প্রকৃতিকন্যা খ্যাত বাংলদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে প্রতিষ্ঠিত উদ্ভিদরাজির বিরল সংগ্রহশালা বোটানিক্যাল গার্ডেন। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন এবং কৃষি শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। জ্ঞান, দক্ষতা, চরিত্র প্রতীকীবাহী এই প্রতিষ্ঠান কৃষি শিক্ষা ও গবেষণায় যেমন শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী তেমনি এর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেশবাসীর পাশাপাশি বিশ্ববাসীকে যেন বিমুগ্ধ করে প্রতিনিয়ত। ময়মনসিংহ শহরে অবস্থিত অসংখ্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম বোটানিক্যাল গার্ডেন। গার্ডেনটির সৌন্দর্য যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আর শহরে আগত দর্শনার্থীদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।
দেশে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের পাশাপাশি এখানে রয়েছে বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ প্রজাতি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সমপ্রসারণ, দর্শনার্থীদের বিনোদনে সহায়তা, উদ্ভিদ জগতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করার অফুরন্ত সুযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুটা আর্থিক সহায়তা প্রদান করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঠিক ২ বছর পর বিলুপ্ত ও প্রায় বিলুপ্ত উদ্ভিদরাজিকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে ১৯৬৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ এবং তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ওসমান গণির হাত ধরে ২৪ একর জমি নিয়ে গার্ডেনটি যাত্রা শুরু করে।
বাকৃবির ক্যাম্পাসে অসংখ্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম বোটানিক্যাল গার্ডেন। প্রতিষ্ঠার শুরুতে গার্ডেনটি আয়তনে খুবই অল্প থাকলেও বর্তমানে গার্ডেনটির আয়তন প্রায় ২৫ একর। আর এ গার্ডেনটি শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য এনে দিয়েছে তাই নয় এর মাধ্যমে পুরো ময়মনসিংহ শহরে সৃষ্টি হয়েছে নতুন মাত্রা।
দেশের মূল্যবান উদ্ভিদ প্রজাতি বিশেষ করে বিরল প্রজাতির হারবাল জাতীয় ঔষধি ও সুগন্ধি জাতীয় উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য রয়েছে পট হাউজ নামে বিশেষ সংরক্ষণাগার। ঔষধি জোনে রয়েছে ৪৮ প্রজাতির উদ্ভিদ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- অশ্বগন্ধা, ব্রাউনিয়া, কর্পুর, আগর, অঞ্জন, অ্যানথেরিয়াম ইত্যাদি। ক্যাকটাস ও অন্যান্য সংবেদনশীল উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য দুটি বড় গ্রিন হাউজ রয়েছে গার্ডেনটিতে। বিভিন্ন ধরনের ফুলের মধ্যে রয়েছে- জেসিয়া, সিলভিয়া, হৈমন্তি, ক্যামেলিয়া, আফ্রিকান টিউলিপ, ট্যাবেবুইয়া, রাইবেলী, অ্যাস্টার, কসমস, ডায়ান্থাস, রঙ্গণ ইত্যাদি। ফলের মধ্যে রয়েছে- স্টার আপেল, আমেরিকান পেয়ারা, কমলা, আঙুর, প্যাসান ফল এবং বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফল। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে- ডেফল, নাগলিঙ্গম, কালাবাস, কারিলিফ, ফলসা, মনহোটা, পেয়ালা, মাক্কি, বনডুবি, লোহাকাট, উদাল, পানবিলাস, অর্জুন, বয়রা, হরতকি, কাটাসিংড়া, টিকমা, প্যাপিরাস, রাইবেলী, স্ট্যাভিয়া, হিং, পেল্টোফোরাম ইত্যাদি। বছরের প্রায় সময়ই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় চার লাখেরও বেশি দর্শনার্থী গার্ডেনটি পরিদর্শনে এসে মুগ্ধ হয়।
গার্ডেনের সৌন্দর্য বর্ধন এবং দর্শনার্থীদের অধিক বিনোদনের জন্য বন্য পশু-পাখির প্রতিকৃতি নির্মাণ করে বিভিন্ন দর্শণীয় পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিকৃতির মধ্যে দ্বীপ জোনে দুটি রাজহাঁস ও দুটি সারস (বড় সাদা বক), গেইটের সম্মুখে পাইন গাছের গোড়ায় পশুর রাজা সিংহ, অরকোরিয়া গাছের গোড়ায় শান্ত ভদ্র প্রাণী হরিণ, বাগানের ভেতরের প্রবেশ দ্বারের প্রথম আর্চের সামনে হিংস্র রয়েল বেঙ্গল টাইগার, পাশেই অন্য আর্চের উপর ছানাসহ বাঘের মাসী বিড়াল এবং গেইট সংলগ্ন জোনের কেন্দ্র বিন্দুতে সকল দর্শাণার্থীদের শুভ কামনায় শাবকসহ প্রার্থনারত অবস্থায় দন্ডায়মান রয়েছে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের জাতীয় পশু ক্যাঙ্গারু।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে দর্শার্থীদের বিশ্রাম ও মন খোলে নিরিবিলি সবুজ পরিবেশে আড্ডা দেওয়ার জন্য রয়েছে বিশ্রাম বেঞ্চ। গার্ডেনের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সৌন্দর্য্য উপভোগের ক্ষেত্রে দর্শনার্থীরা ক্লান্তি সেরে নেয়ার জন্য অথবা আলাপ-চারিতা সেরে নেওয়ার জন্য বিশ্রাম বেঞ্চের সান্নিধ্যে যায়। বিশ্রাম বেঞ্চগুলো নদীর পাড় ঘেষে হওয়ায় ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে ভেসে যাওয়া পালতোলা অথবা ইঞ্জিন চালিত নৌকায় আরোহী হাজারো শ্রমজীবী মানুষ ও নাইওরীদের দর্শন মেলে।
মোট ৫৫৮টি গাছের প্রজাতি নিয়ে প্রজাতির দিক থেকে দেশে একনম্বর বোটানিক্যাল গার্ডেন এটি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের বিভিন্ন জোনে ভাগ করা হয়েছে, যাতে দর্শনার্থীরা হরেক রকম উদ্ভিদরাজির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। সব মিলিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর আর সমৃদ্ধ উদ্ভিদরাজির বোটানিক্যাল গার্ডেনকে নিয়ে গর্ব করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ও ময়মনসিংহবাসী। এ বোটানিক্যাল গার্ডেনটি দিনের পর দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তার সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের মাঝে বিলিয়ে যাবে এমনটিই প্রত্যাশা সকলের।
গার্ডেনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্থিকভাবে সাহায্য পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম, স্নাতক পর্যায়ে বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষার্থীদের উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন এবং এম.এস গবেষণা ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের কার্যক্রমে বিভিন্নভাবে সহায়তা প্রদান করে আসছে।
প্রধান গেইট শিক্ষার্থীসহ জনসাধারণের প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জন্য সপ্তাহে ৭ দিনই সকাল ৯ টা হতে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। নান্দনিক ডিজাইন ও আলোকসজ্জার মূল গেইটটি যেন দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাতে সদা প্রস্তুত থাকে।
▪ এক নজরে ময়মনসিংহে অবস্থিত দর্শনীয় স্থান সমূহঃ
মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ী ও ছানা-চিনিতে তৈরী দেশসেরা মণ্ডা
নদের তীরে শিল্পাচার্য জয়নুল উদ্যান ও সংগ্রহশালা
কালের সাক্ষী আলেকজান্ডার ক্যাসেল
ময়মনসিংহের ঐতিহাসিক ‘শশী লজ’
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০২১ বিকাল ৪:০৮