আমার দেখা থাইল্যান্ডঃ পর্ব- ৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
কোরাল দ্বীপের হাতছানি।
যত রাত করে ঘুমাইনা কেন আমার অভ্যাস আযানের পর পর ঘুম থেকে উঠা। টয়লেট সেরে বাথরুমে বোকা সেজে চুপচাপ বসে আছি। কি করবো বুঝতে পারছিনা। টয়লেট শেষে পানি ব্যবহার করার কোন ব্যবস্থা নেই। সম্বল টিস্যু পেপার। মজার বিষয় হলো থাইল্যান্ডের সব হোটেল এমনি। সম্ভবত বিদেশীরা পানি নেয়না। টিস্যু ব্যবহার কইরা গায়ে সেন্ট স্প্রে মাইখ্যা ঘুইরা বেড়ায়। বাথরুমের একদিকে একটা কমোড, তার অপজিট পাশে বেসিন। বাকি ডান পাশের এলাকা জুড়ে বাথটাফ। বাথটাফের উপর ঝরনা ও একটি বাথ হ্যান্ড শাওয়ার। বেসিনের উপর এবং বাথ টাফের উপর ছাড়া কোথাও কোন ট্যাপ বা অন্যকোন পানি বের হওয়ার ব্যবস্থা নেই। কাল রাতে বিষয়টা খেয়াল করা হয়নি। এরপর বউ এর গলা শুনতে পেলাম- "কি হলো, এতক্ষন বসে কি করো?'' কি উত্তর দিব এর, একা একা অনেক্ষন হাসলাম। অবশেষে বাথটাফের উপর থেকে অনেক কষ্টে হ্যান্ড শাওয়ার নিচে নামিয়ে পানি ব্যবহার করতে হয়েছে। যে কয়দিন ছিলাম এভাবেই চলতে হয়েছে।
সাতটার ভিতর হোটেল লবিতে নেমে এলাম। ব্রেকফাস্ট সেরে কোরাল দ্বীপে রওনা দিব। হোটেল ভাড়ার সাথে ব্রেকফাস্ট একমোডেশন আছে। এদের রেষ্টুরেন্ট টা পছন্দ হলো। অনেক সুন্দর করে সাজানো। ১১০ আইটেম দিয়ে বুফেট ব্রেকফাস্ট আয়োজন করা আছে। ইন্ডিয়ান ফুডের সাথে আছে সি-ফুড। সি-ফুডের ভিতর অক্টোপাসের ফ্রাই আর হাংগরের কারী অন্যতম। সি- এলাকায় যেয়ে সি-ফুড খেতে না পেরে বেজায় দুঃখ পেলাম।
বীচ পয়েন্ট
সিলভীকে রেষ্টুরেন্টে রেখে আমি বাইরে এলাম। ডলার এক্সচেঞ্জ করতে হবে। এত সকালে ব্যাংক খুলেছে কিনা কে জানে!বাইরে এসেই ভুল ভাংলো। আমাদের ঢাকার শহরে যেমন, যেখানে সেখানে চায়ের দোকান দেখা যায় এখানে তেমনি মানি এক্সচেঞ্জের দোকান। সে এক এলাহি কান্ড। একটি দেশ কিভাবে শুধুমাত্র পর্যটনের উপর টিকে থাকে সেটা থাইল্যান্ডকে না দেখলে বুঝা যাবেনা।
আমরা ৮ টা বাজার আগে আগে মাইক্রো বাসে করে বিচ পয়েন্টে আসলাম। এশিয়ান হলিডেজের গ্রুপের সাথে আমরাও আছি। গন্তব্য কোরাল দ্বীপ। বিচ পয়েন্টে এসে অভিভুত হয়ে গেলাম। অজান্তেই মুখ দিয়ে ওয়াও বের হয়ে পড়বে। এত সুন্দর ডেকোরেটেড বিচ দেখে আমরা অভ্যস্ত নই। সাথে আল্লাহর দান নীল সমুদ্রের পানি। পাহাড়ে ঘেড়া চারিদিক। ঝকঝকে সাদা বালুর উপর নীল পানির ঢেউ এসে পড়ছে। গোসল করার সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। এর বায়রে কেউ যেতে শপারবে না। পুরো নিরাপত্তা তদারকির জন্য স্প্রীড বোট নিয়ে নিরাপত্তা কর্মীরা এপাশ থেকে অপাশ ছুটাছুটি করছে। আমাদের দেশের মত সমুদ্রের পানিতে ভেসে যাবার ইতিহাস এদের নেই। বিভিন্ন রঙের মানুষের পদচারনা। সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বালির উপর দেখি টাওয়েল বিছিয়ে শুয়ে আছে কিছু বিদেশিনী। যথারিতি কাপড়চোপড় ছাড়া। এদের সমস্যা কি বুঝলাম না। এই রোদের ভিতর কাপড় খুলে শুয়ে থাকার মানে কি! সিলভীকে জিজ্ঞেস করলাম বিষয়ডা কি? সে বলল সান বাথ নিচ্ছে। ওরে আল্লারে, পানি বাদ দিয়ে হেরা সানে বাথ লয়। বিষয়টা হলো তারা সাদা চামড়াকে রোদে পুড়িয়ে তামাটে করতে চায়। মানুষের মস্তিস্কের বিকৃতি ইবলিশ কিভাবে ঘটিয়ে রেখেছে ভাবতেই অবাক লাগে। এছাড়া বাকি যেসব পর্যটক ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা ব্রা প্যান্টি পড়া। ৬০ বছরের বুড়িকেও দেখি এই ড্রেসে ঘুইরা বেড়াইতেছে। কারও কোন বিকার নেই। এটাই যেন স্বাভাবিক দৃশ্য। আমরাই যেন অস্বাভাবিক। আমাদের সাথের মেয়েরা একটা জামার উপরেও আবার বাড়তি জামা পড়া। তাদের দিকে কেউ তাকিয়ে দেখছে না, বরং আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। এর ভিতরেই আমাদের স্প্রিড বোট এসে হাজির। এতে করেই সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে।
প্যারাসুটে এভাবেই ঘুরে বেড়ায়।
তিন বিদেশী আর পাচ বাংলাদেশী নিয়ে নীল সমুদ্রের পানি চিড়ে ছুটে চলছে আমাদের স্প্রিড বোট। আমার বউ ছাড়াও আরো দুইটি মেয়ে আছে আমাদের সাথে। ওই দুইজন দেখি চোখ বন্ধ করে আছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর স্প্রিড বোট ঝাপিয়ে পড়লে যখন পানি গায়ে এসে পড়ছে তখন তারা একবার করে চিল্লানি দিচ্ছে। আর আমার বউ শক্ত হয়ে বসে আমাকে খামচি দিয়ে ধরে তার হাতের নখ আমার শরীরে ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টায় আছে। ভিতরে ভিতরে আমিও আতংকিত বোধ করছি। স্প্রিড বোট যখন একটা ঢেউয়ের উপর আচড়ে পড়ে তখন সরাসরি মাথায় আঘাত লাগে। মনে হয় স্প্রিড বোট ভেঙে মাঝ বরাবর দু-খন্ড হয়ে যাবে। এভাবে কিছুক্ষন চলার পর ফেরির মত দেখতে একটা প্লাটফর্ম ভাসতে দেখা গেল। আমাদের বোটের গতি কমে আসলো। ধীরে ধীরে প্লাটফর্ম ঘেসে দাড়ালে আমরা নেমে পড়লাম।
নীল সমুদ্রের মাঝে ফেরির উপরে আমি
অনেক পর্যটক এখানে অবস্থান করছে। এখানে প্যারা ট্রুপের ব্যবস্থা আছে। প্যারাসুটের সাথে আপনাকে বেধে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। প্যারাসুটের সাথে ১০০০ ফিটের মত একটি দড়ি স্প্রিড বোটের সাথে বেধে টান দিয়ে অনেক দুর চলে যাবে আর আপনি তররর করে উপরে উঠতে থাকবেন। অনেক বড় এলাকা নিয়ে সমুদ্রের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। যখন উপরে উঠে যায় অনেক ক্ষুদ্র দেখা যায় একজন মানুষকে। অনেকে ৫০০ বাথ দিয়ে টিকিট কেটে লাইনে দাড়িয়ে আছে। একজন প্যারাসুট নিয়ে ফিরে আসছে আর একজন উড়ে যাচ্ছে। অনেক বলেও বউকে রাজি করাতে পারলাম না। পিচ্চি পিচ্চি পুলাপাইন দেখি উড়ে যাচ্ছে। উত্তাল সমুদ্রের মাঝে এইসব কাহিনী করতে অবশ্য মজবুত হার্ট দরকার। আমার হার্ট এত মজবুত না। তারপরও বউ এর কাছে নিজের বাহাদুরি ধরে রাখতে ৫০০ বাথ দিয়ে একটি টিকিট কেটে ফেললাম।
লাইনে দাড়ানোর পর দেখি শীতের মাঝেও ঘামছি। শুধু উড়িয়ে ফেরত নিয়ে আসলে ঘামটা মনে হয় হতোনা। এই ইভেন্টের ভিতর থ্রিল ভাব বেশি আনার জন্য প্যারাসুট যখন শেষ উচ্চতায় অবস্থান করে তখন স্প্রিড বোট দাড়িয়ে পড়ে। এসময় প্যারাসুট সহ মানুষটি ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে। নামতে নামতে সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর পড়ে গেলে আবার স্প্রিড বোট দৌড় মারে, আবার মানুষটি আকাশে উঠতে থাকে। এসময়কার কথা ভেবে আমি বেশি চিন্তিত। আল্লাহ্ না করুক কোন ভাবে যদি দড়ি ছিড়ে আমি থেকে যাই তখন অবস্থা কি হবে!!!
দুই হাতের ভিতর দিয়ে বেল্ট বেঁধে দিল, আর একজন মাজার দিকে ক্লিপ লাগাচ্ছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। অতিরিক্ত সেফটির জন্য লাইফ জ্যাকেট পড়ব কিনা ভাবছি। যা কিছু বাচ্চাকে ব্যহবার করতে দেখলাম। বাচ্চারা করুক আর যেই করুক এই রিস্ক আমি নিতে পারবো না। বউ শুধু দাত বের করে হাঁসে। আমিও বোকাদের মত হাঁসি। বোকা না হইলে এই ফ্যাসাদে কেউ পড়ে? উড়া দেখতে ভালোই লাগছিল, তাই বলে আমারও যে উড়তেই হবে এমন তো কোন কথা নেই। হটাত করে কি হলো বুঝতে পারলাম না। নিজেকে ফেরির ডেক থেকে শুন্যে আবিস্কার করলাম। আমাকে টেনে ফেরির বাইরে নিয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি নিচে দাঁড়াবার কোন যায়গা নেই। নীল পানির বড় বড় ঢেউ দেখা যাচ্ছে। এতক্ষন ফেরিতে বসে ঢেউ গুলোকে এত বড় মনে হয়নি। লাইফ জ্যাকেট না পড়ে আসলেই মনে হয় ভুল করলাম।
স্প্রীড বোটে দাঁড়িয়ে পিছনে কোরাল দ্বীপ।
তরতর করে উপরে উঠছি। ভিতরটা ফাকা হয়ে যাচ্ছে। বাতাসের চাপে চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ মনে হয় বন্ধ করে রেখেছি। কিছুই দেখতে পারছিনা। ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। আমি বিশাল নীল সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ছি। দুর থেকে পাতায়া শহরটাকে দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের মাঝে মাঝে ছোট বড় পাহাড়। আমার পাশ দিয়ে আরো দুজনকে উড়ে যেতে দেখলাম। মনে হচ্ছে এখানেই অনন্তকাল থেকে গেলে মন্দ হতোনা। পাখির মত ভেসে বেড়াচ্ছি শুন্য আকাশে। যেখান থেকে উঠে এসেছি সেটা খুঁজে পাচ্ছিনা। কোন দিকে ফিরে যাবো সেটাও বুঝতেছিনা। এখন এটা বুঝতে পারছি সমুদ্রের ঢেউ আস্তে আস্তে বড় দেখা যাচ্ছে। তারমানে স্প্রীড বোট থেমে যেয়ে আমাকে নিচে নামার সুযোগ করে দিয়েছে। আমি নিচে নেমে যেতে থাকলাম। ঘাড় থেকে মাজা পর্যন্ত ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। এইযে ঢেউ… এখনই আমাকে ধরে ফেলবে... পায়ে পানির ছিটা অনুভব করলাম। ভেবেছিলাম আমি পড়লে চারিদিকে পানি ছিটকে পড়বে। তেমন কিছুই হলোনা। আমি হেঁটে হেঁটে পানিতে নামলাম মনে হলো। ধীরে ধীরে মাজা পর্যন্ত তলিয়ে গেলাম। ঐ যে একটি বড় ঢেউ আমার দিকে ধেয়ে আসছে। এখনই আমি ঢেউয়ের নিচে চলে যাবো। এখনও কেন আমাকে টেনে নিচ্ছে না? দড়ি কি তাহলে সত্যি ছিঁড়ে গেছে? প্রিয়জনদের মুখ আর কি দেখতে পাবো না? সিলভী কি একা একা দেশে ফিরতে পারবে?
------------- (চলবে) --------
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন
মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সত্যি বলছি, চাইবো না
সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখস্থান.....
শেখস্থান.....
বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন