ব্রহ্মপুত্রের তীরে অবস্থিত সবুজ সুন্দর শহর ময়মনসিংহের প্রাণকেন্দ্রে জমিদার আমলের এক অনন্য স্থাপনা ‘শশী লজ’। ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শশী লজ একসময়ের মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্তের বসতবাড়ি ছিল। নিজ পুত্র (ভাতিজা ও দত্তকপুত্র) শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে ঊণবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এটি নির্মিত হয়। বাড়িটি ছিল দ্বিতল ভবন। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে বিখ্যাত ‘রংমহল’ ধ্বংস হয়ে গেলে সেই স্থানে নির্মান শুরু করেন বাইজেন্টাইন ধাঁচের বর্তমান ভবনটি। ভবনটির নির্মান সম্পন্ন হওয়ার আগেই সূর্যকান্ত আচার্য মত্যুবরণ করেন। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী ভবনটির নির্মান শেষ করেন ১৯০৫ সালে এবং তাঁর নাম অনুসারে এর নামকরণ করেন ‘শশী লজ’।
মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নির্মান করেছিলেন মনোরম এই প্রাসাদ
শশী লজের সম্মুখ ফটক
শশী লজের সম্মুখ চত্বরে মার্বেল পাথরের ভেনাসের মূর্তি
দ্বিতল ভবনের সিঁড়িতে বিশেষ বাদ্যের ব্যবস্থা ছিল। সিঁড়িতে মানুষ চলাচল করলেই সুমধুর বাজনা বাজতো। জানা যায়, প্যারিস থেকে মহারাজা এক লক্ষ (মতান্তরে তিন লক্ষ) টাকা ব্যয়ে স্ফটিক সঙ্গীত বাক্সটি কিনে এনেছিলেন। দ্বিতল শশীলজ ধ্বসে যাবার পর মহারাজা তার এলাকায় দ্বিতল পাকা বাড়ি নির্মাণ নিষিদ্ধ করেন।
বয়সের ভারে জমিদার বাড়িটি বৃদ্ধ হলেও মনোরম চারপাশের প্রকৃতি, প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী যা আপনার চোখের দৃষ্টিকে ধরে রাখবে একটানা। চাইলেও পারবেন না চোখের দৃষ্টিসীমা অন্য কোথাও নিক্ষেপ করতে। বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত অয়োময় নাটকটি এই বাড়িতেই নির্মিত হয়েছিল। সেই থেকে স্থানীয়ভাবে ‘শশী লজ’ জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত হতে থাকে।
ময়মনসিংহ শহরের অন্যতম দ্রষ্টব্য শশী লজ
৯ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত শতাধিক বছরের পুরানো এই বাড়িটি এখনও তার সেই আভিজাত্য ও জৌলুশ ধরে রেখেছে। মূল ফটকে আছে ১৬টি গম্বুজ। শশীলজের মূল ভবনের সামনে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাগান। তাতে শোভা পাচ্ছে ফুল ও দুর্লভ সব গাছ-গাছালি। সাধারণ বাসভবন ছাড়াও বাড়িটিতে আছে হলঘর, বিশ্রামঘর, নাচঘর, স্নানঘর। সর্বমোট ২৪ টি কক্ষ রয়েছে এই ভবনটিতে। বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা, যার মাঝখানে রয়েছে গ্রিক দেবী ভেনাসের সল্পবসনা স্নানরতা মর্মর মূর্তি।
লাল ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশীলজের পাশেই আছে পদ্মবাগান। শশী লজের ভেতরের বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গশালা। সুদৃশ্য সেই রঙ্গশালার এক প্রান্তে বিশ্রামঘর। বিশ্রামঘরের পর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। হলঘরের পাশেই মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা। মূল ভবনের পেছনভাগে রয়েছে একটি দোতলা স্নানঘর।
কথিত আছে এই স্নানঘরে বসে রানী পাশের পুকুরে হাঁসের খেলা দেখতেন। পুকুরটির ঘাট মার্বেল পাথরে বাঁধানো। এছাড়াও অর্ধ গোলাকার খিলান এবং ডরিক স্তম্ভ সম্বলিত প্রধান প্রবেশ পথটি শশী লজের স্থাপত্যিক সৌন্দর্য বাড়তি শোভা যোগ করেছে । বাড়িটিতে বেশ কিছু স্নানঘর রয়েছে। এক স্নানঘরে রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ। ধারণা করা হয় এই সুড়ঙ্গপথেই গোপনে মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। উল্লেখ্য, মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতেও এই রকম একটি সুড়ঙ্গপথ পাওয়া যায়।
বাগানের প্রধান আকর্ষণ শ্বেতপাথরের ফোয়ারা। তার মাঝে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্বল্পবসনা স্নানরতা অর্পূব মর্মর মূর্তি। এটি যেন ইউরোপীয় ঘরানার কোনো ভাস্কর্য। বুকের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় সৌন্দর্যের আবেশ। রোদ ঝলমল দিনে কিংবা পড়ন্ত বেলায় সোনালী আভার আলোকছটায় আপনি যে পাশ থেকে দেখুন না কেন দেবী ভেনাসের রূপে আপনি মাতাল হবেন। নিশ্চিত প্রেমে পড়ে যাবেন ভেনাসের। ঐ আঙিনা ছেড়ে আপনাকে আসতে মন বাধাঁ দিবে বার বার।
এ প্রাসাদটি ‘ক্রিস্টাল প্যালেস’ বা ‘রংমহল’ নামেও পরিচিত ছিলো
হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত অয়োময় নাটকটি এই বাড়িতেই নির্মিত হয়েছিল
এককালে বাড়িটি ছিল শহরের সেরা বাড়ি
হলঘরের পাশেই মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর ১৯৮৯ সালে ‘শশী লজ’কে সংরক্ষিত স্থাপনা হিসেবে ঘোষনা করে এবং এখানে একটি জাদুঘর নির্মানের প্রকল্প নেয়া হয়। তবে অদ্যাবধি শশী লজের অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে শশী লজ শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় (মহিলা) হিসেবে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। মুল ভবনের ভিতরে প্রবেশধিকার সংরক্ষিত। দুষ্টিনন্দন কারুকাজে সজ্জ্বিত ভবনের বাইরে থেকে বাড়িটাকে যতটুকু দেখা যায় তাতেই মুগ্ধতা ছুয়েঁ যায়। অচিরেই এটি দর্শনীর বিনিময়ে উম্মুক্ত করা হবে বলে জানা যায় ।
▪ এক নজরে ময়মনসিংহে অবস্থিত দর্শনীয় স্থান সমূহঃ
জমিদার বাড়ী ও ছানা-চিনিতে তৈরী দেশসেরা মণ্ডা
নদের তীরে শিল্পাচার্য জয়নুল উদ্যান ও সংগ্রহশালা
আলেকজান্ডার ক্যাসেল
বাকৃবি সৌন্দর্য ‘বোটানিক্যাল গার্ডেন’
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০২০ দুপুর ১২:০০