আমি ধপ করে বসে পড়ি। আমার মাথায় তখনো ঢুকছেনা যে ওরা আমার একটা কথার উপর ভরসা করে সুন্দরবন দেখার জন্য সত্যি সত্যি ঢাকা থেকে এই খুলনাতে চলে আসবে।
আমারতো দেখি কোন কথা বলাই উচিত না। যা বলি, লোকে তাইই বিশ্বাস করে ফেলে। প্রথমে নীল (পর্ব-১৬), এখন এরা। কি হচ্ছে এসব? বন্ধুদের কাছে কি দু একটা গুল-গাপ্পাও মারা যাবেনা? নাকি লোকে মনে করছে আমি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। যাহা বলি, সত্য বলি।
মনোয়ার বললো,"কিরে তুই কথা বলছিস না কেন? আমরা কত কষ্ট করে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে তোদের এই জংগলে এলাম, আর তুই কিনা একটা ভোঁদড় মার্কা মুখ বানিয়ে তাকিয়ে আছিস।"
আমি আস্তে আস্তে একটা চেয়ারে বসি। মাথা খুব ঠান্ডা রাখতে হবে। এরা যখন এখানে এসেই পড়েছে, তখন কিছু একটা বন্দোবস্ত করতেই হবে। তা না হলে ঢাকায় ফিরে আর মুখ দেখানো যাবে না।
ওদেরকেও বসতে বলি।
জিজ্ঞেস করি,"তা তোরা ঢাকা থেকে খুলনা এলি কিভাবে। আমি তো বাস ধর্মঘটের জন্য ঢাকা ফিরতে পারছিনা।"
শুনলাম মনোয়ারের মামার (পর্ব-১০(ঙ)) নাকি একটা মালবাহী লঞ্চ আছে যাতে করে তিনি বিভিন্ন মালামাল এক জায়গা থেকে আর এক জায়গাতে নিয়ে যান। ঘটনাচক্রে এবার নাকি লঞ্চটি কিসব জিনিসপত্র নিয়ে ঢাকা থেকে খুলনা আসছিল। ব্যাস- বিনা পয়সাতে খুলনা আসা যাবে এই লোভেই ইনারা কয়জন লঞ্চে উঠে পড়েছেন। বাংগালী যে সস্তায় পেলে আলকাতরাও খায়, তার উজ্জ্বল প্রমাণ সেদিন হাতেনাতে পেলাম। পথে নাকি খুবই কুয়াশা ছিল, আর তার উপর এবারই প্রথম খুলনাতে আসছে লঞ্চটি। সারেং পথ চেনেনা ভাল মত তাই পথের মধ্যে তারা ঘুরপাক খেয়েছে কয়েকবার। খাওয়া-দাওয়া তেমন ভাল করে করতে পারেনি বেচারারা। নষ্টও হয়েছে বেশ কিছুটা সময়।
ওদের দিকে তাকিয়ে একটু মায়াও হোল। যাক-বেচারারা আশা করে এতদূর এসেছে, কিছু একটা তো করতেই হয়।
ওদেরকে বাইরের ঘরে বসিয়ে বাড়ির ভিতরে এলাম। ততক্ষণে মায়ের কাছে খবর পৌছে গেছে যে "বেইমান মামা"র কাছে আরো অনেক "বেইমান মামা"রা এসেছেন। মা বললেন,"ওদেরকে আমি একটু চা-নাস্তা দেই। তারপর দুপুরের খাবারটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলেই হবে।"
আমার কাছে তখন আবার মায়ের জন্যে খারাপ লাগতে লাগলো। হঠাৎ করে এতগুলো উল্লুক যে আমার ঘাড়ে ভর করবে তা আমি আমার চরমতম দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। কেন যে আমি অত ডাঁট মেরে সুন্দরবন দেখানোর কথা বলতে গেলাম ওদেরকে। মাকে বললাম,"আমি স্যরি, মা। তোমাকে এই ঝামেলায় ফেলার জন্য।"
মা হাসেন।"আমি তো ঝামেলায় পড়িনি। ঝামেলায় পড়েছিস তুই। ওদেরকে সুন্দরবন দেখাতে হবে না?"
"ও-হ্যাঁ। সেটা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন কি করবো?"
"আমিও সেটা নিয়ে ভাবছি। একটা কাজ করতে পারিস। ওদেরকে বসিয়ে তুই আমাদের পাশের বাড়ীর লিটনদের বাসায় যা। শুনেছি লিটনের বড় চাচা নাকি শিকারী ছিলেন। বাঘ বা কুমীর মারেননি কখনো, তবে হরিণ নাকি বেশ কয়েকটা মেরেছেন। উনি নিশ্চয়ই জানেন কিভাবে সুন্দরবনে যেতে হয়।"
"উনিতো শিকারী ছিলেন বহু আগে।"
"তাতে কি? সুন্দরবনতো আর খুলনা ছেড়ে চলে যায়নি।"
তাইই করলাম শেষমেশ। ঢাকা থেকে আগত পঙ্গপালকে চা-নাস্তার সামনে বসিয়ে দিয়ে আমি বেরোলাম। লিটনের বড়চাচা তখন বাসায়ই ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করি,"চাচা-ঢাকা থেকে আমার কিছু বন্ধু এসেছে সুন্দরবন দেখবে বলে। কিভাবে সেখানে যাবো যদি একটু বলে দিতেন।"
সুন্দরবনের নামোল্লেখে চাচার ঘোলাটে চোখ আরো ঘোলাটে হয়ে গেল। বুঝলাম লক্ষণ খারাপ। উনি একটা লম্বা চওড়া ভাষণ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গলা খাঁকারী দিয়ে উনি দেয়ালে টাঙানো একটি ছবির দিকে আংগুল তুললেন। "আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগের কথা। আমার শেষ শিকার। সেবার সুন্দরবনে নেমেই বুঝতে পেরেছিলাম যে---।"
তাড়াতাড়ি বলে উঠি,"চাচা-আমার বন্ধুরা আমার জন্য বসে আছে। একটু যদি তাড়াতাড়ি বলেন তো ভাল হয়।"
চাচা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। "জানি, এখন সবাই ব্যস্ত। কারোরই কোন সময় নেই হাতে। এই দ্যাখো-আমার ছেলে দুটো আমেরিকায় বসে আছে, একবারও কি ফোন করে তারা খোঁজ নেয় আমার? একটা কাগজে দু কলম লিখতে কি এতই সময় লাগে?"
বাধ্য হয়ে সায় দিতে হয়। "সেটা তো ঠিকই বলেছেন চাচা। এখন যদি একটু সুন্দরবন যাবার পথটি বাতলে দেন।"
"আচ্ছা বলছি। তা তোমরা সুন্দরবনে কোথায় যাবে বলে ঠিক করেছো?"
আমি তখন সাত হাত পানির নীচে। "এক জায়গায় গেলেই হয় চাচা।"
"না-না- এটা তুমি ঠিক কথা বললেনা। সুন্দরবন কি আর এইটুকু জায়গা? তার এক এক জায়গায় এক এক জিনিস। যদি পাখী দেখতে চাও, তবে যাবে হিরণ পয়েন্টে। যদি হরিণ দেখতে চাও, তাহলে-।"
"যেখানে সবচেয়ে সহজ সেখানেই যেতে চাই।"
"তাহলে এক কাজ করো। ভোর পাঁচটায় সোজা লঞ্চ ঘাটে চলে যাও। সেখান থেকে একটা লঞ্চ ছাড়ে। জিজ্ঞেস করবে,আংটিহারার লঞ্চ কোনটা? সেই লঞ্চে উঠবে তোমরা।"
"তারপর?"
"লঞ্চটা তোমাদের আংটিহারায় নিয়ে যাবে। প্রায় সন্ধ্যে হয়ে যাবে সেখানে পৌঁছাতে। আংটিহারা একটা মোটামুটি বড় বাজার। ওখানে তোমরা রাতটা থাকবে।"
"কোথায় থাকবো? ওখানে কি হোটেল-টোটেল আছে?"
"ছোটখাট একটা হোটেল ছিল তো তখন। এখন নিশ্চয়ই আরো বেশী আছে।"
"তারপর?"
"পরদিন তোমরা ওখান থেকে আর একটা লঞ্চে উঠবে। সেটা যায় বড়গাজী বলে একটা জায়গায়। ওই লঞ্চটিতে বসেই তোমরা সুন্দরবনের খুব কাছ দিয়ে যাবে। যদি আরো ভাল করে দেখতে চাও, তাহলে বড়গাজীতে নেমে একটা ছোট নৌকোতে করেও সুন্দরবনের আরো ভিতরে ঢুকে যেতে পারো। তবে আলো থাকতে থাকতেই আবার ফিরে আসবে।"
"জ্বি-চাচা। আমি তাহলে যাই।"
"তোমার বন্ধুদের নিয়ে আবার এসো। অনেকদিন সুন্দরবনে যাওয়া হয়নি। তোমাদের কাছ থেকে কি কি দেখলে শুনবো।"
চাচার কাছ থেকে তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে ফিরে এলাম। বন্ধুরা ততক্ষনে কিঞ্চিৎ ঠান্ডা হয়েছে। পেটভরা থাকলে বাংগালীর মনও ভরা থাকে।
"কি অবস্থা? আমাদের সুন্দরবন যাওয়ার কতদূর?"
"ভালই। আমাদের পাড়ার শিকারী চাচার কাছ থেকে সব জেনে এলাম। কাল খুব সকালে রওনা দিতে হবে।"
"পৌঁছাতে কয় ঘন্টা লাগবে?"
"ঘন্টা না, কয় দিন লাগবে তাই বল।"
"মানে? সুন্দরবন কি এত দূর নাকি? আমরা তো ভেবেছিলাম, তোদের বাড়ীর ছাদে উঠলেই সুন্দরবন দেখা যাবে।"
কথা শুনে ইচ্ছে হোল ঠাস করে একটা চড় লাগাই। কিন্তু থাক, যীশু বলেছেন ক্ষমাই পরম ধর্ম। তার উপর এরা তো আবার অতিথী। দেবতূল্য। অমর্যাদা করাটা ঠিক হবেনা। মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করি। একবার ঢাকায় যেয়ে নেই। আমাকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তোদেরকে শায়েস্তা করা হবে। সেটা পরে। আপাততঃ হাতের ঝামেলাটা তো সামলাই।
দিনের বাকী অংশটুকু শহরে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে কাটালাম। পরদিন খুব ভোরে রওনা দিতে হবে বলে রাত জেগে আড্ডাও করা হোলনা। রাতে মা দেখি বড়বড় দুটো টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বসেছেন।
"এটা কি হচ্ছে?"
"তোদের জন্য অল্প একটু খাবার বানাচ্ছি। সাথে করে নিয়ে যাস। পথে কি পাওয়া যায় না যায়।"
"এই তোমার অল্প খাবার? এই খাবার দিয়ে তো আমাদের পুরো ক্লাশকে খাওয়ানো যাবে।"
"তোর সব কিছুতেই বেশীবেশী। যা- ঘুমোতে যা। আমি খাবারগুলো ভাল করে গুছিয়ে দেই।"
একটা বড় ঘরে ঢালাও বিছানা করে শোয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারী মাস চলছে। অল্প শীত বলে লেপ-টেপের দরকার নেই। কম্বল গায়ে দিলেই বেশী আরাম। শীত লাগলেও জানালা খুলে দেয়া হয়েছে যেন বাবুদের (আমিও তাদের মধ্যে একজন) ধূমপানের কোন ব্যাঘাত না ঘটে।
পরদিন উঠলাম শেষরাতে। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, শুধু রাস্তার বাতিতে টের পেলাম যে ঘন কুয়াশাও রয়েছে এর সাথে। ওই অন্ধকারের মধ্যেই হাতমুখ ধুয়ে আমরা কয় অভিযাত্রী বেরিয়ে পড়লাম। ততক্ষণে ওদের উপরে আমার রাগ পড়ে এসেছে। বেশ ভালই লাগছে বরং। ওদের ওছিলায় সুন্দরবন দেখতে যাচ্ছি।
রাস্তায় বেরিয়ে রিকশা পেতে সমস্যা হোল। আমরা মোট সাতজন, তিনজন করে বসলেও মিনিমাম তিনটে রিকশা লাগবে। এর মাঝে আবার টহলদার দুজন পুলিশ আমাদের দিকে গভীর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। সুন্দরবনের বদলে কি শেষ পর্যন্ত জেলখানা-দর্শন ভাগ্যে আছে তাহলে?
যাকগে- শেষপর্যন্ত রিকশা পাওয়া গেল। কোনমতে গিয়ে পৌছালাম লঞ্চঘাটে। খুলনার লঞ্চঘাটটি আবার রেলস্টেশনের পাশেই। রেলের যাত্রীদের ভিড় ঠেলে তারপর পৌছাতে হয় লঞ্চঘাটে। ঝামেলার উপর ঝামেলা। নিজের নিজের ব্যাগ নিয়ে সবাই দৌড়াচ্ছি। কিন্তু ভারী টিফিন ক্যারিয়ারগুলো কেউ বইতে চায়না। যেন ওগুলো সব একা আমারই দায়।
লঞ্চঘাটে অনেক লঞ্চের ভিড়। সবাই ডাকছে,"আসেন-আসেন, পাঁচ মিনিটে ছাড়বে।"
প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করছি,"ভাই-এই লঞ্চ কি আংটিহারা যাবে?" তারা মাথা নাড়ে।
কি ঝামেলারে বাবা!
শেষে একজন আমাদের প্রশ্ন শুনে বললো,"কোথাকার লঞ্চ বললেন?"
"আংটিহারা। আমরা আংটিহারা যাবো।"
লোকটি কি যেন চিন্তা করে। তারপর বলে,"আংটিহারার লঞ্চলাইন তো বন্ধ হয়ে গেছে আজ থেকে পাঁচ-ছয় বছর আগে। ওদিকে এখন আর কোন লঞ্চ যায়না।"
বলে কি? আমার মাথায় যেন বজ্রপাত হয়। তাও জিজ্ঞেস করি,"ভাই-আমরা সুন্দরবন যেতে চাচ্ছিলাম। কোন লঞ্চ উঠবো যদি একটু বলে দেন।"
লোকটি হাসে।"সুন্দরবনের দিকের কোন লঞ্চ নাই এখান থেকে। যদি চান তাহলে আপনারা একটা লঞ্চ নিজেরা ভাড়া করে যেতে পারেন।"
আমি তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।
(বাকী অংশটুকু পরের পর্বে)।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১২:০৫