অবশেষে অনেক সংগ্রাম করে বেতন চালু করা গেলো। শুধু আমারটা না, কলেজে ফান্ডের অভাবে আরও যারা বেতন পাচ্ছিলেন না, তাদের বেতনেরও ব্যবস্থা করলাম। নিজে দুমাসের বেতন একসাথে পেলাম। বেশ বড় অংকের একটা টাকা। যেহেতু বেতনের বাইরে আর কোনো আয় আমার নাই, এমনকি প্রাইভেটও পড়াই না, তাই এই দুই মাস চলতে কষ্ট হয়েছে বৈকি! কষ্ট করে বড় হয়েছি, আমার বাবা-মায়ের জীবনটাও ছিলো কষ্টের। তাই আমি এই কষ্টের মর্ম বুঝি।
বুঝি বলেই, বেতনের টাকাটা হাতে পাওয়ার পর আমার মতই কারা কষ্টে আছে তা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। আত্মীয়-স্বজন কেউ কষ্টে নেই। মামা-কাকারা খুব বেশী ভালো আছে। বাবার রহস্যজনক অকালমৃত্যুর পর কোনোমতে বিষয়টা ধামাচাপা দিয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করে দিয়ে তাঁরা আমাদের খোঁজখবর নেননি আর। এখন সুদিনে অনেকেই যোগাযোগ করতে চায়, কিন্তু আমি আর আগ্রহ পাই না। না খেয়ে যে দিনরাতগুলো কাটিয়েছি, সেইসব স্মৃতি মনে পড়ে যায় আমার, মনে পড়ে তখন তাঁদের কোনো অবদান না রাখা অবদানের কথা।
তাহলে কার উপকার করা যায়? কার এখন টাকার খুব দরকার? কে খুব কষ্টে আছে? এমনটা ভাবতে ভাবতেই মনে পড়লো বাবার বন্ধু ঢাকাবাসী এক কবির কথা। কয়েক মাস তাঁর খোঁজ নেওয়া হয় না। আসলে এত অশান্তিতে থাকি, কয়দিকে খেয়াল রাখা যায় একা? তিনিও যে আমাদের খেয়াল রেখেছেন, বিপদের দিনে সাহায্য করেছেন তেমনটা না। কিন্তু তিনি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বাবা যাদেরকে খাইয়ে-পড়িয়ে মানুষ করে বিয়ে-থা দিয়েছেন, তারা অনেকেই যা করেন না।
যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। ফোন দিলাম কবিকে। কবি জানালেন, মনটা খুব খারাপ। একাকী জীবনযাপন করছেন, সাথে কেউ নেই। স্ত্রী-সন্তান এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে একা রেখে চলে গেছেন। জিজ্ঞেস করলে জানালেন রান্নাও করেননি, কিছু খাননি। মন খারাপ করে শুয়ে আছেন। বাবার সাথে তাঁর স্মৃতিচারণ শুনলাম। মা কেমন আছে জানতে চাইলেন। বিয়ে করতে বললেন। দুঃখপ্রকাশ করে বললেন, অনেক বঞ্চনা নিয়ে মারা গেছেন কবি বাবু ফরিদী।
তিনি বললেন, "কবি বাবু ফরিদী রা নেই বলেই আমি এতিম হয়ে গেছি"। জানালেন গবেষণাকাজে ব্যস্ত আছে, কবিতাপত্র প্রকাশনা আপাতত স্থগিত; বইয়ের প্রুফ দেখে কিছু আয় হয়, তা দিয়েই চলে। আক্ষেপ করে বললেন হাজার বিশেক টাকা পাওনা আছে প্রকাশকের কাছে, কিছু পাচ্ছেন না। বললাম, আমাকে তাঁর নাম, মোবাইল নম্বর দেন। কিন্তু তিনি ঝামেলা চাইলেন না, বললেন ভদ্রলোক নিজেও নাকি কষ্টে আছেন, টাকা হাতে এলেই দিবেন।
মনে হলো, তাঁর এই মন খারাপের রাতে আমার বাবাই উপর থেকে আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁকে একটা ফোন করতে। না হলে আমিই বা এতদিন পর তাঁকে ফোন করবো কেন? আমার বাবা এর চেয়েও বেশি কষ্ট করেছেন, কিছুই না পেয়ে অসময়ে মরেছেন। প্রতিবেশীর বাসা থেকে যখন তাঁর লাশ উদ্ধার হয়, তখন আমি নাবালক। এখন হাতে টাকা আসে-যায়, কিন্তু বাবার জন্য কিছু করতে পারি না। তাই মনে হয় বাবার বন্ধুদের জন্য কিছু করলেই সেটা বাবার জন্য করা হবে।
দীর্ঘ আলাপচারিতার পর বিকাশে তাঁকে এক হাজার টাকা ক্যাশ আউট চার্জসহ পাঠালাম। সাথে সাথেই ওপ্রান্ত থেকে ফোন এলো। ধরতেই কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম টাকা পেয়েছেন কিনা। তিনি বললেন, এ তো অনেক টাকা! বললাম, "আর মন খারাপ করে না থেকে এখনি দোকানে গিয়ে টাকাটা তুলে নিয়ে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভালো কিছু খেয়ে নিন। আমার জন্য আশীর্বাদ করবেন। তারপর বললাম, বাবাকে মনে পড়লে ফরিদপুর চলে আসবেন। খরচ সব আমার।"
ফোনের ওপ্রান্ত থেকে একটা নীরব কান্নার শব্দ যেন শুনতে পেলাম। এ শব্দ আমার জন্য আনন্দের। মহান স্রষ্টা যেন সারা জীবন আমাকে অন্যের জন্য কিছু করার সুযোগ ও সামর্থ্য দেন, কারো কাছে যেন হাত পাততে না হয়-- ঠিক আমার বাবা কবি বাবু ফরিদীর মত!
বিঃ দ্রঃ কমল কৃষ্ণ গুহ মুক্তিযুদ্ধের সময় গোপনে অস্ত্র বহনের সময় পাকি হানাদারদের হাতে ধরা খেয়ে নিজের ডাকনাম বাবুর সাথে ফরিদপুরকে ভালোবেসে ফরিদী টাইটেল দিয়ে নিজের ছদ্মনাম রাখেন বাবু ফরিদী। সেই থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি, সংগঠক, সাবেক সরকারি চাকুরে ও অ্যাডভোকেট এই নামেই আমৃত্যু পরিচত ছিলেন। ফরিদপুরে এসে একটা অনুষ্ঠানে বাবু ফরিদীর সাথে পরিচিত হয়ে নিজের মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে বানান শুধু একটু এদিক সেদিক করে একজন হয়ে ওঠেন শক্তিমান অভিনেতা আজকের হুমায়ুন ফরীদি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০২৪ রাত ১২:০৮