বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম, এমন সময় গাড়ির শব্দে নিচে তাকিয়ে দেখি এদের গাড়ি ঢুকছে। একটু অবাক হলাম,মা-মেয়ের তো এত তাড়াতাড়ি ফেরার কথা না! হথাৎ একটা ভাবনা খেলে গেল মাথায়। সদর দরজার তালাটা খুলে রেখে চলে গেলাম মা-টার শোবার ঘরের বারান্দায়। নিচে তাকিয়ে দেখলাম গাড়ি থেকে শুধু মেয়েটাই নামছে। ভালোই হল। আশাকরি ভালোই ভয় পাবে মেয়েটা। আমি আবার আকাশ দেখতে থাকলাম।
শুনতে পেলাম কলিংবেল বাজছে। একবার বেজে থামল। তারপর আবার বাজল। তারপর আবার। তারপর বাজতেই থাকলো। আমি মনোযোগ দিয়ে আকাশ দেখছিলাম। মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটিয়ে দুদ্দাড় শব্দ শুরু হল এবার দরজায়। আহ! গাধা মেয়েটা কেন যে একবার নবটা ঘুরিয়ে দেখছে না!
দরজা খোলার শব্দ পেলাম। গাধাটার মাথায় নব ঘুরানোর বুদ্ধি আসতে এত সময় লাগলো! ওই যে, শুরু হল বুয়া বুয়া করে চিৎকার। আমি আবার আকাশ দেখায় মনোযোগ দিলাম। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় এই ঘরে এলে আমাকে পেয়েই তো যাবে!
সব ঘর-বারান্দা-বাথরুম খোঁজা শেষ করে এই ঘরে এলো মেয়েটা সবার শেষে। এসেই দিল একটা হুংকার। তারপর বকার তুবড়ি ছুটল- কেন আমি দরজা লাগাইনি, কেন কলিংবেল শুনতে পাইনি, কেন দরজার ধাক্কাও শুনিনি, কেন বেডরুমে ঢুকেছি। মেয়েটার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। মনে মনে একটু মুচকি হেসে নিলাম। যদিও ওইটুকু মেয়ের মুখে এত বকাঝকা শুনে আমার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছিল, তবু নিজেকে সামলে নিলাম। কারন তখন আমি মনে মনে অন্যকিছুর পরিকল্পনা করছিলাম।
ভয়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটার পর আমার ওপর বকাঝকাও থামল। তারপর আদেশ হল চা বানানোর। তারপর সে সাজতে বসলো- রাতে নাকি দাওয়াত আছে কোথায়। মেয়েটা দেখতে আহামরি সুন্দরী না, তবে সাজলে বেশ লাগে!
চায়ের পানিতে বলক উঠলে পাতি ঢেলে দিয়ে আমি ঢুকলাম এদের “সারভেন্টস রুমে”, যেটা কিনা এখন আমার ঘর। বাক্সপেটরা ঘেঁটে বের করলাম ট্যাবলেটের পাতাটা, আর সেটা থেকে খুলে নিলাম দুটো ট্যাবলেট। একটাতেই কাজ হয়ে যাবার কথা, কিন্তু আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না। চামচ দিয়ে নেড়েচেড়ে বেশ ভালো করে ট্যাবলেট দুটো চায়ের সাথে মিশিয়ে নিলাম।মেয়েটা আবার চায়ে চিনি খায় না। ডায়েটের নামে যত্ত সব ন্যাকামো! টের পেয়ে নিশ্চয় “চায়ে চিনি কেন?” বলে চ্যাচাবে! চ্যাচাক। ঐশীকে যা বলেছিলাম, ওকেও তাই বলব- “খুব ভুল হই গ্যাছে মাগো। দাঁড়াও আবার বানায় আনি।” আমি জানি, সে এই চা-ই খাবে, কারন তার হাতে সময় নেই। খুব তাড়াহুড়ো করে সাজছে।
চায়ের কাপ হাতে তার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। “চা এনেছ? টেবিলে রাখো বুয়া।”-আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো সে। আমার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। শিউরে উঠলাম আমি। এতো ঐশী! অবিকল সেই নাক, মুখ, চোখ, ঠোঁট। আমার ঐশী! আমার বাচ্চাটা! আমার ওপর রাগ দেখিয়েছিল বলে শাস্তি দিয়েছিলাম ওকে। কঠিন সেই শাস্তি। হয়ত একটু বেশিই কঠিন! এই মেয়েটাকেও আমি একই শাস্তি দেবো। ঠিক হবে কি? হ্যাঁ, অবশ্যই ঠিক হবে। এই মেয়েটারও কঠিন শাস্তি প্রাপ্য।
“মাগো, তোমার চায় পুকা পড়ছে। দাঁড়াও, আবার বানায় আনি।”কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে গেলো। চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে দিকে ছুটতে ছুটতে শুনলাম মেয়েটা বলছে- “লাগবে না বুয়া। দেরি হয়ে গেছে আমার, বেরুলাম। আর হ্যাঁ, বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাচ্ছি। তোমার উপর আর ভরসা করা যাচ্ছে নাহ!”
বাইরে থেকে তালা দিয়ে গিয়ে ভালোই হল। শাস্তির বিকল্প পরিকল্পনায় বরং সুবিধাই করে দিয়ে গেলো মেয়েটা। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে একবার ভালো করে দেখলাম, তারপর চুমুকে চুমুকে পুরোটুকু শেষ করে ফেললাম। তারপর গিয়ে শুয়ে পড়লাম মা টার শোবার ঘরের বিশাল বিছানাটায়। হা হা হা! মেয়েটার উপযুক্ত শাস্তির ব্যাবস্থা করে দিয়েছি। আমার আপাতত প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। একটা অনন্তকালের প্রশান্তির রাজকীয় ঘুম আমার প্রাপ্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৭ রাত ৩:২৮