নাজমুল সাহেব চলে গেলেন।কিন্তু চলে যাবার পর নাজমুল সাহেবকে ব্রেকফাস্ট করতে বলার সৌজন্যতা টুকু না দেখানোয় নিজেই কিছুটা লজ্জিত হলাম।নিশ্চয়ই নাজমুল সাহেবেরও কিছু খাওয়া হয়নি! ধ্যাৎ!
দিনদিন এত বোকা হয়ে যাচ্ছি ভাবতেই পারিনা।
যাই হোক, কুদ্দুস মিয়া ততক্ষণে আবার সামনে চলে এসেছে।
"স্যার, আপনে তো এখনো কিছু খান নাই। ভাত আবার গরম করে টেবিলে দিছি।চলেন খাবেন। "
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "কুদ্দুস মিয়া,তোমরা খাইছো তো? "
কুদ্দুস মিয়া এক গাল সরল হাসি মুখে নিয়ে বলল,"না স্যার।আপনে না খাইলে খাই ক্যামনে? আপনে যদি না খাইয়া থাকতে পারেন, আমরা পারবো না ক্যান! "
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "আশ্চর্য! তাই বলে কি না খেয়ে থাকবা? প্রতিদিন এরকম করো নাকি!এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকো? "
কুদ্দুস মিয়া তার সহজাত সরল হাসি মুখে টেনে বলল,"স্যার,আপনে তো প্রতিদিন সকাল সাতটার মধ্যে নাস্তা করেন। আমরাও তাই করি।আপনেক খাওয়াইয়া তারপর খাই। আমরা আপনার ভৃত্য তবুও আপনি যা খান আমরাও তাই খাই,এটা যে কতবড় মেহেরবান তা আপনেক বুঝাইবের পারবো না।"
আমি ওর কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গেলাম । এরা কেউই আমি না খেলে খায় না।
আজ প্রায় ত্রিশ বছর ধরে কুদ্দুস মিয়া আমার বাসায় কাজ করে।আমি ওকে ছোট ভাইয়ের মতই দেখি।দেশে বিদেশে যেখানেই যাই এ বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব ওর হাতে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকি। অনেক বেছে বেছে ওর জন্য পাত্রী দেখে বিয়েও দিয়েছিলাম।তাও প্রায় পচিশ বছর হলো। ওর বউও থাকে সাথে।বাচ্চা কাচ্চা নাই, দুজনের সংসার।বাচ্চা হয়না। অনেকবার বলেও ছিলাম, বাচ্চা কাচ্চা দত্তক নিতে।নেয় নাই।
দুজনের একই কথা,"স্যার, আমাদের ছেলে মেয়ে দিয়ে কি হবে! সৌমিক বাবাজীই আমার ছেলের মত । এ বাড়িতে ঢুকে সৌমিক বাবাজিকে দেড় বছরের পেয়েছিলাম। ও থাকতে আমার ছেলে মেয়ের কি দরকার! "
সত্যিই তাই।কুদ্দুস মিয়া আর ওর বউ মালতি সৌমিককে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। সৌমিকের বয়স যখন কেবল আট তখন আমার স্ত্রী ইহলোক ত্যাগ করে।আমি তখন কেবল মেজর পদে। বিশেষ ক্ষমতায় ন্যাশনাল সিক্রেট সার্ভিসে বদলি হয়েছি । মিরার মৃত্যুর পর সৌমিকের ভবিষ্যৎ এর দিকে তাকিয়ে আমি আর বিয়ে করিনি ।কিন্তু কাজের চাপে বাহিরে বাহিরে থাকতে হত প্রায়শই । তখন কুদ্দুস আর মালতিই আমার সৌমিককে মানুষ করেছে। সৌমিকের স্কুল থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়া,আদব কায়দা সবকিছু শিখিয়েছে ওরা দুজন। আমি ওদের পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিলাম,যদি সৌমিক দুষ্টোমি করে তবে শাসন করার।প্রয়োজনে গায়ে হাত তোলার। কিন্তু কখনো তা প্রয়োজন হয়নি।মা হারা সৌমিক এত ভদ্র, নম্র এবং মেধাবী ছিলো যে যেখানেই যেত প্রশংসা কুড়িয়ে আনতো।নিজের ছেলেকে নিয়ে এত বড় গর্বের আর কি হতে পারে! আর সৌমিকও কুদ্দুস চাচা আর মালতি আন্টির জন্য পাগল।
বছর সাতেক আগে সৌমিক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্কলার্শিপ নিয়ে যখন আমেরিকায় গেলো সেদিন যেন এ বাড়ি এক মৃত বাড়ির মাতম তুলেছিলো। সৌমিকও তার দায়িত্ব, কর্তব্য কখনো ভুলে নি। আমেরিকা গিয়ে ওখান থেকে প্রতি দুদিন অন্তর অন্তর ফোন করে সবার সাথে কথা বলত।আর চাচা-চাচীর সাথে তার কথা বলাই চাইই চাই । এখন পর্যন্ত সে নিয়মের এতটুকু ব্যত্যয় ঘটেনি। দেশে ফিরলে বাড়ির সবার জন্য এটা সেটা নিয়ে এসে ভর্তি করে।এমন ছেলেকে নিয়ে বাবা হিসেবে স্বাভাবিক ভাবেই আমি গর্বিত,শুধু গর্বিত বললে ভুল হবে,ভীষণ গর্বিত।
কিন্তু কুদ্দুস মিয়া যে আমি না খেলে খায় না এটা শুনে খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। ওকে ধোমক দিয়ে বললাম,"আমি খাই বা না খাই, তোমরা কখনো উপোস থাকবে না।
আর যাও,আমি আসিতেছি।"
#
বিকেল তখন পাচটা। নাজমুল সাহেব ফোন করলেন।আমি তখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি।
ফোন ধরতেই নাজমুল সাহেব সালাম দিয়ে বললেন,
"স্যার, পোশমর্টেম রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। দুপুরেই অয়নের লাশ ওর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
রিপোর্ট বলছে,অয়নের মৃত্যু ছুড়িকাঘাতে হয়নি বরং তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।এবং খুনি পেশাদার বলে মনে হয় না ।পেটে এবং বুকে যে ছুড়ি মারা হয়েছে তাতে মৃত্যু হবার মত ক্ষত হয়নি।বরং মৃত্যু হবার পরে তাকে ছুড়িকাঘাত করা হয়েছে। কিন্তু কোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি।গামছা জাতীয় কিছু দিয়ে শ্বাসরোধ করা হয়েছে।"
"আর, উপর থেকে প্রচন্ড প্রেশার আসছে স্যার।স্বয়ং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাহেব এ ব্যাপারে ফোন করেছিলেন।উপর মহল আমার উপরেই তদন্তের ভার দিয়েছে।"
আমি বললাম, "তো,পরিবারের সবাইকে জিজ্ঞাসা বাদ করেছো? তারা কি কাউকে সন্দেহ করে? "
নাজমুল সাহেব কিছুটা হতাশ হয়ে বললেন,"হ্যা স্যার,জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা কাউকেই সন্দেহ করে না।এমনকি অয়নের দু একজন যেসব বন্ধু ছিলো তাদের কেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কিন্তু তারাও কিছু বলতে পারছে না । আর স্যার,অয়ন আসার দিন ল্যাপটপ নিয়ে আসেনি। ল্যাপটপ তার ঢাকাতেই আছে। এমতাবস্থায়, তদন্ত আগানো খুব মুশকিল। তারপরেও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি খুনের মোটিভটা শনাক্ত করার জন্য।"
আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললাম,"ওকে, ক্যারি অন। দেখো কি হয়! কোন প্রয়োজন হলে আমাকে বলো।"
নাজমুল সাহেব ধন্যবাদ দিয়ে ফোন টা রেখে দিলেন।
একটু অবাক হওয়ার মত বিষয়। যার কোন শত্রু নাই,তেমন কোন বন্ধুও নাই,যে সারাক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত থাকে তার আবার শত্রু কে হতে পারে! কোথায় যেন কিছু একটা মিসিং হচ্ছে । কিন্তু কি সেটা? গার্লফ্রেন্ড? পারিবারিক সম্পত্তি? নাকি অন্য কিছু?
গার্লফ্রেন্ড নিয়ে কিছু হলে তার বন্ধুদের কেউ না কেউ কিছু না কিছু জানার কথা।আর পত্রিকা পড়ে যতটুকু জানলাম এবং ব্যক্তিগত ভাবে আব্দুর রহমান সাহেব কে যতটা জানি,তাতে পারিবারিক সম্পত্তি তে তো আর কোন অংশীদার নেই। তার বাপ দাদার সকল সম্পদের একমাত্র ওয়ারিশ সে।
তাহলে? আচ্ছা দেখা যাক।পুলিশ কি তদন্ত করে!
#৪
সেদিনের পর নাজমুল সাহেবের আর কোন ফোন আসলো না। প্রায় তিন মাস পার হয়ে গেছে ইতোমধ্যে । আমিও দৈনন্দিন ব্যস্ততায় অয়নের ব্যাপারে সব ভুলেই গেছিলাম।তার উপর প্রায় মাস খানেক আমেরিকায় সৌমিকের কাছে ছিলাম। তাই সব কিছু প্রায় ভুলেই গেছি।
আমেরিকায় এবার যাবার একটা বিশেষ উদ্দেশ্যও ছিলো। আমার ছেলে এবং তার প্রকৌশলী বন্ধু জিমি ও ডাক্তার বন্ধু রিচার্ড মিলে এমন একটা নতুন প্রযুক্তি আবিস্কার করেছে যা মানুষের শরীরের যে কোন অংশ বা নমুনা থেকে তার ডিএনএ শনাক্ত করতে সক্ষম তাও মাত্র ৯০ সেকেন্ডে। সৌমিক সেই ডিভাইসে ব্যবহৃত সফটওয়্যার তৈরি করেছে।এতে ডিভাইসটিতে নমুনা রাখা মাত্র তা এর ডাটাবেজে সংরক্ষিত যে কোন ডিএনএ এর সাথে ম্যাচ করে কিনা,তাছাড়া ডিএনএর বয়স ইত্যাদি নির্ণয় করতে সক্ষম। এবং ১০০% সঠিক উত্তর প্রদান করতে পারে।
এই নতুন ডিভাইস আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে।ফলে ছেলের সংবর্ধনায় পিতার নিমন্ত্রণ ছিলো ওর্গানাইজারদের পক্ষ থেকে।
তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো বাংলাদেশকে সেখানে হাইলাইট করতে পারা । প্রথম দশজনের মধ্যে বাংলাদেশি আরেকটা ছেলে ছিলো ইমতিয়াজ। তার উপস্থাপিত সফটওয়্যার যে কোন ওয়েবসাইট এর সিকিউরিটি ভেঙে ফেলতে সক্ষম এবং শুধু তাই নয় এটি এমন একটা হ্যাকিং টুল যা যে কোন ওয়েব সাইটের এড্রেস দেয়ার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয় ভাবে কাজ করতে পারে।
সফটওয়্যার এর নাম "কিংকোবরা"। আর যে ছেলেটা এটাকে প্রেজেন্ট করলো সে তৎক্ষনাৎ বিলগেটসের অনুমতিতে মাইক্রোসফটের ওয়েব সাইট হ্যাক করে ফেলে ভীষণ সারা ফেলে দিয়েছিলো ।
এটা খুবই উন্নতমানের কোডিং হলেও ঝুঁকি বিবেচনায় এবং সাম্ভাব্য অপব্যবহারের জন্য তাকে দশ নাম্বারে রাখা হয় এবং সফটওয়্যার দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলারে ইউএস গভঃমেন্ট সফটওয়্যার টি কিনে নেয় । এবং বলা হলো,যদিও ডেপেলপারের মেধা অসামান্য তাই তাকে সেরা দশে রাখা হয়েছিলো কিন্তু তার এই সফটওয়্যার আন্তর্জাতিক স্বার্থের জন্য হুমকিসরূপ বিবেচনা করে সফটওয়ার টি কিনে নেয়া হলো এবং এটি ব্যবহার করা হবে না বলে জানানো হয়।তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তাকে চাকরিরও অফার করে ।
তবে যাই হোক তখন মনে হয়েছিলো বাংলাদেশি একটা ছেলে যে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিতে পারে এটা বাংলাদেশের জন্য বড় পাওয়া।
কিন্তু অয়নের মার্ডার কেসের ব্যাপারে তিন মাসে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা আমি কিছুই জানতাম না,এমনকি জানার চেষ্টাও করিনি।হঠাৎ তিন মাস পর বাংলাদেশ ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স থেকে আমার এক সহকর্মী যে কিনা বর্ত্তমান NSI চীপ, সে ফোন করলো ।
ফোন করেই বলল,"ইজ ইট কর্ণেল.মিথ?
আমি বললাম, ইয়েস। হু ইজ ইট?
ওপাশ থেকে প্রতিউত্তর এলো," আমি কারাগার থেকে পিজিওন(Pigeon) (এটা বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত নাম) বলছি । ওর এরকম ছদ্ম নাম ব্যবহার দেখেই সন্দেহ হলো ।
বললাম,"ইয়েস মি.পিজিওন। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ? "
-"আই নিড টু মিট ইউ ইমেডিয়েটলি। Would you please give me some times? "
ওর গলার স্বরে নার্ভাসনেস কাজ করছে বুঝতে পারছি।
বললাম,"Its okey but When and how? "
মি.পিজিওন ও পাশ থেকে বলে উঠলেন,"I'm on the way to Bogra. রাত আটটা নাগাদ পৌঁছে যাবো।সমস্যা হবে কি? "
আমি বললাম, Its okey. No problem . I'll be very happy .যখন খুশি চলে আসুন।"
-"থ্যাংক ইউ কর্ণেল।"
ফোনটা রেখে দিলো সে।কিন্তু আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম এটা ভেবে যে,হঠাৎ NSI এর আমাকে প্রয়োজন হলো কেন? আর কেনই বা মসিউর আমার সাথে ছদ্ম নামে কথা বলল? বড় কোন সমস্যা? কিন্তু এন এস আই এর প্রতিটি সদস্য এক একটা ট্যালেন্ট। এই অবসর প্রাপ্ত আর্মি অফিসার তাদের জন্য কি করতে পারে।আমি নিজেও সিক্রেট সার্ভিসে ছিলাম আর জানি কতটা চৌকশ অফিসার রা এখানে আসতে পারে!
যাই হোক,
মসিউর না আসা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না আসলে ব্যাপারটা কি? আর আমাকেই বা প্রয়োজন কেন??
Will be continued..
নীলকান্ত®
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:০২