একুশে মানে মাথা নত না করা, একুশ মানে দুরন্ত মনে শহীদের প্রতি ভালোবাসা, প্রেম। একুশ আমাদের চেতনা। আমাদের দেশ, জাতির প্রতি চরম দায়িত্ব বোধের কথা একুশ স্মরণ করিয়ে দেয়। কিছু প্রাণের বিনিময়ে যে ভাষা, প্রাণের ভাষা তার মর্যাদা রক্ষায় সবার সচেতনতা এবং প্রাণের গভীরের ভালোবাসা প্রয়োজন। শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে এবং বাংলাদেশের জাতিসত্তার বিকাশে আমাদের স্বশিক্ষিত সচেতন জাতি হতে হবে।
প্রথম শহীদ
একুশের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জের আবদুল লতিফের বড় ছেলে। তার মায়ের নাম লতিফা খাতুন। সিঙ্গাইর থানার পারিল গ্রামে তাদের বাড়ি ছিল সে সময় তার বয়স হয়েছিল ২৬ বছর। পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের কারণে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ব্যারাকে আশ্রয় নেয়ার সময় তাদের সাথে ছিলেন রফিক। গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ মারা যান তিনি। আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
প্রথম লিফলেট
একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় একটা কিছু করার তাগিদে ওই দিনই সন্ধ্যায় আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ফজলে লোহানী ও হাসান হাফিজুর রহমান পাটুয়াটুলীর সওগাত অফিসের বিপরীত গলিতে অবস্থিত পাইওনিয়ার প্রেসে যান। দু’টি টেবিলে বসে লিখে ফেলেন কয়েকটি প্রবন্ধ, নিবন্ধ। তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয়ে যায় একটি বুলেটিন।
‘বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠীর কবর রচনা করব’। বুলেটিনটি লিখেছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। এটি ছাপানোর কাজ করেন হাসান হাফিজুর রহমান।
প্রথম সঙ্কলন
একুশের প্রথম সঙ্কলন একুশে ফেব্রুয়ারি। সম্পাদনা করেন হাসান হাফিজুর রহমান। ১৯৫৩ সালে পুঁথিপত্র থেকে এটি প্রকাশ করেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী মোহাম্মদ সুলতান। আলী আশরাফ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গনি হামারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালউদ্দিন, আতাউর রহমান, সওকত হোসেন, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম, আতোয়ার রহমান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেন, কবির উদ্দিন আহমেদের লেখায় সমৃদ্ধ এই সঙ্কলনের স্কেচগুলো করেন মুর্তজা বশীর। মায়ের গয়না বিক্রি করে সঙ্কলনের প্রকাশের টাকা জোগাড় করেন হাসান হাফিজুর রহমান।
একুশের প্রথম স্মরণিকা
ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসের পক্ষ থেকে ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত চার পৃষ্ঠার পুস্তিকা শহীদের স্মরণে একুশে প্রথম স্মরণিকা।
শহীদ মিনার ধ্বংসের প্রতিবাদে প্রথম কবিতা
১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশের হাতে প্রথম শহীদ মিনার ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ রচনা করেন স্মৃতিস্তম্ভ। ঐতিহাসিক এই কবিতার চরণ-
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?
ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো
চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো
যে ভিত কখনও কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে।
তিনি শহীদ মিনার ভাঙার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন।
প্রথম কবিতা
একুশে প্রথম কবিতাটি লেখেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। কবিতাটির নাম- কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।
প্রথম বই
১৯৫২ সালের একুশের ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার মাত্র তিন মাস পর ভাষা আন্দোলন ও একুশের ইতিহাস নিয়ে লেখা হয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। গ্রন্থটির সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাশেম। ১৯৫২ সালের জুন মাসে বইটি প্রকাশিত হয়।
প্রথম গান
একুশের প্রথম গান রচনা করেন ভাষাসৈনিক আ ন ম গাজীউল হক। গানটির প্রথম চরণ-
‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’।
এ গানটি সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
প্রভাতফেরির প্রথম গান
১৯৫৩ সালে প্রথম শহীদ দিবসের প্রথম প্রভাতফেরিতে গাওয়া হলো
‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল
ভাষা বাঁচাবার তরে
আজিকে স্মরিও তারে’।
গানটির রচয়িতা প্রকৌশলী মোশারফ আহমেদ। ১৯৫৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লেখা হয়েছিল গানটি। সুর করেন আলতাফ মাহমুদ।
প্রথম নাটক
একুশের প্রথম নাটক মুনীর চৌধুরীর কবর। ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে ১৯৫২ সালে জেলে আটক ছিলেন রনেশ দাশ গুপ্ত, মুনীর চৌধুরীসহ অনেক লেখক-সাংবাদিক। মুনীর চৌধুরী, ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি নাটকটি লিখে শেষ করেন। একুশ নিয়ে লেখা অন্য একটি নাটক মমতাজ উদ্দীন আহমেদের বিবাহ।
একুশের গল্প
মাহমুদুল হকের ছেঁড়াতার, সেলিনা হোসেনের মীর আজিমের দুর্দিন ও আহমেদ বশীরের উনিশ শ’ তিহাত্তুরের একটি সকাল।
প্রথম উপন্যাস
অমর একুশ নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস আরেক ফাল্গুন। শহীদ দিবস, একুশের মিটিং মিছিল, সরকারি বাধা, শহীদ মিনার নির্মাণসহ একুশের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন ঘটনাকেন্দ্রিক এ উপন্যাসটি লিখেছেন জহির রায়হান। একুশ নিয়ে লেখা অন্যান্য উপন্যাস শওকত ওসমানের আর্তনাদ, সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি ও যাপিত জীবন।
প্রথম শহীদ মিনার
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার শুরুতে ছিল ১১ ফুট লম্বা ত্রিস্তরবিশিষ্ট একটি স্তম্ভ। ২৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রনেতা গোলাম মাওলা ও তার সহযোগীদের উদ্যোগে স্তম্ভটি রাতারাতি গড়ে তোলেন প্রায় ৩০০ মানুষ। এই স্তম্ভের নকশা করেছিলেন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বদরুল আলম।
সর্বোচ্চ শহীদ মিনার
দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। এ শহীদ মিনারের উচ্চতা ৭১ ফুট ও ব্যাস ৫১ ফুট। এটি উদ্বোধন হয় ২০০৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি।
বিদেশে স্থাপিত প্রথম শহীদ মিনার
বিদেশের মাটিতে প্রথম শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হয় ২০০৬ সালের ১৬ এপ্রিল জাপানের রাজধানী টোকিওর ইকেবুকো পার্কে।
প্রথম শহীদ দিবস
১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো পালন করা হয় শহীদ দিবস।
প্রথম জনসভা
একুশের শহীদদের স্মরণে ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েরানা জানাজার পর একটি সংক্ষিপ্ত সভা হয়।
প্রথম মিছিল
১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথম সভা শেষে সমবেত হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীসহ সর্বস্তরের মানুষ বিশাল মিছিল নিয়ে হাইকোর্টের পথ ধরে নবাবপুর রোডের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।
প্রথম প্রতিবাদ
একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ বেলা সাড়ে ৩টায় পূর্ববঙ্গ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে অধিবেশন সে দিনের জন্য স্থগিত রাখার দাবি জানান আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ।
একুশের প্রথম বিশেষ সংখ্যা
একুশে ফেব্রুয়ারি ও ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সৈনিকে র বিশেষ সংখ্যা।