বিএ পাশ সার্টিফিকেট অর্জন অতঃপর ব্যবসায়ে যথেষ্ট সফলতা অর্জনের পরে লোকে স্ত্রী অর্জন এবং তার মন অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করে। এরই ধারাবাহিতা বজায় রাখতে হোক অথবা বংশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে, আমার এক বন্ধুর পরিবার তার বিয়ে দেয়ার জন্য একদম আয়োজন করে কোমর বেঁধে লেগে পড়ল।
আমার বন্ধু লম্বা চওড়া, তার গ্রাজুয়েশন কম্পলিট, নিজের ব্যবসা আছে, গাড়ি না থাকলেও শহরে নিজস্ব বাসা আছে, বোন মারফত আমেরিকাতে এপ্লাই করা আছে। সুতরাং বিয়ের বাজারে তার দাম যে চড়া হবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু দাম কতটুকু চড়া হলে বিয়ের প্রথম পদক্ষেপ কন্যা দেখাদেখি এক বছর পর্যন্ত চলতে পারে তা আমার জানা নেই। সেটা জানতেই হয়তো বিয়ের বাজারে উঁকি দেয়ার একটা সুযোগ আমার কাছে ধরা দিল। বন্ধুর জন্য কন্যা দেখতে যাওয়া হবে, সাথে যাওয়ার জন্য আমারো দাওয়াত পড়লো।
একজন ঘটক কতৃক সন্ধান পাওয়া এক কন্যার বাড়িতে যাওয়া হবে, তার জন্য বিশালাকার মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করা হলো, সেটা এতই বিশাল যে আরেকটু বিশাল হলে তা বাসের স্বীকৃত পেয়ে যেত। যাত্রী হিসেবে আমরা চারজন পুরুষ, বাকি সব মহিলা। স্বভাবতই যাত্রাকালীন সময়ে মহিলারা দেরী করতে ওস্তাদ, কিন্তু আজকে যার জন্য দেরী হচ্ছে তিনি একজন পুরুষ, তিনি একজন ঘটক । অতি স্বন্ত্রস্থ ব্যস্ত হয়ে একসময় ওনারও আগমন ঘঠল। ঘটক শব্দটা শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে এমন একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি, যার থুতনিতে দাড়ি, মুখে পান, গালে বড়সড় একটা তিল, মাথায় টুপি আর হাতে ছাতা। কিন্তু ইনার মধ্যে এসবের কোন বালাই নাই। তিনি যথেষ্ট সুপুরুষ, হাতে একটা কালো ব্যাগ মাত্র। তবে চিরাচরিত গুন(?) হিসেবে বেশী কথা বলা ইনার অভ্যাস বলে মনে হলে। সারা পথে ইনি কন্যা পক্ষের অনেক সুনাম করে চললেন। মাঝে মাঝে বন্ধুর বাবা দুয়েক কথার জবাব দিচ্ছেন, মাঝে মাঝে এডিয়ে যাচ্ছেন। তাতে ঘটক মহাশয়ের বক্তব্যে ভাটা পড়ছে না। উনার কথা শুনে মনে হতে পারে উনি বরপক্ষের নয়, বরং কন্যাপক্ষের লোক। গাড়িতে অবশ্য মহিলারাও অলস বসে নেই। তারা তাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, সম্ভাব্য বধূর মধ্যে কি কি গুন থাকা আবশ্যক তা নিয়ে তাদের আলোচনা ঘটকের আলোচনা থেকেও বেশী জমে উঠেছে।
"বুঝলেন চাচী, মেয়েকে অবশ্যই লম্বা হতে হবে। আমার দেবরের তালতো ভাইয়ের বউয়ের মত বেঁটে হলে কিন্তু সাড়ে সর্বনাশ।"
অতঃপর তিনি তার দেবরে তালতো ভাইয়ের বউ বেঁটে হওয়ার করনে কি কি ব্যত্যয় ঘটেছে তার সম্ভব এবং অসম্ভব বর্ণনা করে গেলেন। আরেকজন তার আরেক আত্বীয়া, এর পরেরজন তার কোন আত্বীয়া, এবং আত্বীয়ার আত্বীয়ার মাঝে কি কি গুনাবলির সংকট রয়েছে তা বলে শুনালেন। এদের কথা শুনে, এদের খানদানের অসংখ্য মানুষ, অসংখ্য গুনাবলি থেকে বঞ্চিত বলে মনে হতে পারে।
গাড়ির সামনে বসা ঘটক সাহেব এবং পেছনে বসা মহিলাগন তাদের বক্তব্য পেশ করে বক্তার চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে তুলতে এবং মাঝখানে বসা আমি আমার শ্রবন শক্তির সদ্ব্যবহার করে উত্তম শ্রোতার চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে তুলতে এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম কন্যার বাড়িতে। বাড়িটি রাজপ্রাসাদ না হলেও বেশ খানদানি বলা চলে। আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে আমার বন্ধুর শ্বশুরালয় ভাগ্য ভালো বলতে হবে। গাড়ি থেকে নেমেই ঘটক তার দল পরিবর্তন করলেন বলে মনে হল। এখন তিনি পুরোটা বর পক্ষের। বর পক্ষ সম্পর্কে যত ভালো ভালো কথা বলা সম্ভব তিনি তার থেকেও বেশী বললেন। আমার বন্ধুর সম্পর্কে এমন কিছু গুনাবলির কথা বললেন যে তা আমি কি, স্বয়ং আমার বন্ধুই হয়তো জানতো না।
ছেলে পড়ালেখায় ফার্স্ট ক্লাস, মনে মনে ভাবলাম পরিক্ষার হলে তাহলে আমি নকল সাপ্লাই করতাম কাকে?
সে নাকি চরিত্রের দিক দিয়েও মাশাল্লাহ! ভাবলাম খামোখাই না এত কষ্ট করে মেয়েদের ফোন নাম্বার কালেক্ট করতাম আমরা। আর থার্টি ফার্স্ট নাইটে আমি কি বন্ধুরুপি জ্বীন-ভূতের সাথে যেতাম?
এরকম অসংখ্য না জানা গুনাবলি শুনতে শুনতে স্বাগতিকরা আমাদের আতিথেয়তা করল, আমরাও আতিথ্য গ্রহন করলাম। নিজেদের মধ্যে অনেক আলাপ চালিয়ে গেলাম। তবে আমার মনযোগ বেশী টানছিল দরজার ওপাশে উঁকি ঝুকি মারা মেয়েদের দিকে। জানা কথা যে এদের মধ্যে কেউ সম্ভাব্য বন্ধুপত্নী নয়। তাই এদের দিকে এঁকেবেঁকে চাইলেও বন্ধুত্বের হক নষ্ট হবেনা। এরকম কথা চালাচালি আর দরজার ফাঁকে চোখ চাওয়াচাওয়ি করার মাঝেই হঠাৎ অন্দরে খবর পাঠানো হল কন্যাকে নিয়ে আসার জন্য। দরজা খুলে গেল, ঘরে এক শাড়ী পরিহিতা প্রবেশ করলেন, আমাদের মহিলারা নড়েচড়ে বসলেন।....
কন্যার এন্ট্রি হল, তিনি ধীর লয়ে এগিয়ে আসছেন, পাছে উনার দুই পাশে আরও গুটিকতক ললনা উনাকে নিয়ে আসছেন। মনে মনে ভাবলাম, সার্থক বাংলা সিনেমা।
মেয়ের হাঁটা দেখে আমাদের একজন মহিলা মন্তব্য করলেন, মেয়ের হাঁটা খুব সুন্দর। ভাবসাব এমন, যেন উনি একে দিয়ে ম্যারাথন দৌড় দেওয়াবেন।
মেয়েটি এসেই ক্ষিন কন্ঠে সালাম দিল। ঠিক কাকে সালাম দিল বুঝতে পারলাম না, আমি ওয়ালাইকুম বলব কিনা তাও বুঝতে পারছি না এমন সময় আরেকজন মহিলা মন্তব্য করলেন, মেয়ের গলা নাকি কেমন যেন।
এই রূনা লায়লার ভক্ত আসলে কে তা ঠাহর করতে আমি কিছুটা পেরেশান হচ্ছিলাম, তার চাইতেও বেশী পেরেশান হচ্ছিলাম এটা ভেবে যে এত ক্ষিন আওয়াজ আমাদের পাশ কাটিয়ে উনার নিকট পৌঁছালো কি করে। হয় আমি কানে কম শুনি, নতুবা উনি শুনেন বেশী।
আমাদের মহিলা মন্ডল নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করছেন, পাশাপাশি মেয়েটিকে বিভিন্ন প্রশ্নও করছেন।
মেয়েটি কী কী পছন্দ করে
কী কী রাঁধতে পারে
শাড়ি পড়ে নাকি সেলুয়ার-কামিজ
এমনকি একজন জিজ্ঞেস করল, ক্রিকেট খেলা দেখে কি না।
মেয়েটি জানালো সে ক্রিকেট খেলা দেখে।
মনে মনে ভাবলাম, শহীদ আফ্রিদির ভক্ত কিনা তা জিজ্ঞেস না করলেই হলো।
এদিকে আমার বন্ধুর বাবা কিছুটা কানাকানি করলেন, কিছুটা চোখাচোখিও করলেন এবং একসময় দৃঢ় কন্ঠে ঘোষনা করলেন যে কন্যা উনার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু যার জন্য কন্যা তার পছন্দ হল কিনা কেউ জিজ্ঞেস করার দরকার মনে করল না। জানা গেল ছেলেও নাকি কন্যাপক্ষের পছন্দ হয়েছে। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে শোকরিয়া আদায় করলেন। আমরা কিছুটা রিলাক্স করলাম। কিন্তু মেয়েটির রিলাক্স হবার কোন উপায় ছিল না। তার ভাইবা তখনও চলছিল।
-আপনি কোন কলেজে পড়ালেখা করেছেন?
-বলুনতো বেতরের নামাজ সুন্নত নাকি নফল?
-আমপারার কয়টা সূরা মুখস্থ?
-দেড় সের চালে কয় সের পানি দিতে হয়?
কন্যাটি যখন সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সমস্ত পরিক্ষায় পাশ করল তখন পরিক্ষা পাশের মার্কশিট স্বরূপ তার হবু শাশুড়ি, হবু ঝিয়ারি, হবু ননদ এবং আরও অনেক হবু সম্পর্কিত মহিলাগন তাকে বিস্তৃত হাসিমুখে বরণ করলেন, তাকে একে একে জড়িয়ে ধরলেন। আমারও জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হল। কিন্তু জীবনের অনেক ইচ্ছাই অনিচ্ছা আর অসম্ভবতার পদতলে বিদীর্ণ হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১:৩১