সাড়ে তিন হাত মাটির ঘর বনাম ১৭৫০ বর্গফুট
লোকে বলে বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার
কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার।।
ভালা কইরা ঘর বানাইয়া
কয়দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
পাকনা চুল আমার।।
এ ভাবিয়া হাসন রাজা
ঘর-দুয়ার না বান্ধে
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
তাই ভাবিয়া কান্দে।।
জানত যদি হাসন রাজা
বাঁচব কতদিন
বানাইত দালান-কোঠা
করিয়া রঙিন।।
---- দেওয়ান হাছন রাজা
চাকরিসূত্রে আমার বর্তমান আবাসস্থল ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি কবরস্থানের পাশে নির্মিত সুউচ্চ ভবনে । বাসার প্রায় তিন দিক ঘিরেই কবরস্থান - জানালা , বারান্দা যেখানেই দাঁড়াই না কেন চোখে পড়ে নীচের সারি সারি ছোট ঘরগুলো । বাসায় ওঠার আগে বেশ ভয় ভয় লাগলেও ধীরে ধীরে সয়ে গেছে । আর এখনতো রীতিমত রুটিন করে সকাল - দুপুর - রাত নিজে থেকেই কবরগুলোর খোঁজ-খবর নিই । মাঝে মাঝে বারান্দায় বসে ভাবি আমি যেমন কবরগুলো নিয়ে উৎসুক , কবরে শায়িত মানুষগুলোও কি আমাকে দ্যাখে - কেমন আছে তারা সেখানে - আমার এই বালখিল্য দেখে কি হাসে অথবা এখানকার প্রাণপ্রাচুর্যে ঈর্ষান্বিত হয় , আমার ঘর থেকে ভেসে যাওয়া পরিচিত গানের সুর , রান্নার সুঘ্রাণে তারা কি আর উদ্বেলিত হয় ? এই সুউচ্চ ভবন যেমন জীবনের কোলাহলে মুখর - পাশের কবরস্থান ঠিক তার বিপরীত শান্ত-স্নিগ্ধ শ্যামলিমায় শায়িত মানুষগুলো জীবনের সব হিসাব -নিকাশ মিটিয়ে মনে হয় পরম শান্তিতেই ঘুমিয়ে আছে ।
বারান্দায় বসে মাঝে-মাঝে দেখি দাফনের আনুষ্ঠানিকতা । যদিও বলা হয়ে থাকে মৃত্যুর পর সবাই এক - কবরের মাপ এক ,আনুষ্ঠানিকতা এক , সবাই আসে সাদা কাপড়ে । তারপরও জনসমাগম , কবরের সাজসজ্জা দেখে বোঝা যায় এখানেও রয়েছে বিভেদ । মাঝে -মাঝে বিশেষ ব্যক্তিদের দাফনের সময় দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা । তখন শান্ত - নিস্তব্ধ কবরস্থান সেনা সদস্যদের বুটের ভারে সরব হয়ে ওঠে । দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে তাদের মহড়া ।অত:পর শবযাত্রীগণ পৌঁছালে শুরু হয় মূল আনুষ্ঠানিকতা । কবরস্থানের শান্তি বিঘ্ন করে তোপ ধ্বনির মাধ্যমে জানানো হয় সশ্রদ্ধ সালাম ( মনে প্রশ্ন জাগে কবরস্থানে এর যৌক্তিকতা কতটুকু ,পবিত্র কবরস্থানের শান্তি ভঙ্গ করার অধিকার কি তাদের আছে ? এই আনুষ্ঠানিকতাতো অন্য যে কোন খোলা প্রাঙ্গণেই সেরে ফেলা যায় ) ।
মৃত্যুর পর মানুষ এই সাড়ে তিন হাত মাটির আবাসই মেনে নেয় । জীবনের আর কোন প্রাচুর্যের কোন অবকাশ সেখানে থাকেনা । অথচ জীবদ্দশায় ১৭৫০ বর্গফুটেও তার প্রাচুর্যকে ধরে রাখতে পারেনা - অপর্যাপ্ত মনে হয়। নিজেদের শৌখিন জিনিসপত্র দিয়ে ঘর সাজিয়ে সরকারী আসবাবপত্র ফেলে রাখে খোলা জায়গায় ! আমাদের শুধু চাই আর চাই - আমাদের উচ্চাশার সাথে পাল্লা দিয়ে উল্লম্বিক ভাবে বেড়েই চলেছে সুউচ্চ ভবনের সংখ্যা । একটু কষ্ট করে নীচে তাকালেই চোখে পড়ে - আনুভূমিকভাবে ভাবে বেড়ে চলা ছোট ঘরগুলোও কিন্তু থেমে নেই ওখানেও ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়ছেই !
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৬ সকাল ১১:৪৫