ব্রাজিলে চলমান বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ২টি ম্যাচ ছাড়া বাকিগুলো ঢাকাতে বসে উপভোগ করেছি । বিশ্বকাপ শুরুর কয়েকদিন আগ থেকে গনমাধ্যমসহ সাধারণ মানুষের মুখে শুনা যাচ্চে বিশ্বকাপ নিয়ে নানা উক্তি আর মন্তব্য। কেউ আবার বিশ্বকাপ শুরুর পূর্বেেই কিনে নিয়েছেন তার পছন্দের দলের পতাকা বা জার্সি। ঢাকা শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি তে বসে বিশ্বকাপ দেখা এবার প্রথম নয় এর আগে ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল খেলাও আমি ঢাকা শহরের আমার এক আত্মীয়ের বাসা টেলিভিশনে উপভোগ করেছি।
তবে একটি বিষয় আমি খুব আশ্র্চায্য হয়েই লক্ষ করলাম, ঠিক যে বয়সে আমার ছোট ভাই (৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র) তার প্রিয় দলের পতাকা হাতে নিয়ে দৌড়াদোড়ি আর খেলা দেখার জন্য রাতজাগা পাখির মতে চোখ দুটো লাল করে টিভি সেটের সামনে বসে থাকে ঠিক ঐই বয়সে আমার ফুটবল বিশ্বকাপ তো দূরে থাক নিজেদের বাড়ির পিছনে ফসলের জমিনে বর্ষার সময় খেলা ফুটবল ছাড়া ফুটবল সম্র্পকে তেমন কোনো ধারণাই ছিলনা।
২০০৬ সাল তখন আমি নবম শ্রেণীতে পড়ি। একদিন মাদরাসা থেকে বাড়ি ফেরার পথে দেখি রাস্তা দিয়ে একটি রিক্সাতে বসে দুইজন মাকিং করছে। তাদের কথা গুলো ছিলো এইরকম । আসন্ন বিশ্বকাপকে সামনে রেখে এবং ফুটবল বিশ্বকাপকে উপভোগ করতে বাঙ্গাখাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে অংশ নিবে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার সমর্থকগন। আপনারা সবাই খেলাটি উপভোগ করার জন্য বাঙ্গাখাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে আমন্ত্রিত।
তখন আমার সাথে আমার বন্ধু রকি ছিল। রকি আমাদের এলাকায় খুবই ভালো ফুটবল খেলত। পরদিন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কিরে বাঙ্গাখাঁ স্কুল মাঠে যে, খেলা অনুষ্ঠিত হবে সেখানে তুই খেলবি কিনা? সে বলল, হ্যাঁ খেলব। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেসা করলাম তুই কোন দলের হয়ে খেলবি? সে আমাকে জানালো সে ব্রাজিল কে সার্পোট করে তাই ব্রাজিলের হয়ে খেলবে। আমি তাকে বললাম দেখ আমি ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা এদের কোন দলকেই চিনি না তুই খেলবি তাই খেলা দেখতে যাবে।
যথারীতি বিকালে স্কুলের মাঠে খেলা অনুষ্ঠিত হবে। প্রায় কয়েকশত মানুষ মাঠের চার পাশে ভিড় করে আশেপাশের রাস্তা, গাছের ডালপালা এমনকি স্কুলের ছাদটা পর্যন্ত দখল করে খেলা দেখার জন্য বসে আছে। আমি তখন রকি সাথে খেলা দেখতে মাঠে গেলাম। কিন্তু কোথায়ও দাড়িয়ে যে খেলাটা দেখব সে জায়টাও পেলাম না। রকি যেহেতু খেলবে তাই তার সাথে খেলওয়ারা যেখানে বিশ্রাম নিচ্চে (স্কুলের বারান্দা) সে জায়গা চলে গেলাম এবং তাকে বললাম মাঠে কোথায়ও খেলা দেখার মতো খালি জায়গা নাই তাহলে আমি কি করব। সে আমাকে বলল, তুই এখানে থাক এখান থেকে খেলাটা ভাল দেখা যাবে। আমি সেখানে বসলাম, বিকাল চারটায় খেলা শুরু হলো প্রথম আর্ধে উভয় দল গোল শূর্ণ ড্র নিয়ে খেলা শেষ করে, যদিও গোল শূর্ণ ড্র করে, উভয়ে খেলেছে দারুণ।
দ্বিতীয় আর্ধে খেলা শুরু প্রায় মিনিট পনেরে পরেই ব্রাজিল একটা গোল করে। তখন মাঠে উপস্থিত লোকজনের ব্রাজিল ব্রাজিল বলে গগন পাটানো চিৎকার শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি মনের অজান্তেই ব্রাজিল ব্রাজিল বলে চিৎকার করা শুরু করলাম। অবশ্যই এর পিছনে আরেকটি আবেগ জড়িত ছিল সেটা হলো আমার বন্ধু রকির ব্রাজিল দলের হয়ে খেলা।
এর কয়েকদিন পরে শুরু হলো বিশ্বকাপ খেলা, রকি আমাকে বলল, আজ রাত ৩ টায় ব্রাজিলের খেলা আছে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে খেলা আছে আমরা বাজারে খেলা দেখতে যাবো তুই যাবি? আমার ভিতরে কেমন জানি একটা অনুভূতি কাজ করলো এবং তাকে বলে দিলাম যাবে।
ঐ সময় আমাদের বাসায়, আমার বাবা ( যিনি একজন সরকারী কলেজ শিক্ষক), এবং একজন গৃহ শিক্ষক ছিলেন, যিনি আবার আমাদের মাদরাসা বিএসসি (গণিত) শিক্ষক। রাত যখন ১০ টা স্যার বলল ঠিক আছে তোমরা যাও খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমায়। আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমানোর জন্য বিছানা উঠে শুয়ে পড়লাম। আমার সাথে ঘুমাতো আমারে ইমিডিয়েট ছোট ভাই সাইফুদ্দিন, আমি তাকে খেলার দেখার বিষয়টা জানালাম এবং কিভাবে রাতে খেলা দেখার জন্য বাজারে যাব তা চিন্তা করতে লাগলাম। একটু পরেই সে আমাকে জানালো সে একটা উপায় পেল, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি? সে বলল, আমাদের চালের ড্রামে যে তালাটা লাগানো আছে তার একটা চাবি আমার কাছে আছে, সবাই যখন ঘুমিয়ে যাবে আমরা তালাটা দরজায় লাগিয়ে খেলা দেখতে চলে যাবে? যথারীতি তাই ঘটল, আমরা বাজারে গেলাম, খেলা দেখলাম সে ম্যাচে ব্রাজিলের কাকা একমাত্র গোলটি করে এবং ব্রাজিল জয় লাভ করে। খেলা যখন শেষ হয় তখন প্রায় ভোর রাত হয়ে আসছিল আমরা তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘটনাটি এখানে শেষ হতে পারতো কিন্তু তা হয়ে ঘটল একটা বিপত্তি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা যখন কোরআন শরীফ পড়ে নাস্তা করতে বসলাম। তখন আম্মু জিজ্ঞেস করল, রাতে তোমরা ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে কোথায় গিয়েছ? আমরা পুরো অবাক আমরা বাহিরে গেলাম এটা তিনি কিভাবে জানলেন? আমরা তাকে বললাম- আমরাতো খেলা দেখতে গেলাম। আমরা যে, ঘরের বাহিরে গেলাম এটা আপনি জানলেন কিভাবে?
তখন আম্মু যেটা শুনালেন, তা আমরা কখনো শুনার জন্য প্রস্তুত ছিললাম না। আমাদের ঘরের সামনের রুমে ঘুমাতেন আমাদের স্যার। আর আমরা ঠিক স্যারের রূমের দরজায় তালাটা লাগিয়েছিলাম। আমার আম্মু আমাদের স্যারের সামনে কখনোই আসতেন না স্যারও কখনো যেতেন না। তাই রাতে এবং দিনে স্যারকে তার জরুরি প্রয়োজনে আমাদের ঘরের বাহিরে অবিস্থিত টয়লেটটি ব্যবহার করেতে হতো। ঐ রাতে স্যারের জরুরী প্রয়োজন দেখা দিলে স্যার দরজা নিয়ে যতই টানাটানি করে দরজাতো খুলছে না। পরে বাধ্য হয়ে আমাদের ডাকাডাকি করে, কিন্তু কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আব্বুকে ডাক দেন, তখন আব্বু উঠে দেখে আমরা আমাদের বিছানায় নেই। আর দরজার বাহিরে দিয়ে তালা দেওয়া। তখন স্যার বাধ্য হয়ে আমাদের ঘরের অপর পাশের দরজা দিয়ে বের হলেন।
আম্মুর কাছ থেকে এই কথা শুনার পর,আমদের হাত পা জমে গেছে, ভয়ে সেদিন সকালে আর স্যারের কাছে পড়তে যাইনি, আর মাদরাসায় ও যেতে চাইনি কারণ স্যারের গণিত ক্লাশ আছে। কিন্তু আব্বু ধরে নিয়ে গেলেন, মাদরাসায় বাধ্য হয়ে যেতে হলো। স্যারের ক্লাশটা ছিলো দ্বিতীয় ঘন্টায়। প্রথম ক্লাশটা কুরআন ক্লাশ ছিলো, হুজুর হাজিরাটা নিয়ে পড়া শেষ না করতেই দরজার সামনে এসে হাজির হলেন স্যার, হাতে দুইটা তরতাজা বেত। আমার ভেতরে ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেল এক রকম দুঃচিন্তা। হুজুর ক্লাশ শেষ করে বের না হতেন স্যার ঢুকে পড়লেন। তার চোখে মুখে কে যেন মরিচের গুড়ো ছিটিয়ে দিয়েছেন ঠিক এমন লাল হয়ে আছেন।
তিনি ক্লাশে ঢুকেই প্রথমে বাড়ির কাজ দেখলেন, তারপর বললেন, আজ তোমাদেরকে এক নতুন বিষয়ে জানাবো, আমি ভাবলাম, হয়তো নতুন কোন অধ্যায়ের নতুন কোন অংক স্যার আজ করাবেন। কিন্তু না স্যার দেখি গতরাতের ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনাই বলা শুরু করল। তারপর শুরু হলো স্যারের সাথে ক্লাশে আসা বেতের ব্যবহার।
আর সেদিন থেকে আমার ভেতরে এক ধরনের ক্ষোভ কাজ করলো, ব্রাজিলের খেলা দেখতে গিয়ে আজ এই ধরনের অপমান আর মার খেতে হলো এখন থেকে ব্রাজিলের সব খেলা দেখব। এরপর থেকে আমি গ্রুপ পর্বের সব খেলা দেখলাম। যে দিন ব্রাজিল ফ্রান্সের সাথে হেরে যাচ্ছে ঐ দিন আমি বাজারে খেলা দেখছি একটা দোকানের বাহিরে দাড়িয়ে আমার সাথে রকি ও আরো অনেক বন্ধুরা ছিলো। হটাৎ রকি আমাকে বলল নিজাম দেখ ঐ পাশে কে দাাঁড়িয়ে আছে? আমি তাকিয়ে দেখি আমাদের সেই চিরচেনা আমার গৃহ শিক্ষক সামছুল হক স্যার। স্যার আমাদের দেখননি, দেখল হয়তো তিনি এখানে দাঁড়াতেন না। খেলার বিরতির সময় আমরা বন্ধুরা সবাই চা খাচ্ছিলাম আর দোকান লোকটাকে বললাম স্যারকে এক কাপ চা দিয়ে আসতে। স্যার চায়ের কাপ পেয়ে বলল আমিতো চায়ের কথা বলিনি। দোকানি বলল, ভেতর থেকে একজন পাঠাতে বলল, স্যার ভেতরে এসে আমাকে দেখে অবাক। আমি এবং আমার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে স্যারকে বসতে দিলাম।
পরেপুরো খেলাটাই আমরা এক সাথে দেখলাম ব্রাজিল সেদিন হেরে গেল। সবার মন খারাপ, আমার মনটা আরো বেশি খারাপ, সবাই নিশ্চুপ হয়ে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ স্যার আমাকে আর রকি কে ডেকে বলল, নিজাম আসলে ঐ দিন তোমাকে ক্লাশে যে জন্য শাস্তি দিয়েছি তা যতটুকু না আমার জরুরী প্রয়োজন সারার জন্য বের হওয়াকে কেন্দ্র করে তার চেয়ে আরো বেশি বাস্তবতা হচ্চে আমি চেয়েছিলাম ব্রাজিলের ঐ দিনের খেলাটা দেখবো। কিন্তু যখন উঠে দেখলাম দরজা বাহিরের থেকে লাগানো তখন আমারা মাথায় আসলে রক্ত উঠে যায়। কারণ আমি ব্রাজিলের একজন সমর্থক এবং ছাত্র জীবন থেকেই ব্রাজিলের খেলা দেখে আসছি।
স্যারে এই কথা শুনে ব্রাজিলের হারের দুঃখটা নিমিষে দুর হয়ে গেল। আর আনন্দে মন নেচে উঠল এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত স্যারও ব্রাজিলের সার্পোটার।
অবশ্যই পরে স্যারের কাছ থেকেেই জানলাম ব্রাজিলের সেরা খেলওয়ার দের কর্তৃত্ব আর তাদের ফুটবল নৈপন্যের কথা।
সেদিন থেকেই ফুটবলের কথা শুনলেন মনের ভিতর ব্রাজিল ব্রাজিল বলে কেমন জানি এক আচমকা নিরব ধ্বনি উচ্চারিত হয়।
তাই এবারে বিশ্বকাপে শুভকামনা ব্রাজিল ফুটবল দলের জন্য। শিরোপা টা যেন তাদেরই হয়।