শেষ পর্ব : সজীবের কথা...
মুঠোফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় সজীবের। দেয়াল ঘড়িটা সময় জানায়- রাত তিনটা পঞ্চাশ। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে এত রাতে যে ফোন করেছে তার মুণ্ডুপাত করতে করতে ফোন হাতে নেয় ও, আর ডিসপ্লেতে কলারের নাম দেখে থমকে যায়। লাবণ্যর হাসিমুখ...আলো জ্বলছে আর নিভছে। “বন্নি ফোন করেছে!এত দিন পর বন্নি আমাকে ফোন করেছে!!এত রাতে! কোনও সমস্যা হয় নি তো ওর!” একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে ফোন রিসিভ করে সজীব- “হ্যালো!”অপর পাশ নিরুত্তর। “হ্যালো! হ্যালো! কথা বল বন্নি। হ্যালো! কথা না বললে এত রাতে ফোন করলি কেন? হ্যালো! হ্যালো!...”ফোনের লাইনটা কেটে যায়। নেটওয়ার্ক ফেইলিওর।
আবার শুয়ে পড়ে সজীব। কিন্তু ঘুম আর আসে না কিছুতেই।এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় উঠেই বসে ও। বালিশের নিচ থেকে বের করে আনে লাবণ্যর ছবিটা...মুখে হাত দিয়ে আনমনে কী যেন ভাবছে মেয়েটা। “কী রে পাগলী, কী এত ভাবিস সারাক্ষন তুই?আমার কথা বুঝি?”মনটা অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায় সজীবের-“নাহ! তুই আমার কথা আর ভাববি কেন? তুই তো তোর মত করে ভালো থাকা শিখে গেছিস... নিজের মুখেই বললি, যেদিন তোর সাথে দেখা হল বকুল তলায়। আমাকে একবার ক্ষমা চাওয়ার কোনও সুযোগ না দিয়ে চলে গেলি... দোষ কি শুধু আমার একার ছিল? তোর কোনও দোষ ছিল না? এতই যদি ভালবাসিস, ফেরালি না কেন আমাকে সেদিন?? আমি তোকে বললাম, আর তুই আমাকে যেতে দিলি! কেন যেতে দিলি আমাকে তুই? কেন আটকালি না? জানিস, তুই একবার বললেই আমি ফিরে আসতাম তোর কাছে। অথচ তুই কি করলি? নিজে থেকে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিলি। এমনকি আমি যে তোর খোঁজ নেব, সেই পথ ও তুই বন্ধ করে দিলি। তুই কি একবার জানতে চাইতে পারতিস না কেন আমি তখন তোকে এই কথা বলেছিলাম?এত কিসের অভিমান তোর? জানিস, আগের রাতে আমার ভাইয়ার খুব খারাপ একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। ভাইয়ার পঙ্গু হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা ছিল ৭০%।তুই তো জানিস আমার বাবা নেই, ভাইয়াই আমাকে বাবার মতন করে আগলে রেখেছে। একে ভাইয়ার ওই অবস্থা, তার ওপর আমার পড়ালেখা শেষ হয়নি। তাই ভাইয়ার যদি কিছু হয়ে যেত, সংসারের ভার তো আমাকেই নিতে হত। তুই ই বল, তখন ভালবাসার কথা চিন্তা করা কি আমার জন্যে বিলাসিতা নয়?”বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে সজীবের। কান্নারা গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে আটকে যায়। কষ্টগুলো সাপের মত অষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলতে চায় ওকে।
মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। ওজু করে নামাজের পাটিতে দাঁড়ায় সজীব। “বন্নি, তুই আমাকে রোজ নামাজ পড়া নিয়ে বকাবকি করতি না, এই দেখ, আজ থেকে আমি নিয়মিত নামাজ পড়ব।আর মোনাজাতে খোদাকে বলব- খোদা, আমার বন্নিকে তুমি আমার কাছে ফিরিয়ে দাও প্লিজ...”
পরিশিষ্টঃ পরদিন সকাল ১০ টার দিকে সজীব ফোন করেছিল লাবণ্য কে। লাবণ্য ফোনটা ধরে নি। ফোন ধরে সজীবের সাথে কথা বলার মত মনের অবস্থা ছিল না ওর। সাড়ে দশটার দিকে সজীবের মুঠোফোনে একটা ক্ষুদে বার্তা আসে – “আমার ক্লাসমেট সজীব কে ফোন করতে গিয়ে ভুলে তোর কাছে কল চলে গিয়েছিল। মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।” দেখে সজীব খুব হেসেছিল- অতি দুঃখেও যে মানুষের হাসি পায়! “পাগলীরে, তুই তো জানিস না, তুই ঘুম ভাঙাবি, এই আশাতেই রোজ রাতে আমি ঘুমাতে যাই।” আনমনে ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হচ্ছিল সজীব।
শাহবাগের মোড়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল সেদিন। ২২-২৩ বছরের একটা ছেলে বাসের চাপায় গুরুতর আহত হয়। ছেলেটা সজীব কিনা আমার জানা নেই। ছেলেটা বেঁচে আছে কিনা, ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের ডাক্তার জানে... আমাকে কেউ বলতে পারে নি।
উৎসর্গঃ সেই ছেলেটাকে... যাকে কখনো বন্ধুর চেয়ে আরও একটুখানি বেশি ভেবেছিলাম।
View this link
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১:২৮