somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রণাম্য বাউল শাহ আবদুল করিম স্মরণে (সংগৃহীত)

২২ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
সাধারণ ব্লগার হিসেবে প্রোমোশন পাওয়ার পর আমার প্রথম পোস্ট..................
................আশা করি সবার ভাল লাগবে
........তাহলে শুরু করা যাক......


মাত্র এক রাতের বিরহ। আর তাতেই শাহ আবদুল করিম-এর পঁয়ষট্টি বছর বয়েসি দেহটি কী রকম বিষন্ন আর কাতর হয়ে উঠেছে। উদাসী মুখে ঘনিয়ে উঠেছে বেদনার কালো মেঘ। ১৯৮০ সাল। শ্রাবণ মাসের সবে শুরু। আকাশের মুখ কখনও হাসিখুশি কখনও-বা ভার-ভার ঠেকে। এই সকালে অবশ্য ফুরফুরে হাওয়া বইছিল; রোদ ঝলমলে হাওরের পানি ঝিকিমিক করছিল।
একটি নৌকা ভেসে যাচ্ছে কাঞ্চা হাওরে। গন্তব্য উজানধল। নৌকায় গলুয়ে বসে আছে রুহি ঠাকুর। সে বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম-এর শিষ্য। নৌকায় বাউল সম্রাটও বসে রয়েছেন। মাঝে-মাঝে আড়চোখে ওস্তাদের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল রুহি ঠাকুর । আজ সকাল থেকে ওস্তাদের মুখ ভার । কি কারণ? অস্বস্তি বোধ করে রুহি ঠাকুর। গতকাল উজানীর হাট যাত্রা করার সময় হাসি খুশি ছিলেন ওস্তাদ। ঘাট পর্যন্ত এসে বিদায় দিলেন গুরুমা। নৌকায় নতুন একটি গান বাঁধলেন ওস্তাদ।
বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে সই গো বসন্ত বাতাসে ...
আজ সকালে ওস্তাদের কী হইল? গতকাল রাতেও ওস্তাদ খোশ মেজাজে ছিলেন। উঠানে বসে ওস্তাদের বন্ধু মোকাররম হোসেনের সঙ্গে কত কথা বললেন । শ্রাবণের পূর্ণিমার আলোয় ভরে ছিল উঠান। কাঞ্চি বিলের দিক থেকে ভেসে আসছিল মৃদুমন্দ হাওয়া । সে হাওয়ায় কলাপাতারা কাঁপছিল। কলাপাতায় পিছলে যাচ্ছিল চাঁদের আলো। ওস্তাদ গান ধরলেন: কোন মেস্তরি নাও বানাইল - কেমন দেখা যায় আরে ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ...
মোকাররম হোসেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের বাল্যবন্ধু। তাঁর অসুস্থার খবর পেয়েই গতকাল বিকেলে উজানীর হাট এসেছেন শিষ্য রুহি ঠাকুরকে নিয়ে । দীর্ঘদিন পর এদিকে এলেন বাউল সম্রাট। মোকারম হোসেনের বয়সও ষাট-পঁয়ষট্টি হবে। শীর্ণ। ছোটখাটো গড়নের মানুষ। অসুখেবিসুখে কাহিল শরীর। মোকাররম হোসেন-এর বাঁ পা'টি দীর্ঘ দিন ধরে অসাড়। ঠিক মতন হাঁটতে পারেন না তিনি । সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। কাল অবশ্য ধবধরে পূর্ণিমার রাতে উঠানে বসেছিলেন। পুরনো বন্ধুকে কাছে পেয়ে মনের জোর কিছু ফিরে পেয়েছিলেন।
মোকাররম হোসেন এর এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছোট মেয়ে রাহিলার বিয়ে হয়েছে সল্লা। বড় ছেলে বাহাউদ্দীন-এর উজানীর হাটে শাড়ি-লুঙ্গির দোকান আছে। মোকাররম হোসেন এর স্ত্রী রহিমা বছর পাঁচেক হল মারা গেছেন। ছেলের বউ মালাই সংসার আগলে রাখে। বেশ ফুটফুটে দেখতে মেয়েটি। মালার একটি ছেলে আছে। ছেলের বয়স দু বছর। নাম লোকমান।
মালা মৃদুকন্ঠে বাউল সম্রাটকে বলল, বিয়ের পর থেকে শুনতেছি, আপনে আমার আব্বার বন্ধু। আমার বাড়ির কেউ এই কথায় বিশ্বাস করে না।
মোকাররম হোসেন ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, মালা?
বলেন আব্বা। বলে মালা ঘোমটা টেনে দিল। কোলে দু বছরের লোকমান কলকল করে উঠল।
মোকাররম হোসেন বলেন, ১৯৫৭ সালের চৈত্র মাসে তোমার শাশুড়ি আম্মার অসুখ করছিল। করিমে আইসা তখন ২০০০ টাকা দিয়া গেল। সেই টাকায় তোমার মায়ের চিকিৎসা করাইলাম। তোমার মায়ে সুস্থ হইল। সেই টাকা গত তেইশ বছর ধইরা করিমরে ফেরত দিবার চেষ্টায় আসি। করিমে সে টাকায় নেয় না। আইজ মাছ ভালো কইরা রাইন্দো মা।
মালা বাউল সম্রাটের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিতে গভীর শ্রদ্ধা। বাউল সম্রাট কিছু না-বলে চুপ করে রইলেন। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। যেন বাল্যবন্ধুর কথায় লজ্জ্বা পেয়েছেন।
১৯৫৭ সাল। ৬ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার কাগমারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন। সে সম্মেলনে মঞ্চে উঠে জনসমুদ্রের সামনে শাহ আবদুল করিম গেয়েছিলেন: ‘জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে বল ওগো সাঁই/ এ জীবনে যত দুঃখকে দিয়াবে বল তাই।’ গান শেষ হওয়ার পর মওলানা ভাসানী গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরেছিলেন ভাটি অঞ্চলের বাউলকে। বলেছিলেন: ‘সাধনায় একাগ্র থাকলে তুমি একদিন গনমানুষের শিল্পী হবে।’ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত ছিলেন। তিনি করিমকে দশ হাজার টাকা সম্মানী দিয়েছিলেন।
মালা এক ফাঁকে বাউল সম্রাটকে বলে, আপনারে আমি আব্বা বলে ডাকব।
আইচ্ছা ডাইকো মা। তারপর বাহাউদ্দীনের দিকে তাকিয়ে বাউল সম্রাট বললেন, আমার মারে একবার উজান ধলে নিয়া যাইবা বাজান।
বাহাউদ্দীন মাথা নাড়ে। বড় মাতৃভক্ত ছেলে বাহাউদ্দীন। বাউল সম্রাটের টাকায় তেইশ বছর আগে মায়ের চিকিৎসা হয়েছে।
মালা স্বামীকে বলল, আপনি একবার হাটে যান।
বাহাউদ্দীন বেরিয়ে যায়।
সামান্য ঝুঁকে লোকমানকে কোল থেকে বাউল সম্রাটের কোলে বসিয়ে দেয় মালা। গভীর শান্তি অনুভব করে । প্রসব যন্ত্রনা এতদিনে সার্থক হল। (নারী আসলে জীবনভর এক কবির অপেক্ষায় থাকে । সেই কবিটি কোলের শিশুটিকে স্পর্শ করলেই নারীর জীবন ধন্য হয় ।)
সে যা হোক। সন্ধ্যার মুখে বাহাউদ্দীন বাঘা আইড় মাছ এনে ফেলল রান্নাঘরের । আর তরি-তরকারি। বাঘা আইড় মাছ কেটেকুটে আলু দিয়ে রান্না করল মালা । মেয়েটির রান্না ভালো। হাজার হলেও সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের মেয়ে মালা। (আসলে বাংলাদেশের সর্বত্রই সুনামগঞ্জের রান্না প্রশংশিত।)
সন্ধ্যার পর ফুটফুটে জোছনা ফুটেছে। উঠানে মাদুর পেতে দিল বাহাউদ্দীন। সে আর রুহি ঠাকুর মোকাররম হোসেনকে দুদিকে ধরে এনে ধীরেসুস্থে বসিয়ে দিল। বাউল সম্রাটও বসলেন। হাওরের পানিতে চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করছিল। যেন তরল দুধের নহর। এলোমেলো দূরন্ত বাতাস বারবার এসে লুটিয়ে পড়ছিল উঠানে।
মালার রান্না শেষ। চকিত পায়ে উঠানে এসে বাউল সম্রাটকে আদুরে গলায় বলল, আব্বা, আমি সেই গানটা শুনব।
কোন গান মা?
বন্ধে, মায়া লাগায়ছে ...
বাউল সম্রাট মৃদু হাসলেন। মাথা নাড়লেন। তারপর গাইতে লাগলেন:
বন্ধে, মায়া লাগায়ছে, পিরিতি শিখাইছে,দেওয়ানা বানাইছে কী জাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে ... বসে ভাবি নিরালায়/ আগে তো জানি না বন্ধুর পিরিতের জ্বালা। হায় গো নিজের ভাট্টায় কয়লা দিয়া আগুন জ্বালাইছে।
মালার চোখে পানি জমেছে। চাঁদের আলোয় বোঝা যায়। মালা মাদুরের কোণে বসেছিল। এখন উঠে যায়। তারপর দ্রুত পায়ে অন্ধকার-অন্ধকার ঘরে ঢুকে যায় ।
অন্ধকারে কাঁদতে বসে মালা। মোকাররম হোসেন কিংবা বাহাউদ্দীন টের পায়না।
মোকাররম হোসেন ছেলের বউকে ডাকলেন, মালা মালা। করিমরে পান দিয়া যাও।
বাউল সম্রাট বললেন, থাক মোকারম। ওরে এখন ডাইকো না। আজ সকাল-সকাল ভাত খেয়ে বাউল সম্রাট শিষ্য রুহি ঠাকুরকে নিয়ে রওনা হলেন। ভোররাতে উঠে বাহাউদ্দীন বেতাঙ্গী আর আগুন চোখা নিয়ে এল।
পাঠক, এই মাছ দুটো সুনামগঞ্জের হাওরে বৃথা খুঁজতে যাবেন না। তার কারণ বর্তমানে এই দুই প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই কাহিনীর ঘটনাকাল ১৯৮০ বলেই বিলুপ্তপ্রায় মাছদুটির কথা উল্লেখ করা হল।
মালা বেতাঙ্গী মাছের ঝোল আর আগুন চোখা মাছ ভাজল। রাঁধতে-রাঁধতে কাঁদছিল মালা। বাউলে এ বাড়িত অ কেন আইলেন? আইয়া আমারও এবাম উতলা কইরা দিলেন? আমি ত সব ভুইলা গেছিলাম ...
গতরাত্রে মালা ঘুমাতে পারেনি। অবশ্য বাহাউদ্দীন ওর বউয়ের এসব পরিবর্তন টের পায় না।
সকালে মিষ্টি আলোয় উঠান ভরে ছিল। হাওরের হিজলের পাতা ছুঁয়ে বাতাস এসে লুটিয়ে পড়ছিল কলা গাছের পাতায়। মন দিয়ে বাউল সম্রাটের খাওয়া দেখছিল মালা । কত দুঃখ এই মানুষের মনে। মনের মইধ্যে দুঃখ না-থাকলে গান বান্ধে কেমনে। (আমার স্বামীর সুখও নাই, দুঃখও নাই, তারে দিয়া গান বাঁধা হইব না।) মালা শুনেছে বাউল সম্রাটের ছোট্ট সংসার। এক ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে সুখি। তারপরও বাউলের বুকের ভিতরে বাওরের বাতাস হা হা করে।
বাউল সম্রাটের গলা দিয়ে ভাত নামছিলনা। রুহি ঠাকুর কীভাবে যেন টের পায়। তারও খাওয়া ঠিকঠাক হল না। সকাল থেকেই ওস্তাদের মন ব্যাজার। তার কি কারণ?
বিদায় নেবার সময় বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলেন বাউল সম্রাট। দুজনেরই বয়েস হয়েছে। এ জীবনে আর দেখা হবে কিনা কে জানে। দুজনেই শিশুর মতন কাঁদলেন। অনেক ক্ষণ।
ভাটি অঞ্চলের হাওরের পারে বিস্তির্ণঘাসের জমি... সে জমিতে এক সময় দুটি বালকের একসঙ্গে কত দিন কেটেছে । গরু চড়াত দুজনে। বালকেরা রাখাল ছিল। বাংলার রাখালের মন মরমী হয়। আজও সে মরমী মন দু বৃদ্ধের ভিতরে বিরাজ করছে।
মালাও কাঁদল ...
উজানীর হাটটি মোকাররম হোসেনের বাড়ির কাছেই । খানিকটা কাদা ভরা ঘুরপথ। পায়জামা গুটিয়ে রাবারের পাম্প শ্যূ হাতে নিয়ে হাঁটতে বড় সুখ হয়। আজ দিনটায় খুব রোদ হবে। আকাশে কদিন হল শ্রাবণী মেঘের দেখা নেই। তবে বলা যায় না। মাসটা শ্রাবণ। মাসটার মনে গতিক বালিকার মনের মন ...
আজ বুধবার। হাটবার। উজানীর হাটে থই থই মানুষ। বাতাসে মাছের গন্ধ । কাদার গন্ধ। তবে হাটের মানুষের চোখেমুখে উদ্বেগ স্পষ্ট। কালনী, বছিরা, কুশিয়ারা এসব নদী বাঁক পরিবর্তন করছে। নদীর তলদেশ ক্রমশ বালি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এক সময়ের একশ হাত দুইশ হাত নদীগুলি এখন কোথাও দশ হাত, কোথাও বিশ হাত। অগভীর নদী ফুসে উঠলেই হাওরবাসীর জীবনমরণ সমস্যা। এতসব উদ্বেগের পরও হাটের লোকজন বাউল সম্রাটের দিকে তাকাচ্ছিল। বাউল সম্রাট হাওরবাসীকে গান গেয়ে শান্তি দেন।
উজানীর হাটের যেকোনও জায়গায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে কাঞ্চা বিলের ধূ ধূ সাদা পানি। জলমগ্ন হিজল গাছ। তার নীচে শ্যওলার বাগান। ওপরে ট্রলার। সে ট্রলার ভটভট শব্দ তুলে যায়। ঘাটে নৌকার ভিড়। তারি মাঝখানে একটি একতলা ছোট লঞ্চ। সাদা রং করা। রেলিংটা লাল রঙের। ওস্তাদ কেন যেন লঞ্চে উঠতে চান না। রুহি ঠাকুর এ কারণটি আজও বুঝে উঠতে পারেনি।
একটি নৌকা উজানধল যাবে । বাহাউদ্দীন সঙ্গে এসেছিল। সেই দরদাম করে দু’জনের ভাড়া ঠিক করল। ( ভাটি অঞ্চলের মাঝিরা শাহ আবদুল করিমের কাছে ভাড়া নেয় না। বাহাউদ্দীন বৈষয়িক মানুষ বলেই এসব খবর সে রাখে না। ) নৌকা ভেসে চলেছে উজানধলের উদ্দেশ্যে ...
মাঝারি আকারের ছই নৌকা।ছইয়ের ভিতরে-বাইরে দশ-বারোজন যাত্রী। পাটাতনে এক ঝাঁকা মাছ। তার আঁশটে গন্ধ ছড়িয়েছে। সে গন্ধের সঙ্গে কাদা ও পচা শ্যাওলার গন্ধ। এসব গন্ধই হাওরবাওরের চিরকালীন গন্ধ। এক বৃদ্ধ বিড়ি ধরিয়েছিল। সেই গন্ধও মিশে যাচ্ছিল চিরকালীন গন্ধের সঙ্গে ।
যাত্রীরা দীর্ঘদেহী শীর্ণ বাউল সম্রাটকে বিলক্ষণ চেনে। গভীর শ্রদ্ধাও করে। তাদের গান শুনতে ইচ্ছে হয়। তবে বাউল সম্রাটকে গান গাইতে বলার সাহস হয় না। বাউল সম্রাটের মুখ ভার, দৃষ্টি উদাস, চোখেমুখে গভীর বিষাদ। যাত্রীদের আশা বুঝি পূর্ণ হবে না আজ। অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দুঃখেভরা এদের জীবন। এরা হাওরের অধিবাসী । পানির সঙ্গে নিত্য কঠিন জীবনসংগ্রাম। উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার ভিতর মারফতি-বাউল গানের সুরে শান্তি খুঁজে পায়। গান আছে বলেই জীবন অর্থহীন মনে হয় না। কেননা সুর স্বর্গীয়। জীবনসংগ্রাম অর্থহীন বলে মনে হয় না। আজ বাউল সম্রাটের গান শোনা হবে না বলে অনেকেই বিষন্ন বোধ করতে থাকে।
রুহি ঠাকুর সহসাই যেন ওস্তাদের উদাস হওয়ার কারণটি বুঝে উঠতে পারে। ওস্তাদ কি স্ত্রীবিরহে কাতর হয়ে উঠেছেন? হ্যাঁ। তাই হবে। গুরুমা আপ্তাবুন্নেছা ভারি মমতাময়ী নারী। ওস্তাদের শিষ্যদের পুত্রসম স্নেহ করেন। গুরুমা আপ্তাবুন্নেছা কে ওস্তাদ ‘সরলা’ বলে ডাকেন । সরলাই ওস্তাদের জীবনের সমস্ত প্রেরণার উৎস। রুহিঠাকুর জানে, তার ওস্তাদ অন্য পুরুষদের মতো নয়।
রুহি ঠাকুর বছর পাঁচেক আগে একবার কুষ্টিয়া গিয়েছিল। সেখানে একজন বৃদ্ধ বাউল রুহি ঠাকুরকে বলেছিলেন, ‘লালন শাঁই বলতেন, নারী হও, নারী ভজ।’ এই কথার কি মানে? রুহি ঠাকুর যে বোঝে না- তা কিন্তু নয়। লালনের নির্দেশ বাউল সম্রাট অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। ওস্তাদ প্রায়ই বলেন, সরলা আমার মুর্শিদ । আমার পথপ্রদর্শক। পুরুষমানুষ সাধারণত এ ধরণের মন্তব্য করে না।
ওস্তাদের আজ সকাল থেকে গুরুমার জন্য মন উচাটন হয়ে আছে। আশ্চর্য! মাত্র এক রাতের বিরহ ...
হঠাৎ রুহি ঠাকুর দেখল, ওস্তাদের বসে থাকার ভঙ্গিতে কেমন পরিবর্তন এসেছে। ওস্তাদ একবার আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর ধ্যানস্থ হলেন ওস্তাদের সঙ্গে অনেক বছর ধরে আছে রুহি ঠাকুর। সে বুঝতে পারে ওস্তাদের এখন গান বাঁধার সময় হয়েছে। সে সচেতন হয়ে উঠল। ওস্তাদ গেয়ে উঠলেন:
কেমনে ভুলিব আমি /কেমনে ভুলিব আমি/ বাঁচি না তারে ছাড়া আমি ফুল / বন্ধু ফুলে ভ্রমরা/ সখী গো ...
রুহি ঠাকুর ছোট্ট শ্বাস ফেলে। গানটা অচেনা। ওস্তাদ এখনই বাঁধলেন। গানের পদগুলি স্মরণে গেঁথে নিতে লাগল। পরে তো তাকেই গেয়ে শোনাতে হবে।
যাত্রীরা নড়েচড়ে বসে। তাদের মনের আশা পূরণ হতে চলেছে।
মাঝি বৈঠা বাইতে-বাইতে মাথা নাড়ে। মাঝিটিবৃদ্ধ । পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি আর গেঞ্জি । মাথায় গামছা। মাঝির মুখেও হাসি ফুটে উঠেছে।
এক রাতের বিরহ সইতে না পেরে আত্মমগ্ন হয়ে গান গাইছেন পঁয়ষট্টি বছরের বাউল :
”না আসিলে কালো ভ্রমর কে হবে যৌবনের দোসর ? সে বিনে মোর শূন্য বাসর, সে বিনে মোর শূন্য বাসর , আমি জীয়ন্তে মরা ...”
হাওরের পানি শ্রাবণ মাসের রোদে ঝিকিমিকি করছিল।
বৃদ্ধ মাঝি আবহমান বাংলায় চিরায়ত হাওরের পরমানন্দে নৌকা বাইতে থাকে ...
...(বাউল বাবু ফকির) তার লিখা ডাইরি থেকে নেয়া - (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×