শীতল যুদ্ধের অবসানের পরপরই একক বিশ্বের প্রধান শক্তিরূপে আভির্ভূত যক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হলো। নিজের অবস্থান ধরে রাখতে আরও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি ওয়াশিংটনে গৃহীত হলো। এরই প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদ ও প্রভাব রক্ষার্থে নতুন ছক কাটা হলো। এর মধ্য দিয়েই প্রতিপক্ষ তৈরি হলো কথিত ইসলামি উগ্রবাদ। তার পরের ইতিহাস অতি সাম্প্রতিক, সবারই জানা। প্রথমে আফগানিস্তান, পরে ইরাক, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং বর্তমানে নতুন আঙ্গিকে সিরিয়া ও ইরাকের পরিস্থিতি সমগ্র মুসলিমপ্রধান রাষ্টগুলোতে নতুন ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। ২০০১ সালে সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করে। ১৩ বছর পর ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের হাজার হাজার সেনা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছে। ভয়াবহ রকম যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানকে স্বাধীনভাবে দেশের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রতিরোধ করার কাজ শুরু করতে হয়, যাতে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও আইন ব্যবস্থা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা যায়। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান বর্তমানে কী কী সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে? এর ভবিষ্যৎ কোথায়? তালেবান পরবর্তী আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থান কি এই প্রবন্ধ তা আলোচনার প্রয়াস মাত্র।
আফগানিস্তাানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় :
আফগানিস্তান, যার সরকারী নাম আফগানিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র। স্বাধীনতা লাভ করে যুক্তরাজ্য থেকে, ঘোষিত আগস্ট ৮, ১৯১৯, স্বীকৃত আগস্ট ১৯, ১৯১৯, আয়তন মোট ৬৪৭,৫০০ বর্গকিমি (৪১তম) ২৫১,৭৭২ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ২০০৯ সাল পর্যন্ত আনুমানিক ২৮,১৫০,০০০ (৩৭তম)। ১৯৭৯ আদমশুমারি ১৩,০৫১,৩৫৮। ঘনত্ব ৪৩.৫ /বর্গকিমি (১৫০তম) ১১১.৮ /বর্গমাইল। জিডিপি (পিপিপি) ২০০৮ আনুমানিক মোট $২১.৩৮৮ বিলিয়ন (৯৬তম) মাথাপিছু $৭৬০ (১৭২তম)। মুদ্রা আফগানি। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটি ইরান, পাকিস্তান, চীন, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, ও তুর্কমেনিস্তানের মধ্যস্থলে একটি ভূ-বেষ্টিত মালভূমির উপর অবস্থিত। আফগানিস্তানকে অনেক সময় দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অংশ হিসেবেও গণ্য করা হয়। আফগানিস্তানের পূর্বে ও দক্ষিণে পাকিস্তান, পশ্চিমে ইরান, উত্তরে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান এবং উত্তর-পূবের্ গণচীন। আফগানিস্তান শব্দটির অর্থ "আফগান (তথা পশতুন) জাতির দেশ"। আফগানিস্তান একটি রুক্ষ এলাকা - দেশটির অধিকাংশ এলাকা পর্বত ও মরুভূমি আবৃত। পর্বত উপত্যকাগুলি আর উত্তরের সমভূমিতেই কেবল গাছপালার দেখা মেলে। এখানকার গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া গরম ও শুষ্ক এবং শীতকালে এখানে প্রচণ্ড শীত পড়ে। কাবুল দেশটির বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। আফগানিস্তান প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়ার একটি গুরুতপূর্ণ সন্ধিস্থল হিসেবে পরিচিত। বহু প্রাচীন বাণিজ্য ও বহিরাক্রমণ এই দেশের মধ্য দিয়েই সংঘটিত হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু লোক আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে চলাচল করেছেন, এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ এখানে বসতি স্থাপন করেছেন। দেশটির বর্তমান জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র এই ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। আফগানিস্তানে বসবাসরত সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হল পশতু জাতি। এরা আগে আফগান নামেও পরিচিত ছিল। তবে বর্তমানে আফগান বলতে কেবল পশতু নয়, জাতি নির্বিশেষে রাষ্ট্রটির সব নাগরিককেই বোঝায়। আফগানিস্তানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : বিগত কয়েক দশক ধরে আফগানরা বহিশত্র“দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে। চলমান এ যুদ্ধাবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তেমন সুযোগ ঘটেনি তাদের। ১৭৪৭ সালে আহমদ শাহ দুররানি কান্দাহার শহরকে রাজধানী করে এখানে দুররানি সা¤্রাজ্যের পত্তন করেন। তখন থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান একটি রাজতন্ত্র ছিল। এরই মাঝে দেশের রাজধানী কান্দাহার থেকে কাবুলে স্থানান্তরিত করা হয় এবং দেশটি প্রতিবেশী রাষ্টগুলির কাছে অনেক অঞ্চল হারায়।
১৯ শতক - ১৯১৯ : ১৯শ শতকে দেশটি ব্রিটিশ ভারতীয় সা¤্রাজ্য ওরুশ সা¤্রাজ্যের মধ্যে এক বিরাট খেলার মধ্যবর্তী ক্রীড়ানক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৮৭৩ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে সামরিক অফিসারেরা রাজার পতন ঘটান এবং একটি প্রজাতন্ত্র গঠন করেন। ১৯১৯ সালে তৃতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধশেষে আফগানিস্তান দেশটি ব্রিটেন থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৭০-১৯৭৯ : ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপের অভিপ্রায়ে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ শুরু হয়।
১৯৭৯-১৯৮৯ : সোভিয়েতের দখল- ১৯৭৯ এর ডিসেম্বরে রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পার্বত্যদেশ আফগানিস্তান দখল করে। আফগানিস্তানের পশ্চিমাপন্থী মুজাহিদীন বাহিনীর এক দশকের সংগ্রামের পর ১৯৮৯ সালে রাশিয়া আফগান ছাড়ে।
১৯৯২-১৯৯৬ : গৃহযুদ্ধ - কমিউনিস্ট সরকারের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর পতনের পর ক্ষমতা দখল নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে এক লাখ মানুষ নিহত হন এবং কাবুলের অনেক অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৯৬-২০০১ : তালেবান শাসন- ইসলামপন্থী তালেবানরা কাবুলের ক্ষমতা দখল করে নেয়। উগ্র ইসলামী আইন প্রনয়ন করে। তালেবান প্রধান মোল্লা ওমর আল কায়দার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে এবং পরে আলকায়দা প্রধানকে আশ্রয় দেয়।
২০০১ : পশ্চিমা হস্তক্ষেপ- ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালায়। কিন্তু তারা আলকায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে ধরতে ব্যর্থ হয়। হামিদ কারজাইকে দেশ চালানোর জন্য নির্বাচিত করা হয় এবং পশ্চিমা দাতা সংস্থারা আফগানিস্তানের উন্নতির জন্য প্রচুর অর্থ দেন।
২০০৪ : প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন- সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে আফগানিস্তানে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়ে হামিদ কারজাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর এক বছর পর পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
২০০৯ : কারজাই পুনর্নিবাচিত- তালেবানদের সহিংসতা এবং মাত্র ৩০-৩৩ শতাংশ ভোট পড়ে। ভোটে প্রচুর কারচুপি হয়। হামিদ কারজাই প্রথম দফা নির্বাচনে ৪৯.৭ শতাংশ ভোট পান। পরে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ আবদুলল্লাহ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলে হামিদ কারজাই পুনরায় প্রেসিডেন্ট হন।
২০১৪ : কারজাই যুগের সমাপ্তি ও আশরাফ গনির যুগ - ২০১৪ সালের ৫ এপ্রিল তারিখে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ, আফগানিস্তানের সাবেক অর্থমন্ত্রী আশরাফ গনি আহমদজাই। তিনি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের উপদেষ্টা ছিলেন। নির্বাচনে তার বিপুল সমর্থন পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, আশরাফ গনি পেয়েছেন ৫৬ ভাগ ভোট। সাংবিধানিকভাবে হামিদ কারজাই আর নির্বাচন করতে না পারায় এবারের নির্বাচন হচ্ছে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পালা। ন্যাটো তার সব সৈন্য সরিয়ে নেয়া এবং তালেবানদের আক্রমণের মধ্যে এই নির্বাচনকে ঘিরেও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
আফগানিস্তানে সংকট সৃষ্টির কারণ : বর্তমানের আফগান সংকটের সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকায় ৯/১১-এর অবিশ্বাস্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিদ্ধ শহর নিউইর্য়কের ‘টুইন টাওয়ার’ সুরম্য ভবনসহ অনেক স্থানে সন্ত্রাসী ঘটনায় বিরাটসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয় এবং অসংখ্য আহত হয়। সেই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন ‘আল কায়েদাকে’ এবং এর শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনকে, যিনি তখন আফগানিস্তানে বসবাস করছিলেন। সেই সময় দেশটি একটি ইসলামি সরকার ‘তালেবানদের’ দ্বারা শাসিত ছিল এবং কাবুল সরকারের প্রধান ছিলেন মোল্লা ওমর। আমেরিকা এবং তার মিত্ররা লাদেন ও ‘তালেবানদের’ সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী করে আফগানিস্তানে সামরিক আক্রমণ করে ‘তালেবান’ সরকারকে উৎখাত করে। সেই সময় থেকে বলা যায় যে, দেশটি বিদেশি শক্তি এবং তাদেরই অনুগত সরকার কর্তৃক চালিত হচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরোধীরা বিদেশি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে এবং উভয়পক্ষেই প্রচুর হতাহত হচ্ছে। ন্যাটো বাহিনী দীর্ঘ চেষ্টার পর লাদেনকে পাকিস্তানে শনাক্ত করে হত্যা করে, যদিও মোল্লা ওমর এখনো ধরা পড়েনি কিংবা নিহত হয়নি। লাদেনের মৃত্যুর পর ‘তালেবানরা’ বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ন্যাটো বাহিনী মনে করে তাদের চূড়ান্ত বিজয় সন্নিকটে। কিন্তু সেটা এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি এবং যুদ্ধ চলছে অবিরাম। ন্যাটো বাহিনী মনে করে সামগ্রিক পরিস্থিতি এখন তাদের অনুকূলে এবং সে কারণে ২০১৪ অর্থাৎ বর্তমান বছরের মধ্যে সব বিদেশি সৈন্য আফগানিস্তান ত্যাগ করবে স্থানীয় সরকারের কাছে নিরাপত্তা দায়িত্বের ভার তুলে দিয়ে। অবশ্য ওয়াশিংটন বলছে যে, অন্তত ১০ হাজার মার্কিন সৈন্য এরপরও থেকে যাওয়া দরকার বিভিন্ন কারণে। এই বিষয়ে এবং ‘তালেবানদের’ সঙ্গে শান্তি আলাপের ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এই আফগান সংকট আমেরিকার জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে সমস্যাটির গুরুত্ব সীমাহীন রাজনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে।
তালেবান পরবর্তী আফগানিস্তানের অবস্থা : ২০০১ সালের ইঙ্গ মার্কিন বাহিনী কর্তৃক আফগানিস্তানে হামলার পর তাদের দাবী অনুযায় তালেবান মুক্ত না হলেও আপতত তারা তালেবানদের হাত থেকে আফগানিস্তানের শাসনভার চিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। তালেবানদের শাসন উত্তর আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থা নিন্মেব তুলে ধরা হলো:
যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকার : ২০০১ এ মার্কিন সামরিক শক্তির কাছে আফগানিস্তানের তালেবান গোষ্ঠির পরাজিত হওয়ার পর
হামিদ কারজাই রাষ্টপ্রতি হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। সে সময় তাকে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকার হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। পরপর দুইবার তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ৫৫% ও ৪৫% ভোট অর্জনের মাধ্যমে যদিও সে সকল নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতির হার ও সুষ্ঠতার বিষয় নিয়ে নানা মহলে কানাঘুষা রয়েছে।
আফগানিস্তানে নির্বাচন : সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে আফগানিস্তানে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে আফগানিস্তানের মতামত প্রকাশের সুযোগ লাভ করে। যদিও এই সুযোগ গ্রহণ করেছে আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ নাগরিক। পরবর্তী ২০০৯ সালে কারজাই পুননির্বাচিত হয়। তালেবানদের সহিংসতায় মাত্র ৩০-৩৩ শতাংশ ভোট পড়ে। প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট না পড়ায় এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে কোন প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদদ্ধিতায় আবারোও তিনি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ এপ্রিল তারিখে কারজাই যুগের সমাপ্তি ঘটিয়ে ৫৬ ভাগ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আশরাফ গনি আহমদজাই।
গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা : আফগানিস্তানের গণতন্ত্রের ইতিহাস পুরনো নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্ররা ‘তালেবান’ শাসনের অবসান ঘটিয়ে আফগানিস্তানের সার্বিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক পরিবর্তন আনার পরই সেখানে গণতন্ত্র প্রচলিত হয়েছে। তবে এই গণতন্ত্র এখনো স্থিতিশীল হয়নি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করছে। তাছাড়া শাসকদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, দুর্নীতি এবং অন্যান্য সমস্যার কারণে সেখানে গণতন্ত্রের ভিত শক্ত হতে পারছে না।
সংবিধান প্রনয়ন : ২০০৪ সালের জানুয়ারী মাসে, আফগানিস্তানের লোয়া জির্গা সম্মেলনে নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। নতুন সংবিধান অনুযায়ী, আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। ইসলাম ধর্ম আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম, সৈন্যবাহিবীর রাষ্ট্রায়ন, নারী-পুরুষ সমতা, বিভিন্ন জাতির সমতা, রাষ্ট্রীয় ঐক্য ইত্যাদি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের মৌলিক নীতি হিসেবে নতুন সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়।
আফগানিস্তানের জনসংখ্যা : বর্তমানে আফগানিস্তানের জনসংখ্যা ৩ কোটি ১৩ লাখ। এ হার দ্রুত বর্ধিঞ্চু। আফগান নারীদের খুবই কম বয়েসে বিয়ে করতে হয় এবং সিআইএ ফ্যাক্টবুকের নথি অনুসারে প্রত্যেক নারীর গর্ভে গড়ে ৫ শিশু জন্ম নেয়। এর ফলে দেশটিতে যে জন্মহার দাঁড়িয়েছে, তা সারাবিশ্বে ১০ম সর্বোচ্চ।আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল বিশাল শহর এবং শহরটি তার বিশালত্বের মধ্যে ৩০ লাখ মানুষকে ধারণ করে আছে। এই ৩০ লাখের অধিকাংশ মানুষ শহুরে সভ্যতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এর বাহিরে রয়ে গেছে পুরো জনসংখ্যার ৭৬ শতাংশ, যারা শহুরে বা সর্বশেষ সভ্যতাজ্ঞান ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। আফগানিস্তানের পশতু সম্প্রদায় মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্প্রদায়টি তাজিক, যারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭ ভাগ।
কর্মসংস্থান : সাড়ে দশ লাখ আফগান এখনও পশু চরানোর কাজ করেন, জাতিসত্তায় তারা কুচিস। সিআইএ ফ্যাক্টবুকঅনুসারে দেশটিতে ৭৮ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ‘‘৩০ বছর ধরে চলা যুদ্ধে আফগানিস্তানের জলসম্পদ চরম সঙ্কটের মুখে। সেচের পানি কমে যাওয়ায় চাষাবাদ তেমন হচ্ছেনা। ৩৫ শতাংশ মানুষ সম্পূর্ণ বেকার। ২০১০ সালে দেশটির গড় জাতীয় আয় ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।
শিক্ষা : তালেবানদের অপসারণের পর সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে যে খাতটিতে তার হলো শিক্ষা। ২০০১ সালে কোন বিদ্যালয়ে ১ জনও মেয়েশিশু ছিল না। গোটা দেশে বড়জোড় ১০ লাখ বালক বিদ্যালয়ে যেতো। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক একটি পরিসংখ্যান দাঁড় করায় যা বেশ আশাব্যঞ্জক। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১১ বছর পর বর্তমানে বিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েদের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ ৮০ হাজার। এবং উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, মেয়েদের প্রতি খড়গহস্থ স্থানীয় দৃষ্টিভঙ্গি উৎরে বিদ্যালয়ে যায় প্রায় ২০ লাখ ৯০ হাজার মেয়েশিশু। তবে স্থাপনাগত উন্নতি প্রায় হয়নি। খুব কম বিদ্যালয়েরেই কোন সুনির্দিষ্ট ভবন আছে। অনেক বিদ্যালয় আছে যেগুলো স্রেফ তাঁবু খাটিয়ে চলে। এবং ছায়ার জন্যে আফগানিস্তানের মতো উষর এলাকায় গাছের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হয় যেখানে শিশুদের পড়ানো যেতে পারে। ৭০ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষকসংখ্যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কম হলেও তুলনামূলক আশাব্যঞ্জক, প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার। মেয়েশিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করলেও তাদের ঝরে পড়ার হার কিন্তু এখনও উল্লেখ করার মতো রয়ে গেছে। দেখা গেছে প্রতি ১০০ জনে ৩৯জন শিশু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ওঠার সময় ঝরে পড়ে। শিশুদের প্রসঙ্গ কিছুটা আশা জাগালেও প্রাপ্তবয়স্কের পরিসংখ্যানে গেলে দেখা যাচ্ছে, তাদের একটি বৃহৎ অংশ এখনও শিক্ষার আলোবঞ্চিত। এখন পর্যন্ত ১৫ বছরের বেশি বয়েসী আফগানদের মাত্র ৩৯ শতাংশ লিখতে ও পড়তে পারে। আর এটা সারাবিশ্বের সর্বনিম্ন হারগুলোর একটি।
দারিদ্র্য : ২০১৪ সালে আফগান দরিদ্র জনগণের জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ৪০ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার সাহায্য দেয়া হয়েছে। এত বিপুল অংকের অর্থ প্রয়োজন হয়েছে এজন্যে যে, পৃথিবীর বিপুলতম শরণার্থীগোষ্ঠি ফিরে আসতে শুরু করেছে নিজ দেশে। উদ্বাস্তু এ আফগানেরা দেশের অস্থিতিশীলতার কারণে বিভিন্ন সময়ে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল এবং ফিরে আসার পর এদের জন্যে আশ্রয় বা কর্মসংস্থানের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। ফিরে আসা শরণার্থীদের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। এছাড়া আরও ৬ লাখ মানুষ দেশের অভ্যন্তরেই নিজেদের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাতকৃত। এদের বেশির ভাগই দেশটির দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশের মানুষ। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বর্তমান আফগানিস্তানে গড়ে ৩৬ শতাংশ মানুষ দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। এ হার স্থানভেদে কমবেশি আছে। যেমন শহুরে ও সাধারণ গ্রামীণ এলাকায় এ হার ২৯ শতাংশ থেকে ৩৬ শতাংশে ওঠানামা করে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে এ হার ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত েেপৗঁছে গেছে।
নারীর অগগ্রতি : আফগানিস্তানে নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের তুলনামূলক উন্নতি হয়েছে। তালেবানদের সময়ে নারীদের বিদ্যালয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ঘর থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে যার প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান।
১. স্কুলগামী নারী : এখন মোট নারীর ৩৬ শতাংশ বিদ্যালয়ে যেতে পারছে। যদিও মাধ্যমিকে যাওয়া নারীর সংখ্যা এখনও বেশ কম।
২. নারী শিক্ষার হার : প্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের ভেতর শিক্ষার হার এখনও হতাশাব্যঞ্জক। ২০১০-১১ সালে পরিচালিত সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকস অরগানাইজেশন এবং ইউনিসেফের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে শিক্ষিতের হার ২২ দশমিক ২ শতাংশ। সংখ্যায় স্বল্প হলেও নারীরা ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ করার দিকে মনোযোগী হচ্ছে। যার ফলাফল পাচ্ছে দেশটি। বর্তমানে পার্লামেন্ট এবং প্রশাসনের এক চর্তুাংশেরও বেশি পদে অধিষ্ঠিত আফগান নারীরা। পরিসংখ্যান - চ্যারিটি ইসলামিক রিলিফ।
৩. বিয়ের সময়সীমায় নারী : ২০০৭ সালে ২০ বছরের মেয়েদের বিয়ে বসার হার নির্ণয় করা হয়েছিল। সেখানে আশাব্যঞ্জক ফলাফল আসেনি। দেখা গেছে ৫২ শতাংশ নারীকে ২০ বছরের আগেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছে।
৪. নারীর ক্ষমতায়ন : সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকস অরগানাইজেশনের ২০০৯-এ কৃত ভিন্নতর এক পরিসংখ্যান থেকে উঠে এসেছে, বিগত কয়েক বছরে নারীর ক্ষমতায়নের দিকে বিশেষভাবে নজর রেখেছে এবং তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে পুরুষকর্মী অপেক্ষা দ্রুতগতিতে। নারীর ক্ষমতায়ন বর্তমান বেগে এগুলো ২০২০ সাল নাগাদ প্রশাসনিক কাজের প্রায় ৪০ শতাংশে অংশ নেবে নারী।
৫. আইন শৃঙ্খরা বিভাগে নারী : পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে নারীর নিয়োগপ্রাপ্তি ক্রমশ সহজতর হয়ে আসছে। এ বিষয়ে ব্রিটেনের সামরিক কর্মকর্তারা সাহায্য করেছেন। তারা প্রতি বছর কমপক্ষে ১০০ নারীকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে চলেছেন। তালেবান পরবর্তী সরকারগুলো নারীদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে থাকলে তালেবানী আগ্রাসন ও মনোভাব থেকে এখনো বের হতে পারছেনা সে দেশের নারীরা যদিও এর হার আগের চেয়ে কমে গেছে। এখনও নারীরা শারীরিকভাবে নির্যাতিতা হচ্ছেন এবং অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন এবং একটি বৃহৎ অংশকে এখনও জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হচ্ছে।২০১০ সালে সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকস অরগানাইজেশন পরিসংখ্যান চালিয়ে এ তিনটি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে বর্তমান সময়ে একটি নতুন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে নারীরা। প্রায় অভিযোগ আসছে, সমাজকল্যাণমূলক কাজে নারীকে অংশ নিতে দেয়া হচ্ছে না। বিবিসি
প্রযুক্তির ব্যবহার : আফগানিস্তানের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। কিন্তু মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা তারচেয়ে বহুগুণ বেশি। সিআইএ ফ্যাক্টবুকের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালে সারা দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ। ২০১৪ সাল নাগাদ তা আরও বেড়েছে।
ন্যাটো জোটের সাথে নতুন চুক্তিতে কারজাইর অনাস্থা : চলতি ২০১৪ সালের শেষেই আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনাদের চলে যাওয়ার কথা। তবে মেয়াদ শেষের আগেই কাবুলে সেনা রাখতে নতুন চুক্তি করতে সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে তোড়জোড় করছিল যক্তু রাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে বিদেশি সেনাদের অভিযানে আফগানিস্তানের বেসামরিক লোক মারা যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে নতুন চুক্তিতে যেতে রাজি হননি কারজাই। পাশাপাশি নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের জন্য যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পাশ্চিমা দেশগুলোকেই দায়ী করেন তিনি।
ন্যাটো জোটের সাথে নতুন চুক্তি : ক্ষমতা নেয়ার একদিনের মধ্যেই ‘প্রতিশ্র“তি’ অনুযায়ী আফগানিস্তানের মাটিতে বিদেশি সেনাদের অবস্থানের অনুমোদন দিয়ে ন্যাটোর সঙ্গে চুক্তি করছেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তি (বিএসএ) অনুযায়ী, নিরাপত্তার স্বার্থে ২০১৪ সালের পরেও ন্যাটো সেনারা আফগানিস্তানে থাকতে পারবে। আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হানিফ আতমার ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস ক্যানিংহাম কাবুলে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। নতুন চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৪ সালের পরও প্রায় ১২ হাজার ন্যাটো সেনা আফগানিস্তানে অবস্থান করবেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের থাকবে প্রায় ১০ হাজার সেনা। বাকিরা থাকবে অন্যান্য ন্যাটো সদস্য দেশের সেনা।
বর্তমানে আফগানিস্তানে ন্যাটো সৈন্য : তালেবান জঙ্গি মোকাবেলা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় তিন লাখ ৫০ হাজার যুক্তরাষ্ট্র প্রশিক্ষিত সেনা রয়েছে আফগানিস্তানের। এক বছর আগে ন্যাটোর হয়ে ৪৯টি দেশের প্রায় ৫০ হাজার সেনা আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালন করছিল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেরই ছিল ৩৪ হাজার সেনা। তালেবান হামলায় এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে প্রায় ৫০০ জন ব্রিটিশ সেনা নিহত হয়েছে যা ইরাকে এখন পর্যন্ত নিহত ব্রিটিশ সেনার চেয়ে বেশি। আর ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য নিহত হয়েছে ২০০০ মার্কিন সেনা যার অধিকাংশ নিহত হয়েছে আফগানিস্তানে নিয়োজিত তাদের সহকর্মীদের হাতে।
(সুত্র : বিবিসি বাংলা যঃঃঢ়://িি.িননপ.পড়.ঁশ/নবহমধষর/হবংি/২০১২/০৯/১২০৯৩০থঢ়ভথধভমযধহথরংধভ )
আফগানিস্তানে গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল : তালেবান পরবর্তী আফগানিস্তানের সামগ্রিক অবস্থার পুরোপুরি উন্নতি না হলেও এখানে গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয়েছে। বর্তমানে আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল হলো : আফগানিস্তান ন্যাশনাল ফ্রন্ট, দলের প্রধান আহমদ জিয়া মাসুদ। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তানের হেজবে ইসলামী দল।
আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা : আফগানিস্তানের পুনর্গঠন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভারত কারজাই যুগ পর্যন্ত ২০০ কোটি মার্কিন ডলার সাহায্য দিয়েছে। যখন আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নিয়ে সবাই চিন্তিত তখন চীনের প্রথম আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষ দূত সুন ইউ সি আফগানিস্তান সফর করেন, আফগান সমস্যায় চীনের অবস্থান প্রকাশ করার পাশাপাশি আফগানিস্তান পুনর্গঠন ও শান্তি প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার ক্ষেত্র ও সম্ভাবনা পর্যালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের সহায়তার আগ্রহ রয়েছে। এই সময় তিনি কয়েকটি বিষয়ে সুস্পষ্ট পরামর্শ প্রদান করেন।
আফগানিস্তানের পানীয় জল : আফগান জলসম্পদ ও এনার্জিমন্ত্রী আলহাজ ইসমাইল বলেন, ‘‘৩০ বছর ধরে চলা যুদ্ধে আফগানিস্তানের জলসম্পদ চরম সঙ্কটের মুখে। সেচের জল কমে যাওয়ায় চাষাবাদ তেমন হচ্ছেনা। দেখা দিচ্ছে খাদ্য সঙ্কট দেশের তিন কোটি লোকের মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানীয় জল পায়।
বর্তমানে তালেবান : নিজেদের কট্টর অবস্থান থেকে সরে আসছে আফগান-তালেবান। এর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে সংগঠনটির মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদের কথায়। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান ও আল-কায়েদার সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক নেই। বার্তা সংস্থা 'ইসনা'কে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আবারো আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো ও আমেরিকান সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহারের আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিদেশি সেনারা চলে যাওয়ার পরই কেবল আফগানিস্তানে সরকার গঠন, যুদ্ধের অবসান ও নিরাপত্তার বিষয়ে তালেবানের অবস্থান স্পষ্ট করা হবে। তথ্যসূত্র : আইআরআইবি, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন।
ক্রিয়াঙ্গন :
১. ফুটবল : তালেবানী আগ্রাসনে আফগানিস্তানের ক্রিয়াঙ্গনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ১৯২২ সালে তৈরি হওয়া আফগান ফুটবল সমিতি ১৯৪৮ সালে ফিফাতে যোগ দিলেও যুদ্ধ বিগ্রহ ও সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার আফগানিস্তান দীর্ঘ ৩০ বছর পর ফুটবলে ফিরেছে। ২০১১ সালে আফগানিস্তান দক্ষিণ এশীয় ফুটবল ফেডারেশন কাপ টুর্নামেন্টে রানার-আপ হয় এবং ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন! দক্ষিন এশিয়ায় ফিফার সদস্য দেশগুলোর আফগানিস্তান বর্তমানে রেংকিং সবচেয়ে এগিয়ে। তাদের অবস্থান ১২০ তম। বিভিন্ন প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব আফগানিস্তানের কোচ ও প্লেয়ারদের প্রশিক্ষণের জন্য দুবাইতে কোচিং কোর্সের ব্যবস্থা করেছে। আজ আফগানিস্তান ফিফা তথা এশীয় ফুটবল বিকাশ নিধির অর্থানুকুল্য পাচ্ছে বটে কিন্তু কাবুলের গাজি স্টেডিয়ামে তালেবানের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরি করার বিভীষিকা পুরোপুরি মিলিয়ে যেতে আরো কিছুটা সময় লাগবে।
২. ক্রিকেট : যুদ্ধ বিগ্রহ পরবর্তী আফগানিস্তানের ক্রিয়াঙ্গনে ফিরেছে খুবই দারুণভাবে বিশেষ করে ক্রিকেটে।১৯৯৫ সালে আফগান ক্রিকেট ফেডারেশন গঠিত হয়। ২০০১ সালে আফগানিস্তান আইসিসির অন্তর্ভুক্ত সহযোগী সদস্য নির্বাচিত হয় এবং ২০০৩ সালে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল এর সদস্য পদ লাভ করে। ২০০১ সালে প্রথম জাতীয় দল গঠিত হয়। ২০০৯ সালে তারা বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। ২০১০ সালে আফগানিস্তান ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা অর্জন করে। তারা ২০১০ সালে টি-২০ বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। সি-গ্র“ফে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে খেলে। ২০১১ সালে আফগানিস্তান টি-২০ র্যাঙ্কিংয়ে নবম হয়। আফগানিস্তান ২০১১ সালের বিশ্বকাপ খেলতে না পারলেও ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪ বছরের জন্য আর্ন্তজাতিক একদিনের ম্যাচ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ২০০৯ সালে আফগানিস্তান এসিসি টি-২০ কাপে খুবই ভাল খেলে, তারা গ্র“পের ৫ টি ম্যাচই জিতে যায় এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ফাইনালে ৮৪ রানে পরাজিত করে শিরোপা জিতে নেয়। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়া কাপে খেলার মধ্য দিয়ে কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অভিষেক হলো আফগানিস্তানের।
আফগানিস্তানের সংকট উত্তরণে ভবিষ্যত করণীয় : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ (শেষআলো ডটকম): যুক্তরাষ্ট্র তার বাহিনী সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর, অনেক মানুষ আফগানিস্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের কল্পনা শুরু করে। দীর্ঘকাল ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষণা করা মারিয়া সুলতান হচ্ছেন পাকিস্তানের সাউথ এশিয়ান স্ট্র্যাটেজিক স্ট্যাবিলিটি ইন্সটিটিউটের পরিচালক। আফগানিস্তানের উন্নয়নের তিনি দীর্ঘ গবেষণা করেছেন। তাঁর উত্থাপিত কিছু করণীয় নিন্মে তুলে ধরা হলো। :
১. যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তানের নিরাপত্তা রক্ষায় মনোযোগ দেয়। দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আইনগত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ পরিকল্পনা সেখানে ছিলো না।
২. পাশাপাশি আফগানিস্তান পপি’র চাষ ও গাঁজা উৎপাদনে বিশ্বের বৃহত্তম দেশ। কোন সতর্কতা না থাকলে, আফগানিস্তান মাদকদ্রব্য সন্ত্রাসী লালনের বৃহত্তম দেশে পরিণত হবে।
৩. অর্থনৈতিক উন্নয়নের অস্পষ্ট ভবিষ্যৎ ছাড়াও, আফগান সমাজে বিচার ব্যবস্থায় শূন্যতা রয়েছে। আফগান নারী পার্লামেন্ট সদস্য মালালাই জয়া মনে করেন, আফগানিস্তানে বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরী। বর্তমানে আফগানিস্তানে ফৌজদারি অপরাধের ন্যায়সঙ্গত বিচারের অভাব রয়েছে।
৪. তালেবানকে অস্ত্র ছেড়ে রাজনীতি আসতে হবে।এতে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়বে এবং একে অপরের শত্র“ হিসেবে আর লড়াই হবে না। এক সঙ্গে দেশ গঠনের কাজে এগিয়ে আসবে সবাই।
৫. গনতান্ত্রিক মনোভাব সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তথ্যসূত্র : //িি.িংযবংযধষড়.পড়স/?ঢ়=১৪৪৮#ংঃযধংয.ঢঊধছণঋএ০.ফঢ়ঁভ
৬. সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বাদ দিয়ে সেখানে জাতিসংঘের শান্তিবাহিনী নিযুক্ত করা দরকার।
৭. নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত।
৮. ধর্মীয় গোড়ামী দূর করে সঠিক ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা।
৯. তালেবানদের সাথে অতিদ্রুত ফলপ্রসু শান্তি আলোচনা করা।
১০. আফগান সামরিক বাহিনী আধুনিকায়ন করা।
১১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা।
১২. পরমত সহিঞ্চু, মানবাধিকার, সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
উপসংহার: আফগানিস্তানের গণতন্ত্রের ইতিহাস পুরনো নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্ররা ‘তালেবান’ শাসনের অবসান ঘটিয়ে আফগানিস্তানের সার্বিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক পরিবর্তন আনার পরই সেখানে গণতন্ত্র প্রচলিত হয়েছে। তবে এই গণতন্ত্র এখনো স্থিতিশীল হয়নি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করছে। তাছাড়া শাসকদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, দুর্নীতি এবং অন্যান্য সমস্যার কারণে সেখানে গণতন্ত্রের ভিত শক্ত হতে পারছে না। তবে ‘তালেবান’ শাসন অবসানের পর পশ্চিমা বিশ্বের প্রাধান্যে বিশাল পরিবর্তনের পর অন্তত শিক্ষা, নারী অগগ্রতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও দেশটির সমস্যা যেন অন্তহীন। দেশটিতে বারবার নানা কারণে রক্ত ঝরছে। বিদেশি
সৈন্য সেখানে অবস্থান করছে। আফগানিস্তানের সামাজিক, ধার্মিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত হয়েছি সুসাহিত্যিক ড. মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশে’ কিংবা ‘শবনম’-এর মতো উপন্যাস থেকে এছাড়া আরো লেখকের বই পড়ে। তাই সত্যিই কষ্ট হয় যে, এমনি একটি দেশ যার মানুষ অত্যন্ত সহজ-সরল ও উদার বিভিন্ন পর্যায়ে বিদেশি শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলীওয়ালার’ সেই অনবদ্য ‘রহমত’ চরিত্রের অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আফগানিস্তান বারবার শুধু ক্ষত-বিক্ষতই হয়েছে এবং এখনো সেখানে রক্ত ঝরছে। ফিরে আস আফগানিস্তান স্বগৈরবে বিশ্ববাসীর এই কামনা।