দৃশ্য ১-
সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা। বিছানায় পড়ে ফাহিম মরার মতো ঘুমাচ্ছে। রুমে হঠাৎ ডাকাডাকিতে কোন রকমে চোখ খুলে দেখে ওর ভাবী বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ওকে ডাকছে। ঘটনার কিছুই ও বুঝল না! এত সাত সকাল বেলা ওকে কি দরকার? রাতে ঘুমটা ভালো মতো হয়নি। চট্টগ্রাম থেকে বিকালে রওনা দিয়ে ঢাকায় ভাইয়ের এপার্টমেন্টে পৌছিয়েছে প্রায় রাত বারটায়। খেয়েদেয়ে ঘুমাতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। ঘুমে চোখ প্রায় খুলতেই পারছে না। কোন রকমে বেডে উঠে বসতেই ভাবী বলল-
-তোমাকে একটু নীচে যেতে হবে। রোদেলার একটা পেন্সিলও খুঁজে পাচ্ছি না। ও কান্নাকাটি করছে, স্কুলে যেতে চাচ্ছে না পেন্সিল ছাড়া। রাস্তার ঐ পাড়েই দোকান টা খোলা, যেয়ে দুই বা তিনটা HB বা 2B যা পাও পেন্সিল এনে দাও। সাথে একটা বড় পাউরুটিও নিয়ে এস সকালের নাস্তার জন্য।
-ভাইয়া কই?
-তোমার ভাই কেবল উঠেছে, রেডী হচ্ছে অফিসে যাবার জন্য।
রোদেলা হচ্ছে ফাহিমের একমাত্র ভাতিজি। এই রুম থেকেই ওর কান্নার শব্দ শুনা যাচ্ছে, না যেয়ে মনে হয় পার পাওয়া যাবে না। কোন রকমে ঢুলতে ঢুলতে বাথরুমে যেয়ে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলল ফাহিম। গায়ের গেঞ্জি চেঞ্জ করে হাফ স্লীভ একটা সার্ট গায়ে দিল। নীচে যে লুঙ্গি পড়ে আছে সেটার খেয়ালও নেই। বাসার দরজা খুলে বের হবে, এমন সময় ওর ভাবী আবার সামনে এসে বলল-
-নীচে ড্রাইভার চলে এসেছে, ওকে গাড়ির চাবিটা দিয়ে গাড়ি রেডি করতে বল। তুমি পেন্সিল নিয়ে আসলেই, তোমার ভাইয়া রোদেলাকে নিয়ে বের হবে।
ভাবীর হাত থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বাসা থেকে বের হল ফাহিম। লিফটের কাছে যেয়ে দেখল, বন্ধ। সাড়ে সাতটা এখনও মনে হয় বাজে নি। এর আগে লিফট ছাড়বে না। ধ্যাত, এখন আবার সিড়ি দিয়ে নামতে হবে। তিন স্টেপ সিড়ি দিয়ে নামার পর ফাহিমের খেয়াল হলো যে ও লুঙ্গি পড়ে আছে। ঘুমে এমন আলসেমী লাগছে ওর যে আবার বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। ধুর, এত সাত সকাল বেলা কে দেখবে? হাতে গাড়ীর চাবি নিয়ে চার তলা থেকে সিড়ি দিয়ে নামা শুরু করল। তিন তলা শেষ করে কেবল দুই তলার অর্ধেক পার হয়েছে, এমন সময় পিছন থেকে মেয়েলি কন্ঠের ডাক শুনল ফাহিম। কাকে ডাকে? সিড়িতে তো ও ছাড়া আর কেউ নেই? চারপাশটা দেখে শিওর হলো ও, যে আসলেও কেউ নেই। দূর, ওর কি? আবার এক স্টেপ নামতেই পিছন থেকে একই কন্ঠ ডাকা শুরু করল। নাহ, এবার দেখতেই হয় কে ডাকছে? মাথা পিছনে ঘুরাতেই ফাহিম দেখল এক তন্বী রুপসী হাত নেড়ে ওকে ডাকছে। সাত সকাল বেলা ঘুম ঘুম চোখে টাসকী খেয়ে গেল ফাহিম। ফাহিম তো মনে হয় জীবনে প্রথম এই মেয়েকে দেখল? চাকরির জন্য ও থাকে চট্টগ্রামে? এই মেয়ে ওকে চিনল কিভাবে? তাও আবার হাত দিয়ে ডাকছে? কি তাজ্জব ব্যাপার!
-এই, আপনি চার তলার না?
মেয়ের কথা তো সত্য। ফাহিমের ভাইয়ার বাসা চার তলাতেই। গত মাসেই ভাড়া নিয়েছে। এবারই প্রথম আসল ও। মাথা উপর নীচ করল ও। মেয়ে এগিয়ে এসে হুট করে ওর হাতে জোর করে একটা গাড়ির চাবি ধরিয়ে দিল। ফাহিম মৃদু স্বরে প্রতিবাদ করলেও সেটা পাত্তাই না দিয়েই বলল-
-আমাদের গাড়ি চেনেন না? নীল রঙের এ্যালিয়ন, ৭ নাম্বারে রাখা। আমাদের ড্রাইভার আজকে আসবেনা। বাবা আপনাকে গাড়িটা পার্কিং থেকে বের করে বাইরে রাস্তায় রাখতে বলেছে।
-আমি আপনাদের গাড়ি পার্কিং থেকে বের করে কেন রাখবো?
-সামান্য একটা কাজের কথা বললাম, আর তাতেই সমস্যা শুরু হয়ে গেল? যত্তসব!
দোতলার দরজাটা খোলাই ছিল, কিছু বুঝা বা বলার আগেই তন্বী বাসায় ঢুকে ফাহিমের মুখের উপর ধাম করে দরজা লাগিয়ে দিল। ফাহিম একেবারেই হতভম্ব! এর বাসায় যেয়ে কি নক করবে? এদের তো কাউকেই ও চিনেই না। কাকে যেয়ে কি বলব? এই মেয়ে মনে হয় ওকে নির্ঘাত ভাইয়ার বাসার ড্রাইভার মনে করেছে! ঘুম ঘুম চোখে আর কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। ধ্যাত, এর চেয়ে নীচে যেয়ে ভাইয়ার ড্রাইভারকে চাবিটা ধরিয়ে দিলেই হবে। ঘুমটা পুরোপুরি কেটে যাবার আগেই ওর বাসায় ফিরতে হবে, ইতিমধ্যেই মাথা ঘুরা শুরু হয়ে গেছে। আবার নীচে নামা শুরু করল ফাহিম……..
দৃশ্য ২-
দুইদিন পর বিকাল বেলা গাড়ি নিয়ে বাইরে যেয়ে সন্ধ্যার দিকে ফিরল ফাহিম। এই এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর নীচে কার পার্কিং এর জায়গা খুবই কনজাস্টেড। তাও আবার ব্যাক পার্কিং করে রাখতে হয়, নাহলে পরের বার বের করার সময় খবর হয়ে যাবে। ফাহিম খুব সাবধানে রাস্তা থেকে ঘুরিয়ে ব্যাক গিয়ারে গাড়ি ঢুকাচ্ছে বিল্ডিং এ। গাড়িটা রাস্তা থেকে পুরো বিল্ডিং এর ভিতরে ঢুকে গেছে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এক পলক কেবল চোখ সরিয়েছে ও, সাথে সাথেই মনে হলো ডান দিকের সাইড মিররে কি যেন দেখল? সাথে সাথেই হার্ডব্রেক দিয়ে গাড়ি থামালেও পিছনে একটা আর্তনাদ শুনল ফাহিম। হায় খোদা কি করেছে ও? ভয়ে প্রায় জমে যাবার মতো অবস্থা, দাড়োয়ান এসে ওকে আশ্বস্ত করল, কিছুই হয়নি, গায়েও লাগেনি। যাক বাঁচা গেছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার আগেই দুইদিন আগের দেখা দুই তলার তন্বী রুপসী ওর পাশে এসে হাজির। কিছু বলার আগেই মিনিট পাঁচেক কঠিন থেকে কঠিনতর ঝাড়ি দিল ফাহিমকে। ফাহিম একবার কিছু বুঝানোর চেস্টা করল, কে শুনে কার কথা? একগাদা ঝাড়ি মেরে এই তন্বী যাবার সময় আবার দাড়োয়ানকে বলে গেল-
-এই রকম পাগল ছাগল ড্রাইভারকে কেন মানুষ চাকরি দেয়? এদেরকে তো পুলিশে ধরিয়ে দেয়া উচিৎ।
ফাহিম হতভম্ব হয়ে এর গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে। এর তো গায়েই লাগেনি তাতেই এই অবস্থা! লাগলে নির্ঘাত গাড়ি থেকে টেনে বের করে….।
গাড়িটা জায়গা মতো পার্কিং করে বের হবার পর দুইজন ড্রাইভার এসে ওকে বলল-
-স্যার, আপনার ব্রেক করার পর আফার শরীর থেইক্যা আরও একহাত জায়গা আছিল। বেহুদা চিৎকার পারছে। সিড়ি দিয়া ন্যাইমা কোন দিকে না তাকিয়্যাই হাটতাছিল, আপনে যে গাড়ি ঢুকাইতেছেন, সেটা দেখেওনাই। হুদাহুদি আপনার লগে চিল্লাচিল্লি করসে। এই আপা সবার লগেই এই রকম করে, এর স্বভাব ভালো না। এর বাসার ড্রাইভার কি এমনিতে দুই তিন মাস পরপর চাকরি ছাইড়া দেয়?
আচ্ছা, এর ব্যবহার তো আসলেই খারাপ তাহলে। শুধু শুধুই সবার সাথে খারাপ আচরন করে। এই মেয়েকে কি ওর বাসায় শালীনতা বা ভদ্রতা এইসব কিছুই শেখায়নি? আজকে নিয়ে দুইবার শুধু শুধু ফাহিমের সাথে গায়ে পড়ে খারাপ ব্যবহার করেছে। এই মেয়েকে কিছুটা ভদ্রতা শেখান প্রায় অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। সুযোগ অবশ্যই পাওয়া যাবে, ওর বড় ভাইয়ের বাসায় তো ফাহিম আসবেই কয়েক দিন পর পর……
দৃশ্য ৩-
প্রায় একমাস পরের কথা। ফাহিম কে নিয়ে বিকাল বেলা ওর ভাই আর ভাবী বাইরে খেতে এসেছে। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসার পরেই রোদেলার চোখে পড়ল সামনের একটা বাচ্চা আইস্ক্রীম খাচ্ছে। ব্যাস বাচ্চাদের যা হয়, ও তাই করল, আইস্ক্রীম খাবে। রোদেলার বাবা মা হেস্তনেস্ত হয়েও যখন বাচ্চাটাকে সামলাতে পারছে না, তখন ফাহিম উঠে পড়ল বাচ্চাটার জন্য আইস্ক্রীম আনতে। নীচে যেয়ে পছন্দ মতো আইস্ক্রীম নিয়ে আসতে ফাহিমের প্রায় দশ পনের মিনিট লেগে গেল। ফিরে এসে দেখে আগের টেবিল চেঞ্জ করে ওর ভাই ভাবী আরেকটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এক ভদ্র মহিলার সাথে কথা বলছে। ফাহিম ওর ভাবীর সামনে যেয়ে দাড়াতেই ভাবী ওর হাত ধরে একটু পাশে নিয়ে যেয়ে বলল-
-তোমাকে বলিনি আগে, বললে খুব ঝামেলা কর। আজকে এখানে তোমার জন্য একটা মেয়ে দেখতে এসেছি। তোমার কথা শুনে মেয়ের বাসা থেকেই তোমার ভাইয়ার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। মেয়েটা দেখতে ভালোই। মেয়ে দেখে আর কথা বলে তোমার সিদ্ধান্ত আমাকে বল? মেয়ের নাম ফারিহা, আস, মেয়ের সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই।
ফাহিমের ভাবী ওকে সামনের টেবিলে বসে থাকা একটা মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল-
-তোমরা এখানে বসে কথা বল, আমরা ঐখানে ফারিহা মায়ের সাথে কথা বলছি।
ফাহিম সামনের মুখোমুখি একটা খালি চেয়ারে বসে পাত্রী দেখার আগ্রহ নিয়ে ভালো করে ফারিহার দিকে তাকিয়েই দেখল, চরম অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ফারিহার দুই চোখেই যেন প্রায় বিস্ফোরিত অবস্থা! কড়া মেকআপের পরও ফারিহাকে সাথে সাথেই ফাহিম চিনল। এই চেহারা ও ভূলবে কিভাবে? বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ফাহিম অপেক্ষা করে রইল কখন সেই চরম অবিশ্বাসের দৃষ্টি বিশ্বাসের পর্যায়ে আসবে, আর…….
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, ডিসেম্বর, ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:৫১