কর্ণেল মিথঃ শেষ রাতের খুন -পর্ব ২
---------------------
শেষ রাতে ঘুমানোর পর যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়ির কাটায় ঠিক দশটা। জানালার পর্দা ফুরে সকালের সূর্যটা আমার ঘরের দেয়ালে লুকোচুরি খেলছে।এদিকে রাতের ঘটনা প্রায় ভুলেই গেছিলাম । কিন্তু বাহিরের শোরগোল শুনে মনে পড়ে গেলো।হাত বাড়িয়ে টেলিফোন টা হাতে নিয়ে নীচে দাড়োয়ান কে ফোন করলাম।নাজমুল এসেছিলো কিনা জিজ্ঞাসা করতেই দাড়োয়ান জানালো,"স্যার, ও সাহেব ত এক ঘন্টা আগে এসে বসে আছে। আপনে ঘুমায়া আছেন দেইখ্যা ডাকে নাই।"
মনে মনে বললাম, ভাল করেছে। তারপর ওসি কে ভিতরে পাঠাতে বলে আমি ফ্রেশ হতে গেলাম।
ড্রইং রুমে আসতেই দেখি নাজমুল সাহেব সোফায় বসে কি যেন ভাবছেন । এয়ার কন্ডিশনেও দরদর করে ঘাম ঝড়ছে কপাল বেয়ে ।এক হাতের আঙুলের মধ্যে আরেক হাতের আঙুল দিয়ে কচলাচ্ছেন।এটা নিশ্চিত টেনশনের লক্ষন অথবা প্রচন্ড উত্তেজনা প্রকাশ করছে। বুঝতে বাকি থাকলো না,কিছু একটা গরমিল হয়েছে।এবং প্রচন্ড প্রেশারে আছে সে।
আমি ওকে সম্বোধন করে বললাম, "কি খবর নাজমুল, তারপর সব ঠিক ঠাক আছে তো? "
আমাকে দেখেই দাড়িয়ে সালাম জানালেন।
"কর্ণেল মিথ, ঠিক ঠাক কিছুই নেই।একটু ঝামেলায় পরে গেছি। "
বললাম, "কিসের ঝামেলা? এসব খুন খারাবি তো অহরহ ঘটছে নতুন কি! কেস ফাইল করো তারপর তদন্ত করতে করতে অপরাধী খুঁজে না পেলে ফাইল বন্ধ করে দাও।এ আর এমন কি? "
ওকে বসতে বলে আমিও সামনের সোফায় বসলাম।আমার বাসার কাজের লোকটাকে দু কাপ চা আনতে বলে নিজের সিগারেট টা ধরিয়ে বললাম, "তা বল,কিসের ঝামেলা।"
নাজমুল একটু বিচলিত হয়ে বলল,"স্যার, যে ছেলেটা খুন হয়েছে সে বিখ্যাত ব্যবসায়ী রহমান ট্রেডার্সের মালিক আব্দুর রহমানের একমাত্র ছেলে। শহরের জলেশ্বরী তলাতেই বাসা। ঢাকায় একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকুরী করে।গতকাল সে বিকেল আনুমানিক পাঁচটায় শেষ বারের মত বাসায় ফোন দেয়।যখন সে ফোন দিয়েছিলো তখন সে শেরপুর পার হয়েছে বলে জানায়।
স্বাভাবিক ভাবেই আধা ঘন্টা থেকে পৌনে এক ঘন্টার মধ্যে বাসায় ফেরার কথা।"
-হুম তারপর।
নাজমুল সাহেব বলতে শুরু করলেন, "কিন্তু সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেলেও সে বাড়িতে না আসায় বাড়ির লোকজন চিন্তায় পড়ে যায়।
ওহ, তার আগে বলে নেই ছেলেটার নাম অয়ন।এক পা খানিকটা খোঁড়া। কিন্তু খুঁড়িয়ে হাটলেও বুঝার উপায় নেই"
আমি বললাম, "হুম ডান পা।"
নাজমুল বলে উঠলেন,"স্যার,আপনি কি করে জানলেন? আপনি তো ওকে চিনেনই না।"
এরই মধ্যে কুদ্দুস মিয়া(আমার কাজের লোক) চা নিয়ে হাজির। টেবিলের উপর দু কাপ চা রেখে চলে গেলো।
নাজমুলের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বললাম,"নাও চা খাও।
ও হ্যা,কি যেন বলছিলে? কি করে জানলাম সে খোঁড়া! হা হা হা।
শোন নাজমুল, সাতাশ বছরের সার্ভিস লাইফের অভিজ্ঞতা থেকে যেটা সবচেয়ে বেশি শিখেছি তা হলো "পর্যবেক্ষণ" করা। আমাদের আর্মিতে তোমাদের মত এসব কেস ফেস নাই বললেই চলে।অর্থ্যাৎ খুন খারাবির কেস আর্মি দেখে না।কিন্তু তবুও আমরা একজন মানুষের পায়ের নখ থেকে চুল পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে তার অতীত ভবিষ্যৎ বলতে পারি।
আর তাছাড়া জানোই তো,আমার রিটায়ারমেন্টের পর বেশ কিছু পুলিশ কেস সলভ করেছি।"
নাজমুল সাহেব কিছুটা নার্ভাসনেস কাটিয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। বলল,"হ্যা স্যার, আপনার কথা তো অনেক শুনেছি।পত্রিকায় আপনার নামও বেড়িয়েছে বহুবার। তবে প্রেসিডেন্ট রোহানীর স্ত্রী হত্যার কেসটা সমাধান করে সারা দেশ আপনাকে চিনে।"
-হা হা হা।আচ্ছা থাক সেসব।
"কথা হচ্ছিলো আমি কি করে জানলাম, ছেলেটা খোঁড়া, এই তো? "আমি প্রসঙ্গে ফিরে এলাম।
-হ্যা স্যার।
তাহলে শোন,"গতকাল ছেলে টার পায়ের জুতো দেখলাম ডান পায়ের গোড়ালিটা বাম পায়ের চেয়ে বেশি ক্ষয়ে গেছে।আর এপেক্স এর যে জুতো সে পড়ে ছিলো তার দাম বর্তমানে প্রায় আটহাজার টাকার চেয়ে একটু বেশি হবে হয়ত। এত দামি জুতো সাধারণ ঘরের ছেলেদের পড়বার কথা নয়।
আর তখনই বুঝেছি ছেলেটা খোঁড়া এবং কোন অভিজাত ঘরের ছেলে।"
নাজমুল সাহেব খানিকটা উৎফুল্ল হয়ে বলল,"রাইট স্যার।একদম ঠিক বলেছেন। "
আমি মুচকি হেসে বললাম,"তারপর বলো,সন্ধ্যার সময় অয়নের ফোনে কি বাড়ির লোকজন ফোন দিয়েছিলো? "
নাজমুল সাহেব ট্রেকে ফিরে গেলেন।"হ্যা স্যার।সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে অয়নের বাবা অয়নকে ফোন দেয়।প্রথমে একবার রিং হলেও পরের বার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।"
-হুম, তারপর?
-"তারপর স্যার, অয়ন সারা রাত বাসায় ফিরে না এলে আব্দুর রহমান সাহেব সকালে পুলিশ স্টেশনে এসে ডায়রী করে।আমি তখন থানায় ছিলাম না।
থানায় এসে ডায়রী করার কথা শুনেই রহমান সাহেব কে আমি ফোন দেই। তখন সকাল সোয়া আটটার কথা।
রহমান সাহেব দশ মিনিটে থানায় এসে হাজির হোন।তারপর আমি তাকে সাথে করে মর্গে নিয়ে গেলে উনি ছেলের লাশ দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠেন। আমি কোন মত শান্তনা দিয়ে উনাকে দুজন কনষ্টবলের সাথে বাসায় পাঠিয়ে দেই।উনি এমনিতেই বয়স্ক লোক তার উপর হার্টের রোগী। ভাবছি,উনার না আবার কিছু হয়ে যায়!! "
নাজমুল সাহেবকে একটু থামিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "লাশের সাথে কি কি পাওয়া গেছে?"
"স্যার, লাশের পকেটে মোবাইল ফোন,হাতে ব্র্যান্ডের হাত ঘড়ি,মানিব্যাগ, মানিব্যাগের মধ্যে দু'হাজারের মত টাকাও ছিল। তাছাড়া মানিব্যাগে একটা মেয়ের ছবি ছিলো যা ক্রেডিট কার্ডের পেছনে লুকোনো ছিলো।
মনে হচ্ছে না এটা ছিনতাই বা এ ধরনের কোন কেস।"
প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে নিয়ে ধরাতে ধরাতে বললাম,"সে আমি জানি।এটা ছিনতাই জাতীয় কেস না।সুপরিকল্পিত হত্যা।শুধু তাই নয়,এতে একাধিক ব্যক্তি জড়িত।"
নাজমুল সাহেব কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে জিজ্ঞাসা করল,"কিন্তু স্যার,আপনি এতটা শিওর হচ্ছেন কিভাবে? হতে পারে তাকে হত্যা করে তার ল্যাপটপ টা ছিনিয়ে নিয়েছে।কিংবা নগদ আরো অর্থ ছিলো সেগুলো নিয়েছে।মানিব্যাগ টাতে হাত দেয়ার আগেই কোন সমস্যার কারনে পালিয়ে গেছে? কিংবা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে হত্যা করেছে। "
-"এক্সাকটলি তাই।পূর্ব শত্রুতার কারনে হত্যা করা হয়েছে তাকে।এবং সুপরিকল্পিত ভাবে।"আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম।
ও কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "কিন্তু কিভাবে? "
আমি সিগারেট টাতে শেষ টান দিয়ে এশট্রে তে ফেলতে ফেলতে বললাম,"আচ্ছা, অয়নের পায়ে যে জুতো ছিলো তাতে সবুজ ঘাসের চিহ্ন ছিলো এবং গেঞ্জির ভেতরে যে ধানের পাতা ছিলো সেটা কি দেখেছো? "
নাজমুল মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো, "না।"
আমি বললাম, "ওর জুতোয় ঘাসের রং,কাদা আর বুকের উপর ধানের পাতা বলে দিচ্ছে ওকে এমন কোন জায়গায় খুন করা হয়েছে যেখানে ধান ক্ষেত আছে।এবং অপরাধীর সাথে বেশ কিছুটা ধস্তাধস্তিও হয়েছে।ফলে জুতোয় ঘাসের রং এবং গেঞ্জির সাথে ধানের পাতা আটকে রয়েছে।
যে রাস্তায় ওর লাশ পাওয়া গেছে তার আশে পাশে কি কোথাও ধানের ক্ষেত আছে? নাই।অতএব ওর খুনটা হয়েছে দূরে কোথাও।
এবার বলো, ২৫/২৬ বছরের স্বাস্থবান একটা যুবকের মৃত দেহ একজন মানুষের পক্ষে টেনে আনা এবং রাস্তার উপর ফেলে রাখা কতটুকু সম্ভব?
নাজমুল মাথা ঝাকিয়ে বলল,"নট পসিবল স্যার।আর তাছাড়া কিছু দুরেই মেইন রোড।সেখান দিয়ে সারা রাত অহরহ মানুষ চলে।মানুষের চোখের সামনে দিয়ে অপরাধী একটা মৃত দেহকে টেনে নিয়ে বোকামি করতে যাবে কেন? "
-"ঠিক ধরেছ।তাহলে নিশ্চয়ই খুনে অংশগ্রহণকারী একজন ছিলো না।অবশ্যই একাধিক ব্যক্তি যোগসাজশে খুনটা করেছে।আর যেহেতু একাধিক ব্যক্তির যোগসাজশ আছে এবং বিষয়টা ছিনতাই জনিত না অতএব এটি একটি প্লানড মার্ডার।
What do you think? "
-"You're absolutely right sir. Thank you sir , অন্তত কেসটার ব্যাপারে একটা তথ্য পাওয়া গেলো।কিন্তু খুনের মোটিভ টা কি হতে পারে তা কিছুতেই মাথায় আসছে না।
অয়নের বাবার সাথে কথা বলে যতটুকু জানলাম অয়ন খুব সাদাসিধে ছেলে ছিলো। কম্পিউটার ছাড়া ও কিছুই বুঝতো না। কোন বাজে ছেলেদের সাথে আড্ডাও দিত না। এবং ফ্রেন্ড বলতেও তেমন কেউ ছিলো না।সারা ক্ষন বাসাতেই থাকতো। "
-"খুনের মোটিভ সম্পর্কে পরে জানা যাবে।এত দ্রুত কেস সলভ করলে তো তোমাদের ডিপার্টমেন্ট এর বদনাম হবে! হা হা হা।একটু ধৈর্য্য ধরো।
আপাতত লাশের পোশমর্টেম টা হতে দাও।এবং ওর ফ্যামিলিতে জিজ্ঞাসাবাদ করো।
আর ও হ্যা,অয়নের মানিব্যাগের মধ্যে যে মেয়েটার ছবি ছিলো, সে মেয়ের সম্পর্কে খোঁজ নিতেও ভুলো না কিন্তু।"
দুপুর প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেছে।সকালে খাওয়া হয়নি এতক্ষন মনেই ছিলো না।কুদ্দুস মিয়া দু তিনবার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে আবার চলে গেছে।এতক্ষণে বুঝলাম ও হয়ত আমার খাবারের কথা বলতে এসেছিলো। কিন্তু কথা বলায় ব্যস্ত দেখে কিছু বলেনি।আসলে বয়স তো আর কম হলো না,প্রায় তেষট্টি চলছে।এ সময় একটু আধটু ভুলে থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না।কিন্তু আর্মিতে নিয়িমিত পিটি-প্যারেড,ড্রিল করতে করতে শরীর বুড়ো হয়নি এখনো,যতটা কুদ্দুস মিয়া পঁয়তাল্লিশ বছরে হয়েছে।
যাই হোক, আমি দুবার হাত ঘড়ির দিকে তাকাতেই নাজমুল সাহেব বললেন,"স্যার,এখন উঠি তাহলে।অন্য কোন প্রয়োজন হলে আবার আসবো কিন্তু। "
আমি ওর সেন্সে মুগ্ধ।খুব দ্রুত আমার মনের অভিব্যক্তি বুঝে নিয়েছে।এরকম জ্ঞানী লোকদের সবসময় কদর করি আমি।
হাত বাড়িয়ে বললাম,"বেষ্ট অব লাক। "
Will be continued..
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:৫৭