বাংলাদশে সহ আরও কিছু দেশের অদক্ষ শ্রমিকদের অন্যতম প্রধান একটি গন্তব্য হচ্ছে সৌদী আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলি, বিশেষত সৌদী আরবে, আসা নতুন প্রবাসীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুন।
সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে সমস্যাও বেড়েছে। নতুন প্রবাসীরা কাজ পাচ্ছেন না, কফিল খুঁজে পাচ্ছেন না, ইকামা হচ্ছে না আরও কত কি। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আমাদের দেশের অনেক মানুষ বিস্মিত একটি কথা শুনে, বৈধ কাগজ-পত্র থাকার পরও "হুদাই" নাকি সৌদী পুলিশ মানুষ ধরে ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়।
অনেকেই আমার কাছে জানতে চান যে ঘটনা সত্য কি না। এর উত্তর একই সাথে না এবং হ্যাঁ। কিভাবে? বুঝতে হলে প্রথমে সৌদী লেবার সিষ্টেমটা আপনাকে বুঝতে হবে। তাই ধৈর্য্য থাকলে আগান। আর যদি ধৈর্য্য না থাকে, তাহলে সহজ উত্তর জানুন যে যারা বলছে যে বৈধ কাগজ-পত্র থাকা সত্বেও তাদের "হুদাই" পাঠিয়ে দিয়েছে, তারা ভুল!
সৌদীতে চাকরীর সিষ্টেম।
পৃথীবির যে দেশেই আপনি ওয়ার্ক ভিসায় যেতে চান না কেন, আপনার একটি কম্পানির সাথে চুক্তি থাকা লাগবে, সেখানে চাকরী থাকা লাগবে। সৌদী আরবে সেটাই, বরং কম্পানির সাথে সাথে ব্যক্তি মালিকানাধীন ছোট প্রতিষ্ঠান এবং বাসা-বাড়ির কাজের লোক ও ড্রাইভার হিসাবেও আসা যায়। এদেরকে আমরা কফিল বলি।
সৌদী সিষ্টেম হচ্ছে, আপনি নির্দিষ্ট একটি কাজের জন্য আসবেন এবং সেটাই করবেন। অন্য কিছু করবেন না। অর্থাৎ আপনাকে যদি ড্রাইভিং ভিসায় আনা হয়, আপনি শুধু ড্রাইভিংই করবেন, কফিলের কোন দোকান থাকলে সেটায় বসতে পারবেন না। এমনকি হাউজ ড্রাইভার হয়ে আপনি হাঙ্গারস্টেশন, উবার ইটস, মারসুল ইত্যাদি কোন ডেলিভারী কম্পানিতেও কাজ করতে পারবেন না। মজার বিষয় হচ্ছে, আপনি হাউজ ড্রাইভার তো আপনি লিগ্যালী ঐ কফিলেরই গাড়িও ধুইতে পারবেন না বা কফিল আপনাকে দিয়ে গাড়ি ধোয়াতে পারবে না; এর জন্য নির্দিষ্ট দোকান আছে, সেখানে গিয়ে ধুয়ে নিয়ে আসতে হবে। এটাই আইন!
আর সেখানে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে বা নিজে নিজে কাজ করার তো কোন নিয়মই নাই!
আপনার মাসিক বেতন ও ইকামা (রেসিডেন্সি কার্ড) রিনিউয়ালের দ্বায়িত্ব কফিলের। এটার জন্য আপনার চিন্তা করার কথা না।
৯৯.৯৯% বাংলাদেশীদের ভুল
বাংলাদেশীদের মধ্যে "ফ্রী ভিসা" নামে একটা কথা চালু আছে। এখানে থাকা বেশীর ভাগ বাংলাদেশীই মনে করে তারা ফ্রি ভিসায় সৌদীতে আছে। আর ৯৯.৯৯% বাংরাদেশীই মনে করে যে ফ্রি ভিসা বলতে আসলেই কিছু আছে। অন্য দেশীরা এটা কতটা মানে তা বলতে পারবো না!
কিন্তু আদতে ফ্রি ভিসা বলতে কিচ্ছুই নাই!
ফ্রী ভিসা কাকে বলে?
যদিও এটার আসলে কোন অস্তিত্ব নেই, তবুও যেহেতু আমরা বাংলাদেশীরা মনে করি এটা আছে, তাই এটার একটা সংজ্ঞাতো আছেই।
ফ্রী ভিসা হইলো সেই ভিসা, কফিল আমাকে একটা ভিসা দিয়ে নিয়ে আসবে, এরপর আমি কফিলকে মাসে মাসে একটা টাকা দিবো, কফিলকে বছরে ইকামা রিনিউয়ালের টাকা দিবো, আর আমার মন খুশি মত যা কাজ করার করবো!
সমস্যা কোথায়?
যদি স্কিপ না করে পড়ে থাকেন, তাহলে আপনি সমস্যা ধরে ফেলেছেন।
সমস্যা হচ্ছে, আমরা আসছি এক ভিসায় একজনের আন্ডারে, কিন্তু কাজ করছি নিজে নিজে। শুনতে অবাক লাগবে হয়ত, বেশীরভাগ দেশী ভাই হয়ত কখনও তাদের নিজেদের কফিলকে চেনা জানা দূরে থাক, দেখেও নি!
আমি যখন সৌদী আসি, আমার কফিল থাকতো রিয়াদের কোন এক গ্রামে, আর আমি থাকতাম অন্য শহরে। পুরা আড়াই বছর তার কম্পানিতে ছিলাম, কিন্তু তার নামটুকু পর্যন্ত জানি না, দেখে হওয়াতো দূরের বিষয়।
সোজা কথায় এটা অবৈধ পন্থা এবং প্রায়সই এদেরকে পুলিশ ধরে। ধরেই দেশে পাঠায় না। এদের সুযোগ দেয় কফিলকে ডাকার। কফিল এসে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যদি প্রমানিত হয় যে আমি অন্য কোথাও কাজ করছিলাম, তাহলে কফিল ও আমার উভয়েরই বড় অংকের জরিমানা দিতে হয়।
যেহেতু কফিলদের সাথে কোন কানেকশন নাই, এবং কফিলের খেয়ে কাজ নেই যে গাঠের টাকা দিয়ে ফাইন দিবে, তাই অধিকাংশ সময়ই কফিল আসে না।
নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে গেলে এদের ধরে ডিপোর্ট করে দেওয়া হয়।
==========================
সৌদী আরবে কতজন বাংলাদেশী আছে? শুনেছি প্রায় লাখ ২৫ লোক থাকেন। আদতে সংখ্যা হয়ত তার থেকে অনেক বেশী। এদের অনেক বড় একটা অংশই বেশ কষ্টে আছেন। অধিকাংশই কাজ করছেন নিজের মত, কিন্তু ইকামায় কাজের বর্ণনা অন্য রকম। বেশীর ভাগেরই কফিলের সাথে যোগাযোগ নেই, যাগাযোগ থাকলেও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে না!
লেবার শ্রেণীর যারা আসে, তাদের অধিকাংশই আসলে নিয়মকানুন জানে না। তার উপর আমাদের মনে হয় নিয়মকানুন ভাঙ্গার একটা প্রবণতা আছে, যা আমাদের বিপদকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
সৌদী আরবে ওয়ার্কার ভিসা যা দেওয়া হয়, তার চার ভাগের এক ভাগ যায় বাংলাদেশীদের ভাগে। দুবাইতে যেখানে বেশী বেশী ভারতীয়রা আসবার কারণে পুরা দুবাই কার্যত ভারতীয়রা চালায়, তেমন অবস্থান বাংলাদেশীরা সৌদীতে করতে পারেনি। পারার সম্ভাবনাও দেখি না।
এদের কাছে সঠিক তথ্য পৌছেও খুব একটা লাভ নেই, এরা সঠিক তথ্য গ্রহণ করতে নারাজ!
Photo by Safaa Almohandis on Unsplash
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৪:১৯