তখন আমরা মাস্টার্সের ছাত্র। সিনিয়র ব্যাচ বিধায় জুনিয়ররা সামনে পড়লে সালাম-টালাম দেয়, দ্রুত হাতের সিগারেট লুকিয়ে ফেলে। আমরাও দেখে না দেখার ভান করি। ক্লাশের পড়শোনার চাপ অতটা নেই, শুধু থিসিসের কাজ করার জন্য ল্যাবে হাজিরা দিতে হয়।
বিকেলবেলা হাতে চায়ের কাপ (এবং আঙ্গুলে সিগারেট) নিয়ে বৈঠক শুরু হোল। জনা দশেক আমরা। আলোচনার বিষয়বস্তু, স্টাডি ট্যুর ওরফে এক্সকারশান ওরফে শিক্ষা সফর ওরফে কয়েকদিন ইয়ার-দোস্তদের সাথে ঢাকার বাইরে গিয়ে মৌজ করা।
প্রথম প্রশ্ন, কোথায় যাবো? চটপটে সেলিম তালুতে ঘুষি মেরে বললো,"উই মাস্ট গো টু ব্যাংকক"। আমরা অবাক। ব্যাংকক কেন?
সেলিম বললো,"কেন নতুন জিনিস শিখতে। বাংলাদেশের সামাজিক নিয়ম খুবই স্ট্রিক্ট, ব্যাংককের সব কিছুই নাকি খুব লিবারেল। পুরুষ-নারীতে মেলামেশা শুনেছি খুবই ক্লোজ। এটা আমরা শিখে এসে সবাইকে শিখাবো।"
তখন তাকে মনে করিয়ে দিতে হোল যে আমরা বিজ্ঞানের ছাত্র। ছেলেমেয়ের মেলামেশা স্টাডি করাটা থার্মোডাইনামিক্স এর আন্ডারে পড়েনা।
এরপর খেপলো বার সাতেক প্রেমের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ রায়হান। "তাহলে চল-আগ্রায় যাই। তাজমহল না দেখলে আমাদের জীবনটাই বৃথা।"
"তোর কপালে তাজমহল নাই। তুই বরং কাছের নাগরমহলে গিয়ে এক শো সিনেমা দেখে আয়।" সে অন্যদের এই জাতীয় মন্তব্যে মুষড়ে পড়ে।
আলুচান্না (আলোচনা) চলতে থাকে। কাপের পর কাপ চা উড়ে যায়। বিভিন্ন জনের জন্য সিগারেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অর্ডার পুরো করতে করতে চাচার দোকানের দুই পিচ্চি ঘেমে ওঠে। শেষমেশ স্থির হোল, আমরা চিটাগং যাবো। সেখানে দু একটা কোম্পানীর ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট আছে দেখার মতো, আবার ঘোরাঘুরির জন্য অনেক সুন্দর জায়গাও আছে।
জ্ঞান আহরণ অতিশয় পূণ্যের কাজ। এর জন্যে সুদূর চীন পর্যন্ত যাওয়ার বিধান রয়েছে। আমরাতো সেই তুলনায় পাশের বাড়ি যাচ্ছি মাত্র। জায়গা স্থির হওয়ার পর টাকাপয়সার বন্দোবস্ত করা। একজন বুদ্ধি দিল যে আগে থেকে যোগাযোগ করলে বিভিন্ন সংস্থার রেস্টহাউস বিনাপয়সায় ব্যবহার করতে পারা যায়। আমাকে দেওয়া হোল তাদের সাথে যোগাযোগ করার কাজটি। একমাস পর আবার মিটিং হবে।
একমাসের মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্থার কাছ থেকে জবাব এলো। চিটাগং এ তিন রাত ফ্রি থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। এরই মধ্যে আমরা আমাদের শিক্ষা সফরটিকে শুধু চিটাগঙ্গএ সীমাবদ্ধ রাখিনি। প্ল্যান হয়েছে কক্সবাজার এবং রাঙ্গামাটিও যাওয়া হবে। ইতিমধ্যে বিভাগের চেয়ারম্যানকে ভজিয়ে ভাজিয়ে কিছু টাকাও তার কাছ থেকে বার করা হয়েছে। দু একটা কোম্পানি আমাদেরকে থাকার জায়গা না দিতে পেরে দুঃখ জানিয়ে লিখেছে যে তারা আমাদেরকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারে। সব মিলিয়ে দেখা গেল যে আমাদের পকেট থেকে হয়তো শ' দুয়েক টাকা দিতে হতে পারে মাত্র।
এর পরের কাজটি একটু সমস্যার। আমরা কয়েকজন ইতিমধ্যে গোপনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে মেয়েদেরকে আমাদের সাথে না নেওয়াই উচিত হবে। কারণ, মেয়েরা থাকা মানেই এক গাদা সমস্যার সৃষ্টি হওয়া। সমস্যাগুলোকে লিপিবদ্ধ করা হোল যাতে অন্যরা ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তার কয়েকটা মনে আছে মাত্র।
(১) মেয়েরা তৈরী হতে ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশী সময় নেয়।
(২) মেয়েরা থাকা মানেই ছেলেদের মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রতিযোগীতা সৃষ্টি হওয়া যা আনন্দের বদলে অহেতুক স্ট্রেস নিয়ে আসবে।
(৩) মেয়েরা থাকা মানেই সব ভাল ভাল জিনিস (যেমন রেস্ট-হাউসের বড় রুমটি, গাড়ীতে জানালার পাশের সিটটি) ওদের দিতে হবে।
(৪) মেয়েদের যাবতীয় মাল-সামান ছেলেদেরকেই বইতে হবে।
(৫) মেয়েরা কথায় কথায় "প্লিজ এটা একটু করে দাওনা" জাতীয় ছদ্মবেশী আদুরে হুকুম নাজিল করবে।
(৬) মেয়েরা সামনে থাকা মানে ছেলেরা প্রাণ খুলে আলাপ করতে পারবে না (মানে মুখ খারাপ করতে পারবে না)।
(৭) মেয়েরা থাকলে ছেলেরা যা ইচ্ছে তাই পরতে (বা কোন কিছু না পরতে) পারবে না।
(৮) বাইরে গিয়ে ছেলেরা কোন অকাজ (?) করলে মেয়েরা ঢাকায় ফিরে সবাইকে সেটা বলে দেবে।
(৯) কোন মেয়ের সাথে গার্জেন হিসেবে তার বাবাও চলে আসতে পারেন। (কি ভয়াবহ ব্যাপার।)
(১০) এক কথায়, মেয়েরা সাথে থাকা মানে ছেলেরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে না।
অতএব মেয়েরা বাদ।
বলে তো দিলাম বাদ, এখন সেটা করা হবে কিভাবে। সরাসরি এই লিস্টতো আর তাদের দেখানো যায়না। মেয়েরা খেপে গেলে পুরো শিক্ষা-সফর মাথায় উঠবে।
তাহলে?
গেলাম আমাদের ব্যাচের সেরা কুচক্রী ব্রেইনের ছেলে আশরাফের কাছে। সে বুদ্ধি দিল,"এটা কোন ব্যাপারই না। মেয়েদেরকে ভয় দেখা। তাহলেই ওরা আর যেতে চাইবে না।"
"ভয় দেখাবো কিভাবে?"
"তোদের মাথায় কি আল্লাহ কোনকিছু দেয় নাই? ভয় দেখাতেও পারিস না?"
আমরা মাথা চুলকাই। "কি করবো দোস্ত? শালার কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্রেইনটাকে ভর্তা করে ফেলেছে। এখন দুই আর দুই যোগ করতে দিলে উত্তর আসে আট দশমিক তিন পাঁচ।"
আশরাফ বোঝে আমাদের দু:খ। "শালা কোয়ান্টামের বাচ্চারে যদি একবার এই হলের চিপায় পাইতাম।"
অতঃপর সে বসে সব তরিকা বাতলে দিল। সরাসরি ভয় দেখানো তো আর যাবে না, ব্যাপারটা ইনডাইরেক্টলি করতে হবে। যেহেতু সব মেয়ের সাহসের মাত্রা সমান নয়, ভয়ও দেখাতে হবে বিভিন মাত্রায়। এবং সেটা করতে হবে বিভিন্ন জনকে দিয়ে যেন গোটা ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হয়।
মেয়েদেরকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা হোল। তাদের কোডনেম হোল মাকড়সা, সখীগণ এবং বেগম রোকেয়া।
মাকড়সা গ্রুপ হচ্ছে সবচেয়ে ভীতু। এই দলের মেয়েরা যে কোন কিছুতেই ভয় পায়, বিশেষতঃ ছেলেদেরকে। এদের ধারণা প্রতিটি ছেলের মনে কুমতলব কিলবিল করছে। সামান্যতম সুযোগ পেলেই এরা মেয়েদের গায়ে হাত দেবে। এরা ছেলেদের সাথে কথা বলাটাও নিরাপদ মনে করেনা। এদেরকে ভয় দেখানো সবচেয়ে সহজ, কেননা এরা অলরেডী ভয় পেয়ে বসে আছে।
সখীগণ গ্রুপের মেয়েরা মাঝারী আকারের ভীতু। এরা ছেলেদের সাথে মাঝেসাজে কথা বলাটা খারাপ মনে করেনা (বিশেষতঃ যখন পরীক্ষার জন্য ভাল নোটের প্রয়োজন পড়ে)। তবে এরা কখনো একা একা কোন ছেলের সাথে কথা বলবেনা। সব সময় এরা সখীসমেত চলাফেরা করে। এবং চার-পাঁচ বছর একসাথে পড়াশুনা করার পরও এরা সহপাঠী ছেলেদেরকে 'আপনি' বলে সম্বোধন করে। এদেরকে ভয় দেখানো একটু কঠিন, তবে এদের দুর্বল জায়গা হচ্ছে যে এরা একা একা কোথাও যায়না। অতএব যদি এদের গ্রুপের এক বা দুইজন না যায়, তাহলে গোটা গ্রুপটাই হয়তো যাবে না।
শেষ গ্রুপের মেয়েরা হচ্ছে নারী-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাদের মত হচ্ছে ছেলেরা যদি পারে, তাহলে আমরাই বা পারবোনা কেন? এরা ছেলেদের সাথে বসে একা একা আড্ডা দিতে প্রস্তুত, মাঝে মাঝে জোশের কথা শুনে হাসতে হাসতে পাশে বসা ছেলেটির পিঠে দুম করে কিলও বসিয়ে দিতে পারে। ছেলেদের সাথে এক রিকশায় করে কার্জন হল থেকে টিএসসি বা নিউমার্কেট যেতে এদের কোন সমস্যা নাই (স্পেশালি রিকশা ভাড়াটা যদি ছেলেটি দিয়ে দেয়)। এরা ছেলেদেরকে 'তুই' বলে চেঁচিয়ে ডাকতে পিছপা হয়না। খুচরা ভয় দেখিয়ে এদেরকে দমানো কঠিন। এদের মধ্যে থেকে যদি দু একটা বলে বসে যে তারা যেতে চায়, তাহলে সখীগণ গ্রুপের দু একজনও সাথী পেয়ে যাবে এবং তারাও তখন যাবার বায়না তুলবে।
ভয় দেখানোর মূল স্ট্র্যাটেজী ঠিক করা হোল যে মেয়েদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে ছেলেরা কিছু কথা নিজেদের মধ্যে বলবে। এবং এটা শুনে মেয়েরা ভয় পাবে।
যেমন মাকড়সা গ্রুপকে ভয় দেখাবে 'ভাল' ছেলেরা। তারা খুবই চিন্তিত মুখে আলোচনা করবে যে চিটাগং এ শান্তি বাহিনীরা শিগগীরই আক্রমন করার প্ল্যান করছে। খবরটা সত্যি, কেননা বক্তার ছোট মামা চিটাগং ক্যান্টনমেন্টের ইন্টেলিজেন্স এ কাজ করেন। এই অবস্থায় চিটাগং যাবার পর মেয়েদেরকে কি ভাবে প্রটেকশন দিতে পারে তারই প্ল্যান করবে ছেলেরা নিজেদের মধ্যে।
সখীগণ গ্রুপের জন্য ঠিক করা হোল কয়েকজন ব্যাক-বেঞ্চারকে যাদের উল্টা-পাল্টা কাজ করার সুনাম আছে। তারা একে অন্যকে চেঁচিয়ে বলবে, "দোস্ত- চল্লিশ পুরিয়া লোড করা কমপ্লিট। সাথে একস্ট্রা কল্কেও নিয়েছি। একবার চিটাগং নেমে নেই, তারপর সলিড বা লিকুইড বাদ দিয়ে শুধু গ্যাসিয়াস নিউট্রিশন।" অথবা কেউ বলবে,"রাঙ্গামাটি থেকে কাজিনের ফোন পেয়েছি গত রাতে। পাঁচ বোতল বর্তমানে চিল্ড্ হচ্ছে আমাদের জন্য।"
বেগম রোকেয়াদের জন্য আনা হবে হেভী আর্টিলারী। তাদেরকে আঘাত করতে হবে একেবারে আসল জায়গায়। তাদের জন্য তৈরী করা হোল বিশেষ ডায়ালগ।
"এত চিন্তা করছিস কেন আসাদ? আরে কক্সবাজারে থাকার জায়গা পাইনি তো কি হয়েছে। মাত্র তো দুটো রাত। স্টেশনে বসে তাস খেলেই রাত পার করে দেব। বাথরুমটা হয়তো একটু প্রবলেম হবে। তার জন্যে নাহয় একটু দূরের কোন ঝোঁপের আড়ালে গেলাম। আরে ব্যাটা-দুই জেনারেশন আগে তোর দাদা কি কোনদিন কমোড দেখছে? তাতে কি উনি হার্টফেল করেছিলেন? মেয়েদের মতো সব সময় বাথরুম বাথরুম করবি না তো। একটা নতুন জায়গায় যাচ্ছি, দু একটা জিনিসের অসুবিধা তো হবেই। তোর যদি এত ঝামেলা মনে হয়, তাহলে তুই যাস নে। বাসায় কমোড জড়িয়ে ঘুমা।"
পরদিন আমাদের কম্যান্ডো গ্রুপ নেমে পড়লো অ্যাকশনে। এক সপ্তাহের মধ্যে মেয়েদেরকে ভয় দেখানোর কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।
(বাকী অংশটুকু পরের পর্বে )।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০০৮ রাত ৩:৫৭