ভাঙা জীবন.....(১)
সময় যেন আর কাটে না । মাঝে মাঝে মনে হয় এই জীবনের সকল চাওয়া পাওয়ার পরিসমাপ্তি টানি । সুখ কে যেখানে নিজের হাতে গলা টিপে হত্যা করেছি সেখানে আর কাকে আমি দায়ি করিব । কার কাছে চাহিবো জবাবদিহিতা । ভালবেসে বিয়ে করে ছিলাম সংসারে সকলের অবাধ্য হয়ে । সেই এক জ্বালা আবার মায়া দেখিয়ে ঘরে তুলেছিলাম অসহায় বান্ধবীকে । আজ সে সহায় আর আমি নিজেই অসহায় ।
পারু তার অতীত দিন গুলির কথা বেলকনিতে পাতানো ইজি চেয়ারে বসে টবে নুয়ে পড়া সূর্যমুখী ফুলের সাথে শেয়ার করে । বলে সূর্যি সব ফুলই তো সুন্দর । সবই তো ফুটে তার সৌন্দর্য শোভায় ভ্রমরের মনে আলিঙ্গন করতে । আর তাতেই তার সার্থকতা । সে আর কয় জনের ভাগ্যে জোটে ।
দেখিস না বেলি সাধারণ একটি ফুল । যে নীরবেই ঝরে পদ দলিত হয় । আর তার কি কদর । সাধারন বেলি হয়ে উঠে অ সাধারণ । ডালায় ডালায় সাজে । ফুল থেকে হয়ে উঠে মালা । বিনিময় হয় প্রেমের আলিঙ্গনে । দুটি প্রাণের স্পন্দন ঘটায় ।
আর এই তুই সূর্যমুখী তোর দেহে কত কারোকাজ । কত সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস । কেউ তোকে ফিরেও দেখে না । জানিস আমার কপালটাও না তোর মত । রুপে গুনে অন্য দশ টা মেয়ের চেয়ে কম নেই আমার তবু জীবনভর শুধু হতাশা আর হতাশা । কষ্ট আর কষ্ট । নীরব বেদনা আমার দেহ মন আজ বড়ই সিক্ত ।
প্রাচীর ভেদে আমি পথ খুঁজি বাঁচিবার । কোন পথ পাইনা । যে পথেই তাকাই শুধু কণ্টকময় । কেন যে জীবনটা এমন হল । কারো মনে প্রশ্নও রাখতে পারি না । সবাই বলে আমি কেন ভাগ্যকে দোষ দেই সব দোষই নাকি আমার নিজের ।
ভাঙা জীবন.....(২)
গভীর রাত । নীরব শহর । পারু বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছে বিস্তীর্ণ আকাশ টাকে । কি সুন্দর সুনীল গগণ,তারা গুলিও বড় নিবিড়তায় ঘুমিয়ে পড়েছে । সারা দিনের কর্ম ব্যস্ততা কাটিতে শহরের মানুষ গুলোও ঘুমিয়ে । ঘুমিয়ে পড়েছে শহরের প্রতিটি দানাল কোঠা । পারুর চোখে ঘুম নেই । ভাবে তার মত এই সুন্দর শহরটিতে আরেক টা হৃদয় আছে কিনা যার অস্তিত্ব জোড়ে শুধু কষ্ট আর কষ্ট । যার চোখের পাতা ভরিয়ে থাকে শুধু বেদনার লোনা জ্বলে ।
আসলে এই পৃথিবীতে সবাই কি এক সময় স্বার্থপর হয়ে যায় ? ভাই বোন বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন খেলার সাথী সবাই কি শুধু সুখের দিনেরই বন্ধু হয় ? পারুর মনে নানা রুপ প্রশ্ন । কোন উত্তর খোজে পায় না । বেলকনিতে পাতানো ইজি চেয়ারটাই যেন তার এখন একমাত্র প্রিয় বন্ধু । প্রিয় সাথি । মাঝে মাঝে ভাবে এও হয়ত চলে যেত পাশ কাটিয়ে ঘৃণা,অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নিত কিন্তু স্থবিরতাই হয়ত তাকে তার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে । ফেস বুকের পাতায় চোখ রাখে পারু । চেট করে । সুরুটাতে সব বন্ধুদের সহমর্মিতা পায় তার মনের কষ্ট গুলো একটু হলেও লাঘব হয় । সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে । কেউ আবার কাটা ঘায়ে দিয়ে বসে নুনের ছিটা । যেদিন তার জীবণটাতে সুখ কানায় কানায় ভরপুর ছিল সেদিন যারা তার সাথে কথা বলত সে দিনের কথা আর আজকের কথা বলার মাঝে যেন সে আকাশ পাতাল ব্যবধান খোজে পায় । অবাক হয়। নীরব আধারে একা একা ভাবে মানুষ কত বিচিত্র হতে পারে । কত বিচিত্র হতে পারে মানুষের মন। প্রকৃতির রুপ পালটায় হয়ত নিয়মে মানুষের রুপ পাল্টানোর যেন যখন তখন ।
সেদিন সারা দিন পারুর মনটা খারাপ ছিল । কারো সাথেই খুব একটা কথা হয়নি তার । জীবনটার প্রতিও তার্র বি-তৃষ্ণা ছিল চরমে। হঠাত খুব কাছের বান্ধবী মিতা রাত বারটা দশ মিনিট ফোন দেয় । অনেক দিন তার সাথে পারুর কোন যোগাযোগ নেই । কারন পারুর হাসবেন্ড সম্পর্কে মিতা কি যেন একটা কটুক্তি করেছিল বলেই সে থেকে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন ।
পারু ভালবেসে বিয়ে করেছে । নর মাংসের সাদ পেলে একটা ক্ষুধারত বাঘের যেমন দশা হয় পারুর যেন তাই হয়েছিল । সবার চোখে স্বামী রুমনের খারাপ দিকটা ধরা পড়লেও পারুর চোখে স্বামী রুমন যেন ছিল ফেরেস্তার মত । স্বামী সম্পর্কে আপন পর যেই কিছু বলতে যেত পারু যেন ধুলায় মিশিয়ে দিত । প্রয়োজনে সে দীর্ঘ দিন তার সাথে কোন রুপ যোগাযোগই রাখতো না । সব কিছু অস্বীকার করলেও পারু একটি বিষয় কে মনে প্রাণে স্বীকার করত যে তার অন্যান্য বোন জামাইদের চেয়ে স্বামী রুমনের অবস্থা তুলনামূলক একটু খারাপ । তাই পারু দিনের পর দিন রাতের পর রাত লেখা পড়ার পাশাপাশি টিউশনি করিয়ে উপার্জনের সমস্ত টাকা স্বামী রুমনের হাতে দিত ।
পড়া লেখায় যথেষ্ট ভাল পারু । পঞ্চম শ্রেনীতে টেলেন্ট পুলে বৃত্তি অষ্টম শ্রেণীতেও টেলেন্ট পুলে । এসএসসিতে গুল্ডেন এ প্লাস । ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার দশ দিন আগে হল ট্রাইফয়েড জ্বর । জীবন বাঁচাতে ডাক্তারের পরামর্শে সেবার আর পরীক্ষা দেওয়া হল না । মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে পারু বেঁচে উঠল । প্রস্ততি চলল পরবর্তী পরীক্ষার । পরীক্ষা হল । রেজাল্টও হল আশানুরূপ । গুল্ডেন এ প্লাস ।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস । সকল রেজাল্ড ভালর পরও পারুর আশা পুরণ হল না । সেজ বোন ডাক্তার । ঢাকা মেডিক্যাল থেকে পাশ করা এখন সে বড় ডাক্তার । পারুর ইচ্ছা ছিল তার মত একজন নামি দামি ডাক্তার হয়ে মায়ের আশা টা পূরণ করবে । অভাগা যে দিকে চায় সাগর যেন শুকিয়ে যায় । মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোথায়ও চান্স হল না ।
অবশেষে ইংলিশ অনার্সে ভর্তি হল ঢাকা কলেজে । একে একে অনার্স মাস্টারস কমপ্লিট করল । এখানেও রেজাল্ড ভাল হল । সেকেন্ড ক্লাস পেল । মনে পুনরায় আশা বাঁধল বিসিএস দিয়ে ভাল সরকারী কোন এক গেজেটেড কর্মকর্তা হবে । পরপর বিসিএস দিয়েও তার ভাগ্যে আশানুরুপ ফল জোটল না ।
ভাগ্যের সাথে পাল্লা দিতে লাগল পারু । জীবন কে ধাপিত করল অন্য মোহনায় । বাবা মা ভাই বোন সকলে ভাল নামিদামি পাত্রের সন্ধ্যান করতে লাগল । পারু তাতে রাজি হল না । কত সু- দর্শন ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসার । ঢাকায় সু প্রতিষ্ঠিত নামি দামি ব্যবসায়ী । বিলেত বসবাসরত বাংলাদেশী নাগরিক । কোন টাই পারুর যেন ভাল লাগল না । একে একে সকলের মন থেকে বের হতে লাগল । এক সময় পরিবারের সকল কে সরাসরি জানিয়ে দিল তার বন্ধু রুমন কে ছাড়া সে আর কাউকে বিয়ে করবে না ।
এই নিয়ে পরিবারে সবার মধ্যে শুরু হল বাক বিতরক্য । মেঝ বোন শেপু আর তার মমতা ময়ি মা রাবেয়া খানম ছাড়া আর কেউ পারুর এই সিদ্ধান্তে রাজি হল না ।
এক পর্যায়ে পারু সকলের সীদ্ধান্ত কে নস্যাত করে গুপনে বিয়ে করে ফেলল ।
অনেক বাক বিতর্কের পর বিয়ে টা সকলে মেনে নিলেও ভাঙ্গা মনে যেন আর জোড়া লাগল না । যতটুকু চলতো তত যেন ফরমালিটি ছাড়া আর কিছু না । পারু বুঝতে পারল ।
ভাঙা জীবন.....(৩)
পারু অবহেলিত স্বামীর প্রতি আন্তরিক হয় । তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উঠে পড়ে লাগে । সংসারে যেখান থেকে যে ভাবেই যা পায় সব দিয়ে স্বামী রুমন কে সহযোগীতা করার চেষ্টা করে । সহজ সরল পারুর একটাই আশা একটাই সপ্ন তার সকল বোনদের সারিতে নিজেকে দাড় করাতেই হবে । ভাল বেসে না হয় এক দরিদ্র ছেলেকে বিয়ে করেছে পারু । আর তাতেই কি জাত গেছে । আজ পরিবারের সকলেই তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে । মুখে দু একটি কথা হলেও অন্তরে অন্তরে যে সবাই তাকে ঘৃণা করে শিক্ষিত পারু তা বুঝতে আর বাকি রাখে না । সব চেয়ে বেশি অবাধ্য পারুর সেজ বোন ডাক্তার নীলা । একদিন সে ছোট বোন পারু কে যেমন মন থেকে খুব বেশি ভাল বাসত এহেন ঘটনার পর সে যেন মন থেকেই তেমনি খুব বেশি ঘৃণা করতে শুরু করেছে ।
চলব..........
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৬