চলা শুরু করেছে। মিজান কোন কথা না বলে এক লাফে সেই চলতি ট্রেনে উঠে পড়লো। আমরা সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলাম।
কি করছো তুমি?"
মিজান ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,"আমি ঢাকা ফিরে যাচ্ছি। তোরা আমার ব্যাগ-ট্যাগ গুলো নিয়ে আসিস প্লিজ।"
আমরা আবার হতভম্বের মতো চলতি ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মিজান এটা কি করলো? এবং সে এটা কিভাবে করতে পারলো? আমাদের চোখের সামনে ধীরে ধীরে মিজানকে নিয়ে ট্রেনটি উধাও হয়ে গেল।
পনেরো মিনিট পর আমরা একটি ছোট রেস্টুরেন্টে বসি। তখনো আমাদের পুরোপুরি ঘোরমুক্তি ঘটেনি। সুন্দরবনের স্বপ্নটি মেলানোর আগেই মিজানের অপ্রত্যাশিত অন্তর্ধান আমাদেরকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তুলেছে।
আমি কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভয়ে আছি। যেহেতু আমিই ঢাকাতে বড় মুখ করে বলে এসেছিলাম যে আমি তাদেরকে সুন্দরবন দেখানোর বন্দোবস্ত করে দেবো, এবং সেই ভরসাতেই তাদের খুলনা আগমন, এখন তো দেখা যাচ্ছে যে সুন্দরবন যাওয়াটা রীতিমত একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। খামাখা তাহলে এরা সবাই এতটা পথ কষ্ট করে এলো। এর জন্যে যে আমার উপর কঠিন গালিবর্ষণ নেমে আসবে সেই চিন্তাতেই আমি বেচৈন হয়ে থাকি।
চা-নাস্তার অর্ডার দেওয়ার পরও আমরা চুপ করে বসে থাকি।
শেষমেশ জামালই প্রথম কথা বলে,"মিজান এই কাজটা কি করলো?"
মনোয়ার বললো,"এক মাঘে শীত যায়না। দাঁড়া না- একবার ঢাকা যেয়ে নেই। তারপর ওকে হালুয়া টাইট দেওয়া হবে।"
আলমগীর বললো,"ওতো দেখি নাম্বার ওয়ান বেঈমান। আরে-আমাদেরকে তো একটু বলতে পারতো। ঢাকায় তো আমরা সবাই যেতে চাই। একসাথে এসেছি একসাথেই ফিরে যেতাম।"
ইমামুল আরো এক কাঠি বেশী জংগী। "আবার যাওয়ার কায়দা করে বলে গেল যেন আমরা ওরা ব্যাগ-ট্যাগ ঢাকায় ফেরত নিয়ে যাই। কি আহ্লাদ! ওর ব্যাগ আমি এক্ষুনি এই নদীতে ছুঁড়ে ফেলবো।"
শফিউল ঠান্ডা মানুষ। সেও দেখি খেপে আছে। ঢাকাইয়া ভাষায় সে বললো,"একবার অরে হাতের কাছে পাইয়া লই। ঠ্যাং ভাইংগা আতে দরাইয়া দিমু কইলাম।"
আমি চুপচাপ থাকি। মিজান না হয় পালিয়ে গিয়েছে, কিন্তু আমি তো জলজ্যান্ত ওদের সামনেই বসে আছি। আব মেরা কেয়া হোগা, কালিয়া?
গরম পরোটা-মাংস খেয়ে ওদের মাথা আরো গরম হোল। মিজানের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করা হতে লাগলো প্রতিটি বাক্যে।
এর মধ্যে আমি মিন মিন করে বললাম,"আচ্ছা-তাহলে সুন্দরবনের ব্যাপারটা নিয়ে এখন একটু কথা বলি।"
সবার চোখ আমার দিকে ঘুরলো। তাদের মুখের অবস্থা দেখে ভালই বোঝা গেল যে মেজাজ সবারই তেতে পুরো টং হয়ে আছে। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। এইবার "আমার দিন ফুরালো।"
"সুন্দরবন না গেলেও কিছু যায় আসেনা। এতদিন যখন ওটা না দেখে কাটিয়েছি, তখন ওই জংগলের দুটো গাছ আর তিনটে পাখী না দেখলেও আমাদের জীবনের কোন বড় ক্ষতি হবে না। আর তা ছাড়া সুন্দরবনতো আর পালিয়ে যাচ্ছেনা। এখন যাওয়া হোলনা, পরে একদিন হবে। কিন্তু তাই বলে মিজানটা যে এইরকম একটা ধোঁকাবাজী করবে আমাদের সাথে, সেটা তো আর মেনে নেয়া যায়না।"
মনোয়ারের কথা শুনে আমি হাঁ হয়ে যাই। তবে কি আমি অফ দ্য হুক?
"তাহলে কি আপাততঃ সুন্দরবন মুলতুবী থাকবে?"
মনোয়ার আবার ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। "তোর সুন্দরবনের নিকুচি করি। কথা হচ্ছে মিজানকে কি ভাবে টাইট দেয়া হবে, তার তুই তার মধ্যে বারবার সুন্দরবনের আলাপ করতে চাচ্ছিস কেন?"
আমি চুপ করে থাকি। বড় বাঁচা গেলাম এ যাত্রা। অদৃশ্য মিজানের উদ্দেশ্যে দু চারটে দোয়া পড়ে ফেলি। তার কল্যানে আমার জীবন রক্ষা হোল। "কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ" কথাটির পূর্ণ অর্থ সেদিন খুব ভাল ভাবে বুঝতে পেরেছিলাম।
ঘন্টা খানেক পরে যখন দলবল সমেত বাড়ীতে ফিরছি তখন সামনে পড়লাম আমার হিটলার বাবার। তার সামনে পড়লেই আমার চিরাচরিত রিফ্লেক্স হচ্ছে মুহুর্তের মধ্যে শামুকের মতো গুটিয়ে যাওয়া। তাইই গেলাম। হিটলার সাহেব কিন্তু আমাদেরকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলেন।
"কি ব্যাপার, তোমরা না সুন্দরবন যাচ্ছো?"
মনোয়ারের সবসময় আগে কথা বলা অভ্যেস। এবারও তার বাত্যয় হোল না। "লঞ্চ ধরতে পারিনি চাচা। কি আর করা? তাই ফিরে এলাম।"
বাবা বললেন,"মন খারাপ করোনা। হয়তোবা তোমাদের ভালর জন্যেই তোমাদের যাওয়া হোলনা।"
তারপর তিনি আমার দিকে তাকালেন। সে দৃষ্টির সামনে আমার উচ্চতা এক লহমায় লিলিপুটের সমান হয়ে যায়।
"তুই কিন্তু ওদেরকে নিয়ে বাগেরহাট যেতে পারিস। সেখানে গিয়ে ষাটগম্বুজ মসজিদ, পীর সাহেবের মাজার আর কুমির দেখাতে পারিস।"
মনোয়ার বললো,"কিন্তু চাচা-আমরা তো কালই ঢাকা ফিরে যেতে চাচ্ছি। সকালে বোধহয় একটা ট্রেন ছাড়ে এখান থেকে।"
আমি তার কথা শুনে মনেমনে হাসি। শালা- বোধহয় একটা ট্রেন ছাড়ে, না? তুমি যেন ওই ট্রেন সম্পর্কে কিছুই জানোনা।
বাবা বললেন,"বাগেরহাট তো খুলনা থেকে মোটে কুড়ি মাইল। তোমরা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সবকিছু দেখে সন্ধ্যেবেলাতে ফিরে আসতে পারবে।"
তাইই করলাম শেষমেশ। ছোট ন্যারো গেজের ট্রেনে চড়ে আমরা রওনা দিলাম বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে। কুড়ি মাইলের পথ যেতে তখন লাগতো দুই ঘন্টার উপরে। গোটা দশেক স্টেশন আছে মাঝে। যেতে ভালই লাগছিল। সুন্দরবন দেখা নাইবা হোল, এইযে আমরা সবাই মিলে একসাথে ট্রেনে করে যাচ্ছি, এটার মজাই বা কম কি? বাঘমামা আর হরিণ ভায়ার সাথে মোলাকাত পরে কোন একদিন হবে।
ষাটগম্বুজ মসজিদটি তৈরী করেছিলেন পীর খানজাহান আলী। ইতিহাস বলে খানজাহান আলী ছিলেন একজন সেনাপতি। তার বাহিনী নিয়ে জয় করতে করতে এগোচ্ছিলেন তিনি। বাগেরহাট অবধি এসে কি মনে করে আর এগোননি তিনি। ওখানেই স্থায়ী আবাস স্থাপন করলেন। থেকে গেলেন সেখানে। আশপাশের লোকদের জন্য তিনি বানালেন বিরাট ষাটগম্বুজ মসজিদটি। খনন করলেন বিশাল দীঘি। ক্রমে ক্রমে তাকে ঘিরে জন্ম নিল কতরকম গল্প আর কিংবদন্তীর। একসময় তিনি পীরের মর্যাদাও পেয়ে গেলেন (সম্ভতঃতার মৃত্যুর পর)।
এসব গল্প সবাই শুনে মুগ্ধ হোল। ওদেরকে মোহমুগ্ধ হতে দেখে আমার নিজেরও ভাল লাগলো। আগে তো নিজের দেশের খানজাহান আলীকে পাত্তা দেইনি (গেঁয়ো যোগী ভিখ পায়না ধরণের ব্যাপার আরকি)।
খানজাহান আলীর মাজার দেখে সবচেয়ে খুশী হোল বন্ধুদের মধ্যে একজন। তার লাস্টনেম ছিল খান, আর সে একটি মেয়েকে মনে মনে পছন্দ করতো যার লাস্টনেম ছিল জাহান। তার উক্তি ছিল,"আমাদের ভিতর মহাব্বত হইতে বাধ্য। খান আর জাহানে না মিল হইলে পীর খানজাহান আলীর বদনাম হইবো। তোরা কিন্তু আমাদের বিয়াতে বরযাত্রী হইবি। আইজকা এইখানে এই পীরের মাজারে খাড়াইয়া আমার মনে হইতাছে যে আমাগো ভিতরে মহাব্বত হইবোই হইবো।
আমরা সমস্বরে সায় দেই।"অবশ্যই। খান আর জাহানের দিল একসাথে মিলবেই একদিন। এই বিয়া বহুদিন আগে বেহেশতে ঠিক করা হইছে।"
উত্সাহের চোটে আমরা ষাটগম্বুজ মসজিদের ছাদে উঠে যাই মই বেয়ে (এখন বোধহয় কাজটি বেআইনি)। সেখানে উঠে চেঁচাই,"পীর খানজাহান আলী জিন্দাবাদ।"
সেদিন সন্ধ্যেবেলা ফিরতি ট্রেনে আমাদের খুশীভরা গলার আওয়াজে গোটা ট্রেন গমগম করতে থাকে। আমরা ততক্ষনে ভুলে গেছি সুন্দরবন না দেখার যন্ত্রণা, আংটিহারা লঞ্চটিকে খুঁজে না পাওয়ার দুঃখ, মিজানের হঠাৎ চলে যাওয়ার প্রতারনা।
জামাল বলে,"শালা মিজান নিজেকে বড় চালাক মনে করে কেটে পড়লো। তাতে কি লাভ হোল? মাঝখান থেকে একটা সুন্দর জিনিস দেখতে পেলোনা। ওর জন্য দুঃখই হচ্ছে।"
মজলিশ সাথে গলা মিলায়,"ঠিক, একদম ঠিক কথা।"
আমি মিন মিন করে বলি, "তাহলে আমি প্রস্তাব করছি যে ওকে মাফ করে দেওয়া হোক।"
মজলিশ আবারও সায় দেয়, "ঠিক-একদম ঠিক কথা। গাধাটাকে মাফ করে দেয়া হোল।"
মিজান বোধহয় আজও জানেনা যে সে আমার কাছে এবং আমি তার কাছে গভীর কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হয়ে আছি।
এই পর্বের শেষকথা হোল এই যে আমাদের আর কখনো সুন্দরবন দেখা হয়নি। আমিও আজ অবধি সুন্দরবন যাইনি কোনদিন। মক্কার মানুষে এইভাবেই বোধহয় হজ্ব পায়না। তাহোক- সব সময় কি আর হজ্ব পাওয়াটা দরকারী? হজ্বের পথের গল্পটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ও হ্যাঁ- খান আর জাহানের বিয়ে বা মোহাব্বত কোনটাইই শেষ পর্যন্ত হয়নি। আমাদের ভাগ্যে সেই বেহেশতি বিয়েতে বরযাত্রী হবার শিকেটিও ছেঁড়েনি কোনদিন। যতদূর জানি খান এবং জাহান দুজনেই পরম সুখে তাদের নিজের নিজের সংসার করছে।
(নতুন পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১২:০৮