অভিজিৎ রায়। কলম সৈনিক, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলা ভাষায় প্রচলিত ব্লগগুলোর অন্যতম একটি। বাংলা ব্লগগুলোতে যারাই ডু-মারেন তাদের অধিকাংশ অভিজিতের লেখনির সাথে পরিচিত। বাক-স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে পরমতের উপর আঘাত হানার এমন কোনো উপাদান নেই যা তার লেখনিতে পরিলক্ষিত হয়নি। তাইতো অনেকেই তাকে নাস্তিক ব্লগার বলে আখ্যায়িত করেছেন। নাস্তিক মানে যদি কোনো ইশ্বর বা প্রভূতে অবিশ্বাসী হওয়া হয় তাহলে তাকে নাস্তিক বলা যাবে কিনা তা নিয়ে রীতিমতো আমার মনে প্রশ্ন জাগে। কারণ যারা অপরের প্রভূকে গালি দেয় পকারান্তরে তারা প্রভূ বা ইশ্বরকে স্বীকার করে নেয়। একদিকে তারা নিজেরা প্রভূকে স্বীকার করে নিচ্ছে অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে অপরের ধর্মের প্রতি অবিরত আঘাত করে যাচ্ছে। যাই হোক অভিজিতের কর্মকা-ের পর্যালোচনা করা আমার এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। যদিও তার এই সকল কর্মকা-কেই তাকে খুন করার পিছনের রহস্য হিসেবে মনে করছেন অনেকে। অবশ্য যার প্রমাণও মিলেছে ফারাবী নামক একজন ব্লগারকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে।গত ২৬ ফ্রেবুয়ারী রাতে ঢাবির টিএসসির মতো এমন একটি স্থানে যেখানে বই মেলার হাজারো দর্শক, ক্রেতা, নিছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পুলিশ সদস্যদের সরব উপস্থিতি তার উপর আবার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার নজরদারি। এতসবের ভিতরে কে বা কারা অভিজিৎ রায়কে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়।এত ধরনের নিরাপত্তার ভিতর দিয়ে অভিজিতের মতো একজন পরিচিত লেখক, ব্লগারকে হত্যা করার পর বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী, ডিবি, এনএসএই সহ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা এক ফারাবীকে আটক করা ছাড়া আর কোন ক্লু বের করতে পারেনি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যখন এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের রহস্য বের করতে রীতিমতো নাকানি চুবাতি রয়েছে তখনই দেখা যায় কিছু মিডিয়ার টকশোতো পত্রিকার কলামে কিছু তথাকথিত সুশীল নামের চেতনা ব্যবসায়ীরা এই হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের একের পর পিরিস্থি বাহির করার চেষ্টা করছে। অনেকটা ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাই না এই টাইপের ব্যাপার।অভিজিত হত্যাকা-ের রাতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের টকশোতে একে বারে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছেন অভিজিতের প্রতিষ্ঠিত মুক্তমনা ব্লগটি জামায়াত শিবির বাংলাদেশে বন্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে এটি বাহিরে দেখা যায় কিন্তু বাংলাদেশে থেকে কেউ ঢুকতে পারছেনা। এই একই ব্যক্তি ২রা ফ্রেবুয়ারী ‘কালেরকণ্ঠ’ নামক পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় “অভিজিৎ হত্যা : বাংলাদেশ কোন পথে” এই শিরোনামে একটি কলাম লেখেন যেখানে তিনি অভিজিৎ হত্যার পিছনে বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে কতগুলো যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। শাহরিয়ার কবির ব্যক্তি হিসেবে ইদানিং বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত পরিচিত মুখ। বিতর্কিত নাকি গ্রহণযোগ্য সেটির বিচার করবেন পাঠকবৃন্দ, তবে তার ব্যাপারে এতটুকু বলতে পারি দেশের অনেক স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধা তাকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর মুরগী সাপ্লাইয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কেউ আবার তার বিচারের দাবিও তুলেছে। যাই হোক কাউকে ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। জনাব কবিরের মতো তথাকথিত সুশীলদের এই ধরনের তথ্য প্রমানহীন কল্পনা প্রসুত কথাবার্তা শুনে আমার অতি সাধারণ প্রচলিত একটি গল্প মনে পড়ে যায়। এক ব্যক্তি শহরে বাড়ি পাহারা দেওয়ার কাজ করতো। একবার লোকটি ছুটিতে নিজ বাড়িতে বেড়াতে আসল। লোকটি শহর থেকে এসেছে, অনেক নগদ অর্থ ছিল তার সাথে এই ভেবে চোর আসল তার বাড়িতে। কিন্তু বেচারা চোর যখনই তার ঘরে ডু-মারে তখনই লোকটি চিৎকার করে উঠে “এই কে রে” “এই কে রে” চোর বেচারা আজও দৌড় কালও দৌড়। পরদিন চোর আবার আসল, এসে আবার একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে চোর ভাবলো লোকটি কি রাতে ঘুমায় না? আজ আমি এর শেষ দেখব। কিছুক্ষন অপক্ষো করার পর বুঝতে পারলো শহরে বাড়ি পাহারা দিতে দিতে এটি লোকটির অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। তাই চোর একমুর্হুত ধেরি না করে তার কাজ সেরে চলে গেল। আর এই দিকে লোকটি “এই কে রে” “এই কে রে” করতে থাকলো। পকারন্তরে কোনো লাভ হলো না। আমাদের তথাকথিত সুলীল সমাজের এই রোগে ধরেছে। শাহবাগে রাজিব হত্যাকা-ের পর এরা সবাই এক সুরে বলে উঠল এটি জামায়াত-শিবিরের কাজ। পরবর্তী তে ধরা পড়ল অন্যরা যাদের সাথে জামায়াত-শিবিরের দূরতম কোনো সম্পর্ক খুজে পাওয়া যায়নি। সারা বাংলাদেশে যখন আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে মারছিল তখন এরা বলা শুরু করেছিল এগুলো জামায়াত-শিবিরের কাজ। অন্যদিকে মিডিয়াতে প্রতিনিয়ত-ই-দেখা যায় হাতে নাতে কয়েক ডজন আওয়ামী সন্ত্রাসী পেট্রোল বোমা সহ ধরা পড়ছে। আর অন্যদিকে নিরাপরাধ ছেলেদেরকে মায়ের কোল থেকে তুলে নিয়ে ঠা-া মাথায় গুলি করে হত্যা করে সাজানো হয় বন্ধুক যুদ্ধ নাটক। ঠিক এই সময়ে যখন অভিজিৎ রায় খুন হয় তখন এই শাহরিয়া কবির এর মতো সুশীলরা চিৎকার চেচামেচি করে বলতে লাগলো এটিও জামায়াত-শিবিরের কাজ। মূলত এই ধরনের তথাকথিত সুশীলদের বাড়ি পাহারা দেওয়া ঐ লোকটির বদ অভ্যাসে ধরেছে। বাংলাদেশে যখন কোন ধরনের অপরাধ ঘটে এরা কোমরে গামছা বেঁধে জামায়াত-শিবিরের ডোল নিয়ে রাস্তা নেমে পড়ে। আর এই সুবাধে প্রকৃত অপরাধী, খুনিরা ঐই চোরের ন্যায় সুযোগ গ্রহণ করে আড়ালে চলে যায়। চোর যেমন বুঝতে পারেছে “এই কে রে” “এই কে রে” বলা লোকটির বদ অভ্যাস তেমনি খুনিরাও বুঝতে পারে “জামায়াতÑশিবির” “জামায়াত-শিবির” বলে ডোল পিটানো এদের কাজ সুতরাং আমাদের রাস্তা পরিস্কার।এইতো গেলো চেতনা ব্যবসায়ীদের বিষয় এখন আরেকটি বিষয় খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন জামায়ত-শিবিরের উপর দায়ভার চাপিয়ে এরা কি প্রকৃত খুনিকে সনাক্ত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে নাকি নিজেদের ঘরে খনিদের লুকিয়ে রেখে অপরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে?প্রিয় পাঠক, একটি বিষয় পরিস্কার ২০০৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারীতে যখন গণজারগণ মঞ্চের জন্ম তখন এ দেশের হাজারো মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে একত্বতা ঘোষনা করে ঐক্যবদ্ধ হতে শাহবাগে জড়ো হয়েছিল। সাধারণ মানুষ সেখানে কোনো ধরনের লাকি, ইমরান বা রাজিবদের জন্ম দিতে জড়ো হয়নি।মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে মানুষ যখন স্বাধীনতার স্বপক্ষে বজ্রকণ্ঠে শ্লোগান তুলছে আমরা তখন দেখেছি এই সাধারন মানুসৈর আবেগকে কাজে লাগিয়ে কারা বাংলার মসনদে হিরো হতে চেয়েছে। আমরা এও দেখেছি মাতৃ্ন্সেহের ভালোবাসা নিয়ে যে শিশুটি সেদিন শাহবাগে এসছিল তার এই আবেগকে নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতির খেলা। শুধু ঘৃণ্য রাজনীতির খেলাই এর শেষ নয় বরং রীতিমত গড়ে তোলা হয়েছে চেতনা ব্যবসা কেন্দ্র। তাইতো মাত্র দুবছরের মাথায় আরেক ফেব্রুয়ারীতে শাহবাগ খাঁ-খাঁ করছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সাধারণ মানুষ এখন আর সেখানে জড়ো হয় না, কিন্তু চেতনা ব্যবসায়ীরা ঠিকই সেখানে আসন পেতে বসে আছে। ইতোমধ্যে যাদের ব্যবসায়ীক শো-রুম একটি ভেঙ্গে কয়েকটি শো-রুম হয়েছে। যার একটির নেতৃত্ব দিচ্ছে ইমরান এইচ সরকার অন্যটির বাপ্পা দিত্ত বসু। চেতনা ব্যবসায়ীদের এই চেতনা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ইতোপূর্বে কয়েকবার শো-রুমের মালিক দাবিদারদের কয়েক দফা মারামারি, পাল্টা পাল্টি কর্মসুচী দিতে দেখা গিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষের মনে শাহবাগের প্রতি শুধু ঘৃণাই নয় বরং ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে এই চেতনা ব্যবসায়ীরা। যাই হোক মূল কথায় আসি। আপনারা যারা প্রাপ্ত বয়স্ক বালেগ আপনাদের সকলেরই মনে থাকার কথা ২০০৬ সালের ২৮-ই- অক্টোবরের লগি বৈঠার হত্যাকা-ের কথা। দিনের আলোতে সেদিন লগি-বৈঠা দিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যা করে লাশের উপর নৃত্যকা- ঘটেছিল। যা ইতিহাসে এক জঘন্য পৈশাচিকতার জন্ম দেয়। এমন ঘৃণ্য হত্যাকা-ের সাথে সরাসরি জড়িতদের একজন হচ্ছে শাহবাগের চেতনা ব্যবসার শো-রুমের মালিক বাপ্পা দিত্ত বসু। সামান্য ক্ষমতার লোভে যে দিনে দুপুরে মানুষ খুন করে নাশের উপর নৃত্য করে চেতনা ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য এই বাপ্পা প্রতিপক্ষকে খুন করবে না এই গ্যারাণ্টি কি দিবেন জনাব শাহরিয়ার কবির? প্রশ্ন থেকেই যায়।নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে আটক করা হয়েছে বির্তকিত ফোনালাপের মাধ্যমে ঢাবিতে লাশ চাওয়ার জন্য। তাইতে আমাদের মাননীয় স্বাস্থ মন্ত্রী উচ্ছকণ্ঠে বললেন, অভিজিৎ ঢাবিতে মান্নার চাওয়া প্রথম লাশ। বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ মান্না সাহেব লাশ চেয়েছিলেন কিনা তা এক পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হলেও তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিবৃতি দেওয়ার পূর্বেই আটক করা হয়। হয়তো মান্না সাহেব লাশ চেয়েছেন আর তা জনগণকে উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, আর তাদের এহেনও অপরাধ ডাকতে তার দায়ভার জামায়াত-শিবিরের উপর চাপানো দায়িত্ব নিয়েছেন তথা কথিত সুশিল সমাজের শাহরিয়ার কবিররা। এই কারণে হয়তো জনাব মান্না সাহেবকে সংবাদ সম্মেলনটুকুও করতে দেওয়া হয়নি। এমনটি ঘটলেও একেবারেই অবাক হওয়ার কিছুই থাকেবেনা।মোদ্দা কথা যেখানে আপন ঘরে হাজারো শত্রুর আনাগোনা। বাপ্পা দিত্ত বসুর ন্যায় লগি বৈঠার খুনির রক্তচক্ষু, ছাত্রলীগের মতো দায়িত্বশীল ও পুরস্কার প্রাপ্ত খুনি সংগঠনের অবাধ বিচরণ সেখানে তথাকথিত সুশীলরা এদের নাম নিতে একটু ভয়তো পেতেই পারেন। তাইতো জামায়াত-শিবিরের উপর দায়ভার চাপিড়ে উপরি পাওয়ার চেষ্টা চালাতে তো আর বাধা নেই। অভিজিৎ রায়ের হত্যাকা- কোন সুস্থ মস্তিস্ক ও বিবেক সম্পন্ন কোন ব্যক্তি যেমন সমর্থন করতে পারে না; ঠিক তেমনি রম্য রচনা লিখে প্রকৃত অপরাধী কে ধামা চাপা দিয়ে খুনিদের আনুকল্য পাওয়া যায় কিন্তু জনগণের সমর্থন পাওয়া যায় না। পাপ তার বাপকে ছাড় দেয় না এমটি সবার ই জানা।অভিজিৎ সহ এই ধরনের সকল হত্যাকা-ের সুষ্ঠ বিচার হোক এটি যেমন সবার দাবি তেমনি অভিজিতদের মুক্ত চিন্তার নামে অপরের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত হেনে কেউ যেন বিনা বিচারের পার পেয়ে যেতে না পারে তার জন্য উপযুক্ত আইন প্রনোয়ন করে তার যর্থার্থ প্রয়োগ করা। তবে ই বন্ধ হবে হত্যা কা-, বন্ধ হবে তথাকথিত সুশিলতার নামে চেতনার ব্যবসা। জনগন ভোগ করবে তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা।