আশ্চর্য হয়ে ভাবি কীভাবে জীবনের গভীর অনুরাগের বিষয়টি আমার চোখ এড়িয়ে গেল। হায় ! কত অন্ধই না ছিলাম । আজ আমার জীবনে সবকিছু যেন সজীব প্রাণবন্ত হয়ে দেখা দিতে লাগল। রোদ ঝলমল দুপুরে রাস্তায় হাঁটত হাঁটতে গাছের পাতার ফাঁক গলে সবুজ ঘাসে লুটিয়ে থাকা রোদ্দুর দেখে আমার মন নেঁচে উঠে। গাছের শাখায় একাকী বসে দুলতে থাকা ঘুঘুর গম্ভীর ডাকে আমর মনেও যেন আদিকালের কোন বিরহী সুর বেজে উঠে।নির্জন পুকুরের স্তব্ধ পানির শীতলতা আমার হৃদয়ে কোমল পরশ বুলিয়ে যায় ।শিশির ফোঁটায় ঝলসানো আলোক রশ্মি আমার চোখে মুক্তো হয়ে ধরা দেয়। শিশির ফোঁটা না মাড়িয়ে সাবধানে পথ চলতে চেষ্টা করি।ভোরের শুভ্র আলোয় মুগ্ধ পৃথিবীর রুপ দেখব বলে আমি জেগে থাকি আর জেগে জেগে ভাবি আকাশের তারকারা কেন রূপসী চাঁদের রুপালি শাড়ির আঁচলে জোনাকির মতন জ্বলছে আর নিভছে।
মানসী ছাড়া আমাদের আড্ডায় আমি যেন কোন অনাহূত অতিথি । আমার দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে ইতি উতি ঘুরে বেড়ায় ।আড্ডার শব্দগুলো যেন কেবলই আমাকে পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে যায় ।তাদের অর্থ গুলো আমার কাছে দুর্ভেদ্য হয়ে উঠে । আমি অসহায়ের মতন সামনের চঞ্চল মুখ গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। অপেক্ষায় আমার অস্থিরতা বাড়তে থাকে । ভাবি ,এই তার আসার সময় হল বুঝি। আমার অপেক্ষার আবসান ঘটিয়ে সে যখন আমাদের সামনে এসে বসে নিমেষেই আমার ভিতরের অস্থিরতা কমে আসে আর আমি উৎকর্ণ হয়ে তার আলতো ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা শব্দগুলো শুনে শুনে ভাবি ,আহ্ ,সৃষ্টি জগৎ কত না ছন্দময় !শব্দ গুলো যেন বৃষ্টির মতো আমাকে ভিজিয়ে দেয়। তারপর একসময় গভীর অবসাদে আমার মন ভরে উঠে । আমি ক্লান্ত হই।
আমি কেবল তার নিকটবর্তী হওয়ার কথাই ভাবি। বন্ধু প্রতিবেশী হয়ে থাকতে আমার মন চায় না।মনের গতি বোঝা চিরজীবনই আমার কাছে জটিলতর। সাধারণ্যে না থেকে কীভাবে তার কাছে বিশেষ হয়ে উঠতে পারি কেবল তাই ভাবি।
স্কুল কলেজের তার শিক্ষা জীবনের অপূর্ব সব কীর্তির কথা আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছিলাম । সেসব তাকে আরো দুর্ভেদ্য করে তোলে। কবিতার বই দূরে ঠেলে ( আজকাল আমার কবিতা পড়তে ইচ্ছে করে না। আমার মনে ক্ষণে যেসব ভাবের উদয় হয় কবিতার চাইতে সেগুলো কোন অংশে কম নয়। আস্ত একখানা কবিতার বই মনে হয় আমিই লিখে ফেলতে পারব মনে হয়) পাঠ্যবইয়ে মনোযোগী হই। একটা ভালফল করে যদি তার চোখে নিজেকে বিশেষ রূপে তুলে ধরতে পারি ! আমাদের সবার ধারণা হয়েছিল সেই প্রথম হবে। কিন্তু প্রেমের দেবী আমার এতদিনের সাধণায় খুশি হয়ে বোধহয় আমার দিকে কৃপা বর্ষণ করে। ফলত সে হয় দ্বিতীয় ।এইবার সে যেন প্রথমবারের মত আমার দিকে আলাদাভাবে দৃষ্টি দেয়। আমার রক্ত কণিকায় যেন বিদ্যুত্ সঞ্চারিত হয়। আমার প্রথম সফলতা ।
এতদিন আমরা আমাদের ব্যাচের কিংবা সিনিয়র মেয়েদের ভজনা করতাম। কারও কারও ভাগ্য খুলে গিয়েছিল । কিন্তু আমি এবং আমরা অনেকেই যে যার পথে সাধনায় উদ্বুদ্ধ হই এবং এ যাত্রায় নতুন ব্যাচের মেয়েরাও আমাদের সঙ্গী হয়।
ক্রমে আমি অনেকের ঈর্ষার কারন হই কারণ মানসীকে আজকাল আমার সাথে দেখা যাচ্ছে । আমরা বন্ধুরা এতদিন এই যে একসাথে সময় কাটাতাম এখন সুযোগ পেলেই আমরা জোটে ভাগ হতে লাগলাম । আমার জোটে মানসী।
আমরা ঘুরিফিরি ,কফি সপে গিয়ে কফি খাই , কথা বলি। আমরা একে অপরকে জানতে চেষ্টা করি। আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমরা কথা বলি ,ঘুরি ,কথা বলি এবং পড়ি। এখন আমরা একসঙ্গেই পড়ি। আমাদের একসঙ্গে থাকার সময় ক্রমশ বাড়তে লাগল। সাধারণ কথাবার্তা আর পড়াশোনা নিয়ে আমাদের আলোচনার বিস্তার বাড়ে। আমরা আরো ভাল বন্ধু হই। কিন্তু যে কথা বলার জন্য আমার দীর্ঘ দিনের অপেক্ষা সে কথাটি আর বলতে পারি না।প্রতিদিন আমাদের আলোচনা চলতে চলতে কোন এক জায়গায় থমকে দাঁড়ায় । এরপর আমরা আর অগ্রসর হই না। তাকে দেখে কি এক গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায় । কি এমন চিন্তা যা আমাকে জানাতে চায় না ! আমারও প্রশ্ন করতে বাধো ঠেকে। আমি জানতে পারি না। তাকে হারানোর অজানা ভয়ে আমার হৃদয় কেঁপে উঠে । তাকে বুঝতে দিই না।
আমি চারপাশে তাকাই। ভাবতে চেষ্টা করি একটা মেয়ের ভাবনা কি হতে পারে। আমার ক্লাসের সুন্দরী মেয়ে গুলোকে একে একে টুপুস , মানে ঝরে পড়তে দেখলাম । বিয়ের কিছু দিনের মাথায় তারা আবার ক্লাস শুরু করে নিয়মিত । ক্লাসের ছেলেগুলোর দিকে এমনভাবে তাকায় যেন তারা নেহাতই বাচ্চা । তাদের দৃষ্টি শক্তির প্রখরতা অনেক ছেলেকে পুনরায় পাঠ্য বইয়ে মনোনিবেশ করিয়ে সামনের কঠিন জীবন সংগ্রামের কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়।
সমবয়সী অনেক ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখে নিজের কথা ভেবে সন্দেহের দোলা দিয়ে যায় ।
এই সময় কিছু লাল্টু মার্কা সিনিয়র ছেলে আবিষ্কার করলাম যাদের কেন্দ্র করে সুন্দরী মেয়েরা অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে । ঐসব মেয়েদের মধ্যে আমাদের সিনিয়র ,আমাদের ব্যাচ তো বটে পরের ব্যাচের মেয়েদের যাতায়াত লক্ষ্যণীয় । তাদের দেখে মনে হিংসা হয়। যাই হোক হিংসা জিনিসটা ভাল নয় ভেবে ওদিকে তাকানোই বন্ধ করে দিই।
মানসী আর আমি ভালো বন্ধু ।আমরা একে অপরকে বুঝতে শিখেছি । আমি টের পাই তার ভিতরে এক হরিণির কান্না । নিঃসঙ্গ হরিণি যে সঙ্গী খুঁজছ । সেই হরিণির চোখে কখনও নিজেকে দেখতে পাই বলে আজো টিকে আছি। আজকাল মাঝেমধ্যে তাকে হারিয়ে ফেলি। প্রশ্ন করলে বলে কিছু বান্ধবীর সাথে ছিল । ঐসব বান্ধবী হঠাৎ কোথায় থেকে উদয় হল ঠিক বুঝতে পারি না বলে মনে সন্দেহ হয়। তাকে হারিয়ে ফেললে বন্ধুদের সাথে জুটি । তাস খেলি ,আড্ডা দেই আর সে ফিরে ফিরে আসে। কখনও তাকে সুখী মনে হয়। কখনও তার চেহারার মেঘের ছায়া দেখি। কেন জানি না ,তার চেহারায় মেঘ দেখলেই আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠে । আমার খুশি আমার অন্ধকার হৃদয়ে লুকিয়ে তাকে গভীর ভাবে পর্যবক্ষেণ করি।
আজকাল আমার মন অনেক শক্ত হয়েছে । এটা বুঝতে পারলাম লাল টয়োটা কারে একটা ছেলের সাথে মানসীকে দেখে আমার ভিতর খুব তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় নি। প্রথমে মনটা দমে গিয়েছিল সত্য কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম আমার ভিতর দুঃখ বোধের তীব্র জ্বালা নেই । মনে হয় এই সত্যটি মেনে নেয়ার জন্য ভেতরে আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম । মনে পড়ল আমার বন্ধুরা কীরকম নরম ব্যবহার করে আসছিল আমার সাথে। তারা সত্যটা জেনেও আমাকে জানিয়ে কষ্ট দিতে চায়নি বলে আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হই। লাল টয়োটা কার এর কথা মনে পড়াতে আমার মনে পড়ল হাত খরচ জোগাড় করতে আমাকে বাসায় বাসায় গিয়ে ছাত্র পড়াতে হয়। বন্ধুদের মুখোমুখি হতে আমার খারাপ লাগছিল না। মনে হচ্ছে সবই স্বাভাবিক ।বন্ধুদের সাথে আগের দিন যেমন মিশেছি তেমনই হাসি তামাশা শুরু করলাম ,তাস খেললাম , কাউকে জানতে দিলাম না সত্যটা আমিও জেনে গেছি। মানসীকেও জানতে দিলাম না। মানসী যখন আসল তার হাসি মুখের আড়ালে মেঘই যেন দেখলাম । কিন্তু আজ আমার মন আর খুশিতে নেচে উঠল না । তাকে কেন্দ্র করে আমার সুখী কিংবা দুখি হওয়ার অধিকার টুকুই যেন হারিয়ে গেল !
নিজেকে জিজ্ঞেস করি ,আমি কি করছি ? মানসি আমার সাথে আগের মতোই মেশে। প্রতিদিন সে অনেকটা সময় আমার সাথে কাটায়।গল্প করি। মুলত সেই কথা বলে। আমি শ্রোতা মাত্র । সাধারণ কথাবার্তা । লেখাপড়া ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত । শুনতে শুনতে আপন মনে আমি হারিয়ে যাই। মাঝে মাঝে আক্রোশে আমার মন ফেটে পড়ে। চিৎকার করে তাকে চলে যেতে বলতে ইচ্ছে করে। আমার পুরো পৃথিবীটাই অন্ধকার হয়ে যায় । আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় । চেনা জানা পরিচিত সবাই দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। অসহায়ের মত কেবল আমি পড়ে থাকি। সবকিছু অসহ্য মনে হয়। পড়ালেখাও অসহ্য মনে হয়। ভয়ংকর একাকীত্ব আমার অস্তিত্ব কে দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে চায়। মানসীকে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি পারি না। মানসীর এই সঙ্গটুকুর জন্য আমি কাতর হয়ে থাকি। তাকে ছাড়া একটা দিন কল্পনাও যে করতে পারি না। এতটুকু তে আমি হয়তো একেবারে ধ্বংস হয়ে যেতাম। কিন্তু কোথায় যেন একটা ক্ষীণ আলোর আভাস আমি দেখতে পাই বলে টিকে রইলাম । হয়তো মনের ভূল।
মানসী যে অনেক ছেলের মনের জ্বালা তাই না। সে অনেক মেয়ের ঈর্ষার পাত্রিও। সে এসব দারুণ উপভোগ করছে । তাকে ঘর থেকে যে বিয়ের জন্য চাপ দিবে সে আশঙ্কা নেই । তার এই স্বাধীনতা অনেকের ঈর্ষার কারণ। আজকাল পড়াশোনায় তার মন নেই । আমার সাথে বন্ধুত্ব আগের মত রয়ে গেছে । মাঝেমধ্যে তাকে হারিয়ে ফেলি।
কখনও কখনও নিজেকে দোষী মনে হয়। কতটা সময় একসাথে পার করলাম। একবারও কি তাকে আমার মনের কথাটা বলতে পারতাম না ? আসলে বলার সাহস আমার হয় নি। তার মুখ থেকে "না" শুনতে আমার মনকে কখনওই প্রস্তুত করতে পারি নি। এবং এই "না" শোনার সম্ভাবনার পাল্লাটা ছিল ভারী। সে যে শুধু রূপবতী তাই নয় গুনবতীও। তার আছে পরিষ্কার স্বচ্ছ দুটি চোখ। ঐ দৃষ্টির সামনে সাবলীল ভাবে মিথ্যা বলে কেউ চলে গেছে এমনটা কখনও দেখিনি। জীবন টা তার কাছে সহজ। সেখানে জটিলতার লেশমাত্র নেই । ভয়ডর হীন। তাছাড়া তার বাপের টাকাও একটা ব্যাপার ।
কখনও মনে হয় বলতে হবে কেন ? অবুঝ তো সে নয় ! আসলেই কি তাকে কিছু বলার দরকার ছিল ! সে কি বুঝে নি ! জানত না ! এসবের কোন উত্তর নেই। সে এড়িয়ে গেছে ।
আমার সাথে সম্পর্ক সে কাটে না। বরং সেটা যেন সজীব থাকে তার জন্য জল ঢেলে দেয়। কয়েকদিন আমাকে কম সময় দেয়া হলে পরের কয়েকদিনে সেটা পুষিয়ে দেয়।
আজকাল তার আচরণে একটু অস্বাভাবিকতা এসেছে । ঐসব সিনিয়র লাল্টু ছেলেদের অনেকের সাথেই তাকে দেখা যায় । ঐ বলয়ে মানসীকে নিয়ে মেয়েদের মধ্যে তৈরি হওয়া অনেক গোলযোগের কথা আলোচিত হয় আমাদের ছেল মেয়ে উভয় মহলেই। সেই বা কেমন ধারার মেয়ে , কার সাথে তার সম্পর্ক । আমার বন্ধুরা আগে মানসীর কথা আমার সামনে আলোচনা করত না। আজকাল তারা ধরেই নিয়েছে মানসীর কোন কিছুতে আমার কিছু যায় আসে না।
আসলেই কিছু যায় আসে না ? আজকাল আমরা যখন একসঙ্গে থাকি পুরো সময় টা চুপচাপ কাটিয়ে দেই। আমাদের যেন বলার কিছু থাকতে পারে না। তবু অনেকটা সময় আমরা একসঙ্গে কাটাই।তার অনেক কিছুই বুঝতে পারি না। কেনই বা সে আমার কাছে আসে। এ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করার সাহসও আমার নেই । মাঝে মাঝে মনে হয় আমার মন যেমন তার কাছে আশ্রয় খুজে সেও তেমনিই আশ্রয়ের খোঁজে আমার কাছে আসে। আমার কাছে এসে যেন সে পরম স্বস্তি বোধ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যেন তার সবচেয়ে আপনার সবচাইতে বিশ্বস্ত ।
মানসীর উপর কোনদিন অধিকার খাটায়নি সত্য । তবে তার উপর কিছু অধিকার মনে হয় আমার জন্মে গেছে । সেটুকু সম্বল করে একদিন চড়াও হলাম। জিজ্ঞেস করলাম , আজকাল পড়ালেখায় তোর কোন মনোযোগ নেই কেন ?
প্রশ্ন শুনে সে যেন আশ্চর্য হয়ে গেল। তার চোখে যেন গভীর প্রশ্ন । আমি দ্বিধান্বিত হয়ে ভাবতে লাগলাম কি এমন বললাম যে কারণে মানসীর এমন প্রতিক্রিয়া ! আমি যেন নিজের ভেতরে গুটিয়ে যেতে লাগলাম। ধীরে মানসীর চেহারা স্বাভাবিক হয়ে এল এবং একটু হতাশ হল মনে হল। বলল , মেয়েদের এত পড়াশোনা করে কি হবে ? সেই তো পরের ঘরে গিয়ে রান্নাই করতে হবে। বলে অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকাল। কি বলব ভেবে পেলাম না। মনের মধ্যে কত ছবি ভেসে যায় । মানসীর কত কত ছেলে বন্ধু । তাদের একজনকে বিয়ে করে স্বপ্নময় জীবন শুরু করবে। আরও কত কি ! তা না , এমন হতাশ করা উত্তর ! মনে হলো তার কিছু হয়েছে । বললাম ,তোর বাসায় কি বিয়ের কথা বলছে নাকি ?
বলবে না , বয়স হচ্ছে তো ! প্রপোজাল ও আসছে।
তাহলে তোর এইসব বয়ফ্রেন্ড্ ?
ধেৎ ,ওরা কিছু না , শুধুই সময় কাটানো ।
মানে ?
সে তুই বুঝবি না। বলে হাসল।
আমি আসলেই তার ঐ দিনের কথায় কিছুই বুঝিনি । শুধু মনে হয়েছিল ও ঠিক শান্তিতে নেই । সব কিছুতে কেমন গা ছাড়া ভাব।
এর কিছু দিন পর নবীনবরণ উৎসব। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় সেজেছে নতুন রংয়ে। সেজেছে চাত্র-ছাত্রীরাও। গতবারও এই উৎসবের দিন আমি আর মানসী সারাদিন একসাথে কাটিয়েছি। এবার আমার একা ভাল লাগছিল না। বন্ধুদের সাথেও থাকতে ইচ্ছে করছিল না। শুকনো মুখে একা একা হাটছি। হঠাৎ সামনে দেখলাম মানসী একটা ছেলের সাথে রিকশা নিয়ে উল্টো দিক থেকে আসছে । তাকে দেখে মনে হচ্ছে আকাশ থেকে কোন পরী নেমে এসেছে । খুব সুন্দর করে সে সেজেছে। সাদা শাড়ি পরেছে , পাড়ে নতুন পাতা রংয়ের সবুজ নকশা ।সাদা বেলি ফুলের মালা খোঁপায় গেঁথেছে। হাত নেড়ে পাশে বসা ছেলেটির সাথে কথা বলছে। আমার কাছে পুরো দৃশ্যটা অপার্থিব লাগছে। মানসী আমাকে দেখে নি। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি আর তার পাশে বসা ছেলেটার মূখেও রাজ্যের মুগ্ধতা। কাছে এসে মানসী আমাকে দেখে হাত নেড়ে চলে গেল ।আমি পাল্টা হাত নাড়তেও ভূলে গেলাম। অদ্ভুত হেসে মানসী পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
কি হল জানি না এরপর তাকে খুঁজতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় চষে বেড়াতে লাগলাম। কেন খুঁজছি তাও জানি না। কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারি তাকে দেখে কিনা । তাও করছিলাম না। যে আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে।প্রায় তিন ঘন্টা পর তাকে পেলাম। দূর থেকে তাকে দেখতে পেয়ে আমি থমকে দাড়ালাম। সে আমার দিকেই মুখ করে ছেলেটির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কি করব বুঝতে পারছি না। দূর থেকেই তাদের দেখছি। ছেলেটি পরের ব্যাচের কয়েকটি মেয়ের সাথে কথা বলছে। যাদের মধ্যে একটা মেয়ে খুব সুন্দর । ছেলেটার আগ্রহও তার দিকে । কথা বলছিল অনেকক্ষণ ধরে।
মানসীর চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠছিল । মুহূর্তে বুঝলাম কি ঘটছে । যে কাজ কখনও করিনি তাই করলাম। সেদিকে এগোলাম। জানি না আমার চেহারার কি ছিল আমাকে দেখে মানসীর চোখ যেন বিস্ফারিত । মানসীর একটা হাত মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে লাগলাম । কারও দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম আমার এমন আচরণে কম বেশি সবাই বিস্মিত । কিন্তু ব্যাপার বোঝার আগেই আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। আশ্চর্য যে মানসী একবারও বাঁধা দেয়নি । ওরকম ভাবে তাকে নিয়ে আসার জন্য মানসীকে কি কৈফিয়ত দেব তা ভেবে অস্থির হচ্ছিলাম এমন সময় মানসী আমার ডান হাতটা পুরো ওর হাতের মধ্যে নিয়ে একেবারে গা ঘেঁষে হাঁটতে লাগল। আমার সব অস্থিরতা উধাও হয়ে গেল। তার দিকে তাকালাম। সে বলল , তোর এত অহংকার কেন রে ?
বলতে চাইলাম , অহংকার ! আমার ? কিন্তু তার চেহারা দেখেই থমকে দাড়ালাম। অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর যেন পেয়ে গেলাম।তার হাত মুঠোয় নিয়ে জোরে চেপে ধরলাম। সে বলল ,ছাড় ,ছাড়, ভেঙে ফেলবি নাকি ?
বললাম ,হ্যাঁ ।
আমার পৃথিবী যেন আবার তার রং ফিরে পেল। হঠাত্ খেয়াল হল আমরা হাটছি ফুল মাড়িয়ে । বাংলায় এখন কোন মাস ? জানি না। জানার দরকার নেই ।রাস্তার দুপাশের গাছ থেকে লাল-নীল-বেগুনি-সাদা আরও কত রংয়ের ফুল পড়ে রাস্তাটিকে গালিচার মত ঢেকে দিয়েছে । মনে হল এ শুধু আমাদের জন্য । চেঁচিয়ে বললাম , মানসী , দেখ্ -দেখ্ ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ রাত ২:৫৩