ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা সাহিত্যে এম এ সম্পন্নকারী আমার সহকর্মী কয়েকদিন আগে আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফোক ফেস্টিভ্যাল উপভোগ করে এসে আমাদের জ্ঞান বিতরণ করছেন - ওখানে না গেলে জীবন বৃথা , জানাই যাবে না কত বৈচিত্র্য লুকিয়ে আছে ভিনদেশী লোক সংগীতে ! আর আমাদের সংস্কৃতি হইল ফইন্নি মার্কা সংস্কৃতি --তিনি বাংলার সবকিছুতেই ফইন্নি ভাব খুঁজে পান । তার জন্ম আবার ভাটিয়ালী , জারি -সারি , সোজন বাদিয়া আর মহুয়া সুন্দরীর দেশে ! তার কথা শুনি আর মনে মনে ভাবি আহা যদি তাকে একবার দেখাতে পারতাম বাংলাসংস্কৃতির অপরূপ রুপ ----
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু !
আবহমান বাংলার সংস্কৃতিতে ধর্ম - বর্ণ নির্বিশেষে মেলবন্ধন ঘটেছে বিভিন্ন জাতির । বাঙালি সংকর জাতি হিসেবে পরিচিত হলেও এদেশের মাটির রূপ - রস -গন্ধে তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা , কর্মকে ঘিরে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার জুড়ি মেলা ভার । বলা হয়ে থাকে আমুদে উৎসব প্রিয় বাঙালির বারমাসে তের পার্বন । খুব বেশি দিন আগের কথা নয় মাত্র ২০-২৫ বছর আগেও বাংলার যে রুপ,লোকাচার আর সংস্কৃতি প্রাণভরে উপভোগ করেছিলাম কোথায় আজ সে সব !
চলুন পৌষের হিম হিম এবেলায় প্রথমেই দেখে নিই তের পার্বণের একটি !
চলছে পিঠা বানানোর প্রস্তুতি ---
গাছি শীতের সকালে বয়ে নিয়ে আসছে সুমিষ্ট খেজুর রস ।
ঢেঁকিতে বানানো হচ্ছে চালের গুঁড়ি - চাল কলের আগমনে হারিয়ে গেছে চমৎকার ছন্দময় এ যন্ত্রটি । হারিয়ে গেছে ভারানিদের গান । ছোটবেলায় দাদাবাড়িতে ঘুম ভেঙ্গেই কানে আসতো ঢেঁকির ধান ভানার শব্দ ।
শীতের পিঠা সম্ভার !
আছে গরম গরম ভাপা পিঠা --
পিঠা খেতে নাইওর আসছে মেয়ে - জামাইরা । ওকি গাড়িয়াল ভাইয়ের ভাওয়াইয়া গান , গরুর গাড়ির চাকার ছন্দময় আওয়াজ , গাড়োয়ানের হুরুর ডাকের শৈল্পিক শব্দও আর কানে আসে না । দাদাবাড়িতে বেড়াতে গেলে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতো গরুর গাড়ি - তা দেখে যে আনন্দ হতো এখন নতুন মডেলের কোন ঝকঝকে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেও সে পুলক আর জাগবে না ।
পালকি চলে হুহুম না , পালকি চলে হুহুম না - পালকির সাথে সাথে হারিয়ে গেছে কাহার সম্প্রদায়ও !
তোরা কে যাস রে ভাঁটি গাঙ বাইয়া , আমার ভাইধনরে কইও নাইওর নিত বইলা --তোরা কে যাস , কে যাস -----কানে আসে না আর ভাটিয়ালির উদাস গানের সুর ।
রাতের উৎসবে রয়েছে যাত্রা- পালার আয়োজন । আছে বাউল গানও ---
চলছে জামাই আদর ---
এ সময় আরও একটি অনুষ্ঠান হতো আধুনিক গেট টু-গেদার টাইপ । দাদাবাড়িতে(গাইবান্ধা) একে বলা হতো শাগাইমিলানি (শাগাই-মেহমান,মিলানি-মিলনী) । ছোট বেলায় দাদির সাথে এ রকম দুই - তিনটা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম ।
আছে মেলারও আয়োজন -----আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি ।
এত গেল শুধু এক পার্বণের বর্ণনা ! এবার চলুন সামগ্রিকভাবে দেখে নিই আর কি কি ছিল / আছে এ বাংলায় -
ভোজন রসিক বাঙালির পাত--
বাংলার পদ্মার বিখ্যাত ইলিশ তাই দিয়ে ইলিশ পাতুরি , ইলিশ ভাজা আর মজার মজার ভর্তা। খাবারে এত বৈচিত্র্য আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই ।
বাঙালির সাজপোশাক -
এ অপরূপ সাজ আর এত রঙ , ঢঙ কোথায় মিলে !
পোশাক শিল্পে বাঙালির পারদর্শিতা সেই আদ্যিকাল থেকে -
মসলিনতো সেই কবেই হারিয়ে গেছে ! সগর্বে এখনও টিকে আছে জামদানি আর ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে তা বয়ন শিল্পে ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেের তালিকায় স্থান লাভ করে।
বাংলার নকশীকাঁথা -
আমাদের মৃৎ শিল্প -
ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল !
বাঙালির খেলাধুলা -
খা খা খা বক্কিলারে খা --- দেশদ্রোহীরে খা !
আমাদের গর্ব -
ফকির লালন শাঁ - যার গান আমাদের এনে দিয়েছে বিশ্ব পরিচিতি , লাভ করেছে ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা । এছাড়াও রয়েছে সিলেটের মরমী সাহিত্য ,ভাওয়াইয়া ,ভাটিয়ালি , গম্ভীরা ,কবিগান ,জারিগান, মৈমনসিংহ গীতিকা ,পূর্ববঙ্গ-গীতিকা , সিলেট গীতিকা , লোকগল্প প্রভৃতি ।
সর্বশেষ ঐতিহ্যবাহী পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা । ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা বা ইনট্যানজিবল (ইং: Intangible ) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে । ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শান্তি, গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতিসত্বার ঐক্যের প্রতীক। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে বছরের প্রথম দিনে ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’’ মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ কল্যাণময় ভবিষ্যতের আশা ব্যক্ত করে চলেছে। এমন সৌহার্দ্য -সম্প্রীতির বন্ধন আর কোথায় মেলে !
ছোটবেলায় রচনায় পড়তাম - ' দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য , লও হে এ নগর ' অথবা , ' বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ , কেড়ে নিয়েছে আবেগ ' - তখন এ কথা গুলোর মর্মার্থ বুঝিনি । এখন বুঝি জীবনে গতি আনতে আর সুসভ্য হতে আমাদের কি কি বিসর্জন দিতে হয়েছে । আসুন বিজয়ের এ মাসে সবাই একবার ফিরে যাই শিকড়ের কাছে , মাটির টানে ---
'ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায়
হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে---যায় জুড়িয়ে-- এ---
ও আমার বাংলা মা ----'
ছবি : অন্তর্জাল
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:২৪