বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে খাবার পানিতে আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্ত হার, যা স্বাস্থ্যের জন্য অতন্ত ক্ষতিকারক।আর্সেনিক মূলত একপ্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই থাকে। কিন্ত যখনই এই মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি হয়ে যায় তখনই তা পানকারীর শরীরের নানা রকম রোগের উপসর্গ তৈরি করে এবং পরবর্তিতে সেই সকল রোগব্যাধিকে মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়।পুরো বিশ্ব থেকে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের মোটামুটি ২০টি ঘটনা জানা যায়।তার মধ্যে, চারটি গুরুতর ঘটনাই পাওয়া গেছে এশিয়াতে। তার মধ্যে থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানের কিছু এলাকা এবং চীনের মূল ভূখন্ড রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা এবং চিলিতেও আর্সেনিক দূষণ চিহ্নিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে, ২০০১সালের হিসাবানুসারে ইউনাইটেড স্টেটস এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রার আর্সেনিক পাওয়া গেছে।ইউএস সুপারফান্ড-এর অর্থায়নে নির্মিত সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র In Some Doses থেকে জানা যায়,১০ লক্ষের মতো ব্যক্তিগত কূপের আর্সেনিকের মাত্রা অজানা রয়ে গেছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু এলাকায় ২০%-এরও বেশি কূপে নিরাপদ মাত্রার বেশি আর্সেনিক থাকতে পারে। ২০০৭ সালের একটি গবেষণায় ধারণা করা হয়, ৭০টিরও বেশি দেশে, ১৩৭ মিলিয়ন-এরও বেশি মানুষ, খাবার পানিতে আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত। কিন্তু এই বৈশ্বিক বিপর্যয়কে ছাড়িয়ে গেছে গাঙ্গেয় উপত্যকার আর্সেনিক দূষণ। সম্প্রতি ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন বেড়ে যাওয়ায় এই দূষণ আরো বেড়ে গেছে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী ১ লিটার পানিতে ১০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকলে সেই পানি দূষিত। বাংলাদেশের মান অনুযায়ী ১ লিটার পানিতে ৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকলে সেই পানিকে নিরাপদ পানি বলা হয় না।
পশ্চিম বাংলার ভারত দিপঙ্কর চক্রবর্তী সর্বপ্রথম, ১৯৯৫ সালে, এই দুর্যোগের ব্যাপারটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরেন।তিনি ১৯৮৮ সালে পশ্চিম বাংলায় তার গবেষণা শুরু করেন, এবং পরবর্তিতে সেগুলো প্রকাশ করেন। ২০০০ সালে তিনি বাংলাদেশে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন, যেখানে তিনি পানি আক্রান্ত মানুষের নোখ, চুল এবং প্রস্রাবের হাজারেরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করেন। সেই গবেষণায় বেরিয়ে আসে, ৯০০ গ্রামবাসীর শরীরে সরকারি মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রার আর্সেনিক রয়েছে।
সমস্যার বিস্তারিত বিবরণ
বাংলাদেশে, সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সালে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বড়ঘরিয়া ইউনিয়নের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি আবিষ্কৃত হয়। এরপর ২০০১ সালে ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে বাংলাদেশের ৬১টি জেলার নলকূপের পানি পরীক্ষা করে জানায়: ৪২% নলকূপের পানিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানের চেয়ে বেশি ২৫% নলকূপের পানিতে বাংলাদেশের মানের চেয়ে বেশি মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে।দিনে দিনে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে চলেছে।২০১০ সালে ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। পানিতে কী পরিমাণ আর্সেনিক আছে এবং একজন ব্যক্তি কতদিন যাবৎ এই পানি পান করছেন, তার উপর মৃত্যুঝুঁকি নির্ভর করে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়া মৃত্যুর প্রধান কারণ না হলেও তা মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। প্রতিদিনের মোট আর্সেনিক গ্রহণ ও প্রস্রাবে আর্সেনিকের পরিমাণের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। পানিতে আর্সেনিক বেশি থাকলে মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। আড়াইহাজারে করা এ গবেষণায় দেখা গেছে, আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের কারণে সাধারণ রোগে গড়ে মৃত্যুঝুঁকি ২১%, এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে মৃত্যুঝুঁকি ২৪% বেড়েছে। দীর্ঘস্থায়ী রোগে মৃত্যুহার বৃদ্ধিতে আর্সেনিকের সম্পৃক্ততার ব্যাপারটি আগেও, যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, আর্জেন্টিনা, তাইওয়ান এবং বাংলাদেশের মতলবে করা বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া গিয়েছিলো। প্রতি লিটার পানিতে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক পান করার ফলে ক্রনিক ডিজিজ, য়থা ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়বেটিসের মতো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুঝুঁকি ৬৪% বেড়েছে। সাধারণ রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ে প্রায় সমপরিমাণে। গবেষকদের মত, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান না করলে এই মৃত্যু কম হতো গবেষকদের অভিমত, আর্সেনিক পানরত ব্যক্তির, আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় যকৃৎ ও ত্বক এবং কিডনি, ফুসফুস ও হৃদপিন্ডের ক্যান্সার হতে পারে।আর্সেনিকের কারণে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জনের হাত-পা ইত্যাদি অংশে বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এমনকি রোগের প্রকোপ ঠেকাতে অনেকের হাত-পায়ের আঙ্গুলও কেটে ফেলতে হচ্ছে।
আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকা
২০১০ সালের ২২ মার্চে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ৫৪টি জেলার নলকূপের পানি-পরীক্ষার তথ্য পরিবেশিত হয়। এ থেকে জানা যায়, ৪৭টি জেলার ২৩৩টি উপজেলার ২,০০০ ইউনিয়নের ৩১,৪৯৭টি গ্রাম আর্সেনিক দূষণের শিকার। বাংলাদেশের মান অনুযায়ী যেসব এলাকায় ৫% নলকূপের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া যায়, সেসব এলাকাকে আর্সেনিক দূষণের শিকার এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়। এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক, যশোরের দেয় তথ্যমতে, যশোর জেলায় আর্সেনিকে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩,০০০ জন। জেলার শার্শা৫৫০ জন, চৌগাছা ৯৫০ জন ও ঝিকরগাছায় এই প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এমনকি উপজেলাগুলোর কয়েকটি গ্রামে প্রায় ৬০% মানুষই আক্রান্ত। বাংলাদেশে আর্সেনিক প্রকোপ যখন প্রথম ১৯৯৩ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিলো, তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যবহার, কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের খুঁটি ইত্যাদিই এই সমস্যার মূল কারণ। এরপর গবেষকগণ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণাকার্য পরিচালনা করেন। সেসব সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এতো বিস্তৃত এলাকার দূষণ এসমস্ত উৎস থেকে হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। ১৯৯৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত 'ঢাকা ঘোষণা'য় জানানো হয় যে, আর্সেনিক দূষণের কারণটি ভূতাত্ত্বিক। ভূতাত্ত্বিকভাবে সৃষ্ট দূষণ সম্পর্কে প্রথম তত্ত্বটি প্রস্তাব করে ভারতের পশ্চিম বাংলার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা দল। এই তত্ত্বানুযায়ী অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে ভূ-অভ্যন্তরে অক্সিজেন প্রবেশের ফলে পানিবাহী শিলাস্তরের আর্সেনিক পাইরাইট জারিত হয়ে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক তরল অবস্থায় যুক্ত হচ্ছে। পরে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় এ তত্ত্বটির সমর্থনে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরবর্তিতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের একটি যৌথ গবেষক দল একটি বিকল্প তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তাঁদের মতে, প্রক্রিয়াটি বদ্বীপ পলল ও নদীবাহিত পলল সমভূমির পলি সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত। বিভিন্ন উৎস থেকে আর্সেনিকযুক্ত পলি বদ্বীপ ও পলল সমভূমি অঞ্চলে জমা হয়, যেখানে আর্সেনিকের বাহক হলো প্রধানত আয়রন অক্সিহাইড্রোক্সাইড নামের মনিক মিনারেল। পরবর্তিতে পলির সঙ্গে সঞ্চিত জৈব পদার্থ কর্তৃক অক্সিজেন আহরণের ফলে পানিবাহী শিলাস্তরে বিজারিত অবস্থার সৃষ্টি হয়। এসময় বিজারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আয়রন অক্সিহাইড্রোক্সাইডের মধ্যে সংযোজিত আর্সেনিক ও আয়রন, ভূগর্ভস্থ পানিতে তরল অবস্থায় মুক্ত হয়। অধিকতর বৈজ্ঞানিক ভিত্তির কারণে বর্তমানে এই তত্ত্বটি বেশি গ্রহণযোগ্য।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক হ্যাভার্ড এ্যাকশন প্লান-১৯৬৬
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক হ্যাভার্ড এ্যাকশন প্লান১৯৬৬ অনুসারে, ভারতের নদীগুলোতে হিন্দুশাস্ত্র অনুসরণে মানুষসহ সকল প্রাণীর শবদেহ বা ভস্ম ফেলা হয়, এতে, পানিতে যে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তা ফারাক্কা ব্যারেজের ফলে নিম্নাঞ্চলের অর্থাৎ বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ সর্বনিম্ন স্তরে আটকা পড়বে। কারণ নদীগুলোর যে বিপুল জলপ্রবাহ বাংলাদেশের উপর দিয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে, ফারাক্কা বাঁধের কারণে সেই প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হওয়ায় আর্সেনিক বিষ বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত যেতে পারবে না। ফলে ২০০২ সাল নাগাদ নিম্নাঞ্চলের প্রতিটি নলকূপেই আর্সেনিক বিষ নির্গত হতে বাধ্য।
আর্সেনিক উদ্বাস্তু
আর্সেনিকের প্রকোপ বাড়ায় যশোর জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে বহু লোক বাঁচার তাগিদে গ্রামছাড়া হয়েছেন। যশোরের কয়ারপাড়া ও চৌগাছার অন্তত ৫০ জন মানুষ আর্সেনিকে মারা গেছেন, আর অন্তত ২০টি পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে ।বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেশের আক্রান্ত এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয় বিভিন্ন সময়। ২০০৬ ও০৭ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন ছিলো।
প্রতিরোধক ব্যবস্থা
আর্সেনিক বিষক্রিয়া থেকে মুক্তির জন্য আপাতত প্রতিরোধক ব্যবস্থাই সবচেয়ে উপযোগী। ব্যক্তিগত পর্যায়ে করণীয়গুলো হল
আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের পানি পান ও রান্নার কাজে ব্যবহার না করা।
নিকটে আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ পাওয়া না গেলে পুকুর বা নদী হতে ১ কলসি পানিতে আধা চামচ ফিটকিরি মিশিয়ে ২-৩ ঘণ্টা রেখে দিয়ে, পরে উপর থেকে তলানিবিহীন পরিষ্কার পানি পান করতে হবে।
বৃষ্টির পানি যেহেতু আর্সেনিকমুক্ত, তাই বৃষ্টি আরম্ভ হবার ৫ মিনিট পর সরাসরি পরিষ্কার পাত্রে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে তা পান করতে হবে।
আর্সেনিকমুক্তকরণ
পিএসএফ-এর মাধ্যমে শোধন-সক্ষম ফিল্টারের মাধ্যমে পানি আর্সেনিকমুক্ত করে ব্যবহার করতে হবে।
বাংলাদেশে, আর্সেনিকযুক্ত পানি থেকে আর্সেনিক মুক্ত করার একটি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি রয়েছে, যাকে বলা হয় তিন কলসি পদ্ধতি । এজন্য তিনটি কলসি একটির উপর আপরটি রাখতে হয়। সর্বউপরের কলসিতে রাখতে হয় লোহার কণা ও মোটা দানার বালু; মাঝখানের কলসিতে রাখতে হয় কাঠ কয়লা ও মিহি দানার বালু এবং একেবারে নিচের কলসি থাকবে খালি। আর্সেনিকযুক্ত পানি এনে ঢালতে হবে সর্বউপরের পাত্রে, তা ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার, বিশুদ্ধ ও আর্সেনিকমুক্ত হয়ে জমা হবে সর্ব নিচের কলসিতে। এই পদ্ধতিতে আর্সেনিকের মাত্রা অন্ততপক্ষে ৫০ পিপিবি এর নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব।
সূূত্র্র,ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:০৫