দৈনন্দিন কর্মসূচি বলিতে তাহাই বুঝায় যাহা আমরা নিত্যদিন করিয়া থাকি। আরও সহজ করিয়া বলিতে হয়, প্রাতঃকালে শয্যাত্যাগ হইতে নিশিতে শয্যাগত হইবার মধ্যস্থ সময়ে আমরা প্রতিদিন সাধারণত যাহা করি, তাহাকেই দৈনন্দিন কর্মসূচি বলিয়া ভদ্রসমাজে গন্য করা হয়। প্রকৃতির এক অপরূপ শৃঙ্খলের দরুণ, সকল অবস্থায় সকলের জন্যই আপনাআপনি ভাবে এক দৈনন্দিন কর্মসূচি ঠিক হইয়া যায়। লোকে সেটা আনন্দে কিংবা নিরানন্দে মানিয়া লয়, সেই অনুযায়ী কাজ করিয়া যায়।
সকলের মত আমার দৈনন্দিন কর্মসূচি শুরু হয় শয্যাত্যাগের দ্বারা, অতিশয় ভোরে, দিনের প্রথম প্রহরে, ঘড়ির কাটা যখন ষষ্ঠ ঘর অতিক্রম করে তখন। এমন সময় শয্যাত্যাগ সুপুরুষত্বের লক্ষন, তাই পাঠক আমাকে সুপুরুষ ভাবিতে পারেন। কিন্তু হয়তবা ততটা সুপুরুষ আমি নই, তার প্রমাণ আপনারা নিম্নের বর্ননায় পাইবেন।
অতিশয় ভোরে শয্যাত্যাগের হেতু হইলো এই, সারাদিনের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের দরুণ সৃষ্ট জলসমস্যা হইতে নিজেকে এবং পরিবার বর্গের সকলকে নিস্তার দিবার তাগিদে পানির কল ছাড়িয়া পানি সংগ্রহের দায়িত্বটা আমার উপর ন্যস্ত। এতে পাঠক আমাকে দায়িত্ববান পুরুষ ভাবিতে পারেন। এই বিশেষণ অস্বীকার করার সাহস আমার নাই, ইচ্ছাও নাই। দায়িত্বের যথাযথ পালন নিশ্চিত করিয়া বাটি প্রাঙ্গনে হাটিবার সময় প্রায়শই পদচারণায় ব্যস্ত পিতামহের সহিত সাক্ষাত হয়, উনি আমার দিকে প্রসণ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া হয়তো ইহা ভাবিতে পারেন যে, " দৌহিত্র আমার নিশ্চিত ফজরের নামাজ আদায় করিয়াছে। বাহ, এরকম দৌহিত্র বিধাতা যেন ঘরে ঘরে দেন।"
কথা হইলো এই, প্রায়ই ভোরবেলায় মাস্টারমশাইয়ের নিকট বিদ্যার্জন করিতে যাইতে হয়। তো বিদ্যার্জনের ধ্যান থাকিলে বেশ, নতুবা কেশ চুলকাইতে চুলকাইতে ফের নিদ্রা যাইবার মনস্থ করি।
দ্বিতীয় বারে শয্যাত্যাগ করিতে করিতে বেশ বিলম্ব হয়, ঘড়ির কাটা ততক্ষণে এগারোর কোঠা অতিক্রম করিয়া অনেকটাই অগ্রসর হইয়াছে, আঁখি জোড়া ডলিতে ডলিতে আমি যখন কক্ষ হইতে নির্গত হই তখন মাঝেমধ্যেই পিতামহাশয়ের সহিত সাক্ষাত হইয়া যায়। উনি জীবিকার তাগিদে বাহির হইতে ব্যস্ত, আমার দিকে দৃষ্টিপাত করেন, সেই দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিরক্তি মিশ্রিত থাকে, তার চাইতে ঢের পরিমাণ ক্ষোভ মিশ্রিত থাকে তাহা চাহিবামাত্র বুঝিয়া লওয়া যায়। হয়তো তিনি ভাবেন, "পুত্র আমার উচ্ছণ্ণে যাইতেছে, বিধাতা যেন এরকম পুত্র শত্রুকেও না দেন"।
সে যাই হোক, পিতার এই বিরক্তি, এই ক্ষোভ সবই আমার ধাতস্থের মধ্যে রহিয়াছে। উপরন্তু জগতের কোন পিতাই যে তাহাদিগের আপন আপন পুত্র লইয়া সন্তুষ্ট নয়, ইহাও আমার বোধগম্য না হইবার নয়।
পিতামহাশয় ঘর হইতে নির্গত হইবার পরবর্তী সময়ে মাতা কালীরুপ ধারণ করিয়া বসেন। মমতাময়ী মাতার জ্বালাময়ী ভাষণ শুনিয়া আর কালক্ষেপণ করিবার জো থাকে না। কোনরকমে প্রাতরাশ কাম মধ্যাহ্নভোজন শেষ করিলেই বাঁচি।
এর পরের সময়টুকু আমার কাছে স্বর্গসুখ বলিলে বাড়াবাড়ি হইবে না। আপন কক্ষে গা এলিয়ে মনের সুখে সময়ক্ষেপণে আমার কোন কার্পণ্য থাকে না। এরি মধ্যে কথোপকথন যন্ত্রখানি বিছানার খাঁজে কিংবা বালিশের ভাঁজে কোথায় লুকাইয়া আমার লাগি অপেক্ষা করিতেছে, ইহা বিচড়াইতে গিয়া একটু গলধঘর্ম হইতে হয় এই যা!
সময়ক্ষেপণে ইহার ভূমিকা অনবদ্য। তাছাড়া ইহার মধ্যে স্থাপিত নানা কলাকৌশল সমৃদ্ধ নির্দেশাবলী ইহার উপযোগিতা ঢের বাড়াইয়া দিয়াছে। একটার কথা না বলিলেই নয়, জনৈক তরুণ কর্তৃক উদ্ভাবিত এক অতীব আশ্চর্য নিদর্শন, ফেসবুক যাহার নাম। বাংলা করিলে হয়তো বা অর্থ দাঁড়ায় মুখচ্ছবি পুস্তিকা। পাঠক ইহাকে পুস্তিকা ভাবিয়া ভুল করিবেন না, তাছাড়া ইহায় মুখচ্ছবির বিষয়টাও গৌণ। ধরণীর খুব কম সংবাদ রহিয়াছে যা ইহাতে পাওয়া যায় না। কে কবে কাহার সহিত কী ঘটাইয়াছে, কে কিভাবে তাহা রটাইয়াছে তাহার সকল সংবাদ বিষদ বিবরণের সহিত ইহাতে পাওয়া যায়।
এইভাবে বিশ্বের খবর রাখিতে রাখিতে, বিশ্বায়নের সহিত তাল মিলাইতে মিলাইতে দিনের আলো গোধূলিতে মিলাইয়া যায়, কথোপকথন যন্ত্রে বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দেয়। মনস্থির হয়, এইবার একটু বাহির হইতে হইবে। এই বাহির হইবার হেতু থাকে অনেক, আপাতত করিবার কিছু নাই, পুস্তকের মলাটে ধুলোর আস্তরণ জমিয়াছে ঠিক, তাহা সারাইবার জন্য পরিক্ষার আগের এক সপ্তাহই ঢের। এহেন অবস্থায় সময় কাটানোটাই বিরাট যন্ত্রনার কারন হইয়া দাঁড়ায়। যন্ত্রণাবোধ হইতে নিস্তার পাইবার লাগি আমাকে শহর পানে ছুটিতে হয়। সেথায় বন্ধুবান্ধবের নিকট হইতে মহল্লার কিছু সংবাদও প্রাপ্ত হইয়া যায়। মহল্লার পুরাতন কোন কুঠিরে নতুন কোন পরিবার নীড় বাঁধিতে আসিয়াছে কিনা, যদি আসে তাহলে তাহাদের সহিত কোন সাবালিকা, সুন্দরি, মনোহারি ললনা রহিয়াছে কিনা, তাও যদি থাকে তাহলে তাহাকে নিয়া নানান সম্ভব এবং অসম্ভব কল্পনা করিতে করিতে সময়টা ভালোই কাটিয়া যায়। আর এসব যদি নাও থাকে, তাহাতেও কোন আক্ষেপ নাই। সেথায় হরেক কিসিমের মানুষের আনাগোনা থাকে, তাদের মস্তিষ্ক হরেক কিসিমের খবরে ভরপুর থাকে, আর সেই খবরগুলোর উপস্থাপনায় তাহাদের কোন কার্পণ্য থাকে না।
এইরকম কল্পনা করিতে করিতে অথবা খবর শুনিতে শুনিতে অনেকটা সময় কাটিয়া যায়, সাঁঝের আধো আঁধার রাত্রির পুরো আঁধারে বদলাইয়া যায়, অনেকেই বাটির উদ্দেশ্যে স্থান ত্যাগ করে। আমার তেমন জলদি নাই। তাছাড়া পিতা মহাশয়ের নিদ্রা যাইবার পুর্বে ঘরে উপস্থিত হইয়া উনার সামনে পড়িয়া উনার রাগ আর ক্ষোভের উনুনে তৈল ঢালিবার ইচ্ছাও আমার নাই। তো উনার নিদ্রা যাইবার সম্পর্কে নিশ্চিত হইয়া আপন কক্ষে বিরাজমান হইতে না হইতেই খাইবার ডাক পড়ে। মমতাময়ী মাতা তখন পাতে খাবার লইতে লইতে দুনিয়ার আলাপ জুড়িয়া দেন। তবে উনার সকল আলাপই প্রবাসে অবস্থিত উনার জ্যেষ্ঠ কন্যা হইতে শুরু হইয়া দেশে উনার সামনে অবস্থিত মধ্যম পুত্র তথা আমার মাঝে আসিয়া শেষ হয়। আমি নাকি এককালে স্থুলকায় ছিলাম, শরীরের রঙ নাকি বেশ ছিল। তো সারাদিন পথে ঘাটে টইটই করিয়া বেরাইবার দায় গাত্রবর্ণ কৃষ্ণবর্ণ হইতে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিয়াছে, খাইবার প্রতি অনীহার দায় স্থূলকায় দেহ এইরকম শীর্ণকায় বনিয়াছে এই নিয়া উনার আফসোস ঝরে, আমার প্রতি তিরষ্কার ঝরে আর গামলার ভাত সব আমার পাতে ঝরে। উনি আরও ভাত আনিবার জন্য রান্নাঘরে যাইবার মনস্থির করেন, আমি পাতের ভাত সব গোগ্রাসে গিলিয়া হাত ধুইয়া কোনমতে নিজের কক্ষে ফের বিরাজমান হই।
কথোপকথন যন্ত্রখানি বিচরাইয়া তাহাতে কিছুক্ষণ অঙ্গুলি চালাইয়া একসময় বিরক্ত অঙ্গুলি আরও বিরক্ত হইয়া পাশে থাকা কোন বই আপন লয়ে টানিয়া লয়। এই বইয়ের মূল্য আমার নিকট কথোপকথন যন্ত্রের চাইতে কম নহে, বরং ঢের বেশী বলা চলে। বই পড়িবার ক্ষেত্রে আমি উপন্যাসকেই প্রাধান্য দেই বেশী। রবীন্দ্রনাথ হইতে পুঁচকেন্দ্রনাথ, হুমায়ূন হইতে ভুয়ায়ূন, সকলের উপন্যাসই আমি পড়ি। আগের অর্ধসমাপ্ত বই থাকিলে বেশ, নতুবা আঁখি যেথায় পড়ে সেথা হইতেই পড়িবার মনস্থ করি।
এইরকম সাহিত্যের রস আস্বাদন করিতে করিতে রাত্রি বেশ আগাইয়া যায়। রাত্রের আঁধার আলোর অপেক্ষা করে, আলো ছড়াইতে ছড়াইতে পূর্ণিমার চন্দ্র সূর্যের প্রতীক্ষা করে, ঘুমাইতে ঘুমাইতে বিরক্ত হইয়া দুয়েকটা পক্ষি চিৎকার করিয়া সারা বন মাথায় তুলে। আরামে ক্লান্ত, শ্রান্ত আখিঁ যুগলে তখন আশ্রয় লয় রাজ্যের ঘুম। মাঝে মধ্যে তাহাতে ভর করে দু-আধখানা স্বপ্ন, নতুবা স্বপ্নহীন, ক্লান্তিহীন অপরিপক্ব ঘুমটাই সই।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৪৫