শহরের এক কর্দমাক্ত রাস্তায় দাড়িয়ে ছিল ‘ব্যাম্পি’।কিন্তু ভালভাবে খেয়াল না করলে বুঝা যায় না যে সেই স্যাঁতস্যাঁতে ঘন তরলটি আসলে রক্ত,নিচের দিকে না তাকালে অত্যন্ত বুঝা যায় না।দীর্ঘ ৬ বছর সে না খেয়ে আছে, উলটো তার সামনেপিছনে অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন। বহু সাধনায় সে ৫ বছর না খেয়ে থাকার অভ্যাস রপ্ত করেছে, কিন্তু তাই বলে এই অতিরিক্ত ১ বছর না খেয়ে থাকার দরুন তার পাকস্থলী থেকে ক্ষুদা গিয়ে পৌছিয়েছে মস্তিষ্কে।দূর থেকে এখন ‘ব্যাম্পির’ কপালের ধমনী গুলাও স্পষ্ট বুঝা যায় আর তার উদ্ভ্রান্ত চোখ জোড়া প্রমাণ করে সুযোগ পেলেই সে শহরটা ছিড়ে খাবে।
__
‘অ্যামিলি’ আবার সে তুলনায় অনেক স্বাভাবিক। তার ভয়ঙ্কর মুখশ্রীর নিয়েও সে অনেক সুন্দর করে হাসতে পারে। আর সে হাসিতে ‘জনকে’ ভুলিয়ে ভুলিয়ে ছ’টি বছরও সে কাটিয়ে ফেললো।৬ বছরে সে এখন ভালোই স্বাস্থ্যবান এবং স্বাস্থ্য অনুযায়ী অবশ্যই তার চাহিদাও অনেক বেশি।তবুও ‘ব্যাম্পির’ মতন সে এখন আপাতত অভুক্ত নয়। যদিও তার চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে ‘জন’ তার প্রতিবন্ধী শরীর নিয়েও দিন রাত সার্কাসে খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে। কারন এই সার্কাসের আয় থেকেই ‘অ্যামিলির’ সংসার চলে।
__
সার্কাস দেখতে আসা দর্শকগুলাও বেশ অদ্ভুত। তাদের কারও হাত নেই, কারও কান নেই, কারও ঠোঁট নেই।মজার ব্যাপার হচ্ছে দর্শক সারিতে বসা সবাই স্বাভাবিক রূপেই জন্মেছিল। কিন্তু সেই প্রতিবন্ধীদের সার্কাস এতোটাই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল যে তারা নিজেরাই নিজেদের এই অবস্থা করে। কিন্তু সবার মধ্যে একটা জাগায় অদ্ভুত মিল- আর সেটা হচ্ছে তাদের দু’জোড়া অস্বাভাবিক সাদা চোখ। ভ্রু না থাকার কারনে তাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সার্কাস তাদের অনন্তকাল ধরে দেখে যাওয়া লাগছে। আর এ কারনে তাদের চোখের মনি এক বিন্দুতে গিয়ে ঠেকেছে। বাইরে থেকে নতুন কেউ সার্কাসে প্রবেশ করলে সেই অসাধারন সুন্দর স্থির চোখগুলা দেখে বিমোহিত না হয়ে পারবে না।
__
‘ব্যালিতে’ ‘ব্যাম্পির’ এক পুত্র সন্তান ‘টারকে’ থাকে। শোনা যায় তার ঘুণে ধরা মস্তিষ্ক আর ঘৃণা ভরা হৃদয় নিয়ে সে এই নোংরা শহরতলিতে ফিরতে চায়। আর সে কথা সেই সার্কাসের প্রতিবন্ধীরা আবার বিশ্বাসও করে।কিন্তু এই কথা ঠিক ‘ব্যাম্পি’ যখন আবার তার খাবারের সন্ধান পাবে ‘টারকে’ আবার ফিরে আসবে। আর এই কথা সেই সার্কাসের দর্শক সারিতে বসা কিছু লোকও জানে যে সে ফিরত আসলে মদ আর রক্তের স্রোতের মধ্যে কেউ তখন পার্থক্য করতে পারবে না। সার্কাসে খেলা দেখানোর জন্য তখন নতুন ভাঁড় নিয়োগ দাওয়া হবে।মদ আর রুটি দিয়ে তাদের আহারের ব্যাবস্থা করা হবে। মাঝে মাঝে মদের রঙ তখন গাঁঢ় লাল হলেও কেউ কখনও তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না।
__
‘অ্যামিলিরও’ এদিকে এক পুত্র সন্তান আছে- ‘স্যাজন’।শহরতলির দূষিত বায়ুতে সে নাক চেপে ধরে। মাঝে মাঝে বাকীদের দেখে সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চায়।কিন্তু পরক্ষণেই আবার অক্সিজেনের সিলিন্ডারে সে মুখ লুকায়। অত্যন্ত বাইরে থেকে সবাই তাই মনে করতো। কিন্তু তার ভিতরের ৪০ বছরের পুরানো এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি আজও বিদ্যমান। সেই গলিত লাভা দিয়ে সে এই শহর পরিষ্কারের স্বপ্ন দেখায়, কিন্তু তাতে যে গোটা শহরটা পুড়ে যাবে তা সে কাউকে বুঝতে দেয় না। তার খুব কাছাকাছি গেলে এই আগ্নেয়গিরির উত্তাপ কিছুটা হলেও পাওয়া যায়। কিন্তু তা ‘জন’ এর কাছে পৌঁছানোর আগে সে নিজেও ভস্মীভূত হয়।সেই ছাই দেখে বিষয়টি কেউ অনুধাবন করলেও তারা চুপ করে থাকে। সার্কাস থেকে আসা বিশাল আয় দেখে ‘স্যাজনের’ চোখ চক চক করে। কিন্তু তাই বলে সে ‘টারকের’ মতন উত্তেজিত হয় না।সে শহরের বাতিগুলো চুপিসারে নিভিয়ে দেয় যেন অন্ধকার ‘জন’দের চোখ ধীরে ধীরে সয়ে যায়।
__
শোনা যায় কেউ কেউ সার্কাসের দর্শক সারি থেকে মাঝে মধ্যে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দীর্ঘ দিনের বিকলাঙ্গতায় তারা বাইরের পরিবেশে টিকতে পারে না। ফলে তাদের শেষ আশ্রয় হয় শহরের একমাত্র ‘আস্তাকুড়ে’।তা দেখে শহরের সেই গলির মাথায় দাঁড়ানো ‘ব্যাম্পির’ জিহবা বের হয়ে আসে। ধীরে ধীরে সে সেই ‘আস্তাকুড়ের’ এগিয়ে যায় আর মনে মনে বলে- “আজ ভোজন হবে”।
লেখা ঃ আনিক ইবনে সিদ্দিক
https://www.facebook.com/anik.i.siddique?fref=nf