মিথিলার সাথে আমার পরিচয় নেটে। আরও ভালো করে বললে ব্লগে। নতুন নতুন লেখা শুরু করেছে…হিট প্রায় নেই বললেই চলে। কমেন্টের রিপ্লাই দিত ভাইয়া ভাইয়া করে। আর আমাকে কেউ ভাইয়া বলছে দেখে আমিও মজা পেতাম। তারপর একদিন ফেসবুকে অ্যাড দিল, সাথে একটা ইনবক্স-“সাজিদ ভাইয়া, আমি মিথিলা, মিথিলা শবনম।”বেশ মজা পেয়েছিলাম ইনবক্স টা দেখে। তারপর প্রায়ই চ্যাট হতে লাগলো ওর সাথে। আস্তে আস্তে জানতে পারি ও আমারই ব্যাচমেট, বুয়েটে পড়ছে। কেমন করে যেন খুব ভালো বন্ধুও হয়ে যাই আমরা, অবশ্যই ভার্চুয়াল বন্ধু। মিথিলার যে জিনিসটা আমার সবচাইতে ভাল্লাগত, সেটা হল মেয়েটা অসম্ভব রকম হাসিখুশি। ১০৩ জ্বর, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না, তারপরও কেমন আছিস জিগ্যেস করলে একগাল হেসে বলত- “খুব ভালো।”আর আমারও খুব ভালো লাগত ওর এই হাসিটা। সত্যি কথা বলতে কি, আমি সন্ধ্যা থেকে অনলাইনে অপেক্ষা করতাম কখন ও চ্যাটে আসবে।সামিয়া রাগারাগি করত… আম্মু চিল্লাতো-“পড়া লেখা নাই?? সারাক্ষন ফেসবুকে বসে থাকলে পরীক্ষা কে দিয়ে দেবে??” আমি নির্বিকার।
এই মেয়েটাই তাই যেদিন বলল ভালো নেই, মন খারাপ, কেমন যেন বিচলিত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কি হয়েছে পাগলীটার?? নিশ্চয় খুব খারাপ কিছু- না হলে তো ওর খুব ভালোর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা না। শ্রাবনের দিন…বর্ষার বিরাম নেই। সামিয়া কয়েকদিন ধরে খুব অদ্ভুত ব্যবহার করছে… কথা বলে না ঠিক মত, ইনবক্স গুলোর জবাব দেয় না… কেমন যেন একটা দূরের মানুষ ভাব। আর আজ মিথিলাও বলল মন ভালো নেই… আমার চারপাশ কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে। সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে তাই অবশেষে লিখেই ফেলি- “দোস্ত, তোর ফোন নাম্বার দে, কথা বলব।”
অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম ওর সাথে সেদিন।খুব দুঃখ নিয়ে বেচারি আমার কাছে উজাড় করে দিয়েছিলো ওর অতীত, সমস্ত দুঃখের ডালি উল্টে ফেলে দিয়ে হাল্কা হয়েছিল খুব সহজেই। আর আমি অনেক বড় একটা সত্যি আবিষ্কার করেছিলাম- পরিচিতের চাইতে অপরিচিতের কাছে অকপট স্বীকারোক্তি অনেক অনেক বেশি সহজ।মিথিলাকে আর একবার নতুন করে ভালো লেগেছিল সেইদিন- ওর শিশুর মত সারল্য আর অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠের জন্য।
সামিয়া আমাকে ছেড়ে চলে গেলো অবশেষে।ওফ! সেই দুঃসহ দিনগুলো! আমি আজ আর মনেও করতে চাই না। আমার দিন গুলো কেটে যেত ঘোরের মধ্যে। রাতগুলো কাটত না। ঘুম হত না এক ফোঁটাও। সারারাত জেগে থাকতাম। বিয়ারের ক্যান শেষ হয়ে গেলে অসম্ভব শূন্যতায় একা একা কাঁদতাম। মাঝে মাঝে আম্মু এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে যেত। আর যেদিন আম্মুর অসুখ বেড়ে যেত, সেই রাত গুলো আমার জন্য নরক হয়ে যেত। মিথিলা সান্ত্বনা দিত সব সময়। আশা দিত, সাহস দিত, বেঁচে থাকার প্রেরনা দিত। তাই যে রাতে আর থাকতে পারতাম না, ওকে ফোন দিতাম। বেচারির কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে মাতালের মত উল্টো পাল্টা বকতাম।তবু ওর সেই হাসি…বিধাতা বোধ হয় ওর মধ্যে বিরক্তি নামক আবেগ টা দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। মিথিলার হাসি…আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম দিনকে দিন।
অনেক বার বলার চেষ্টা করেছি ওকে। পাত্তাই দিত না আমার কথা। ফাজলামি করে উড়িয়ে দিত… ভাব ধরত আমি যেন পাড় মাতাল হয়ে আবোল তাবোল বকছি। একদিন তাই ওকে বলেই ফেলেছিলাম-“আমি যদি তোকে এখন সত্যি সত্যি বলি,তাহলেও তুই মনে হয় ফাজলামি করে উড়িয়ে দিবি, নারে??” জবাবে অনেক গুলো ভারি ভারি আর জ্ঞানী জ্ঞানী উপদেশ জুটেছিল আমার কপালে।তার ঠিক এক সপ্তাহ পরেই হঠাৎ পাগলীটার মেইল এল- “সাজিদ, দুইটার পরে একটু কল দিস তো আমাকে। কথা বলব।” মিথিলা আমার সাথে এত রাতে কথা বলতে চায়!! আমি কি ঠিক দেখছি!! পরবর্তী দুই ঘণ্টা ধরে আমি শুধু ঘড়িই দেখেছি…কখন দুইটা বাজবে, আর কখন আমি মিথিলাকে ফোন দেবো?? সময় কেন কাটে না??
ভালোবাসার তোড়ে ভেসে গিয়েছিলাম আমরা।দুইজনের ই বাসা থেকে প্রবল আপত্তি ছিলো… চিনিনা, জানিনা, দেখিনি পর্যন্ত কেউ কাউকে। তারপরও আমরা ভালো বেসেছিলাম একে অপরকে… সমস্ত হৃদয় নিংড়ে……যে কয়টা দিন আমরা একসাথে ছিলাম, স্বপ্নের মত লাগে আমার কাছে। রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটে যেত কথায় কথায়।কত গল্প,কত স্বপ্ন একে অপরকে নিয়ে। কবে দেখা হবে সেই হিসাব করতে করতে কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা।দিনে ১০-১২টা মেইল আদান প্রদান হত ছবির জন্য। আমি তাকিয়েই থাকতাম ওর ছবির দিকে। মিথিলার ঠোঁটের নিচে একটা ছোট্ট তিল… পাগলিটা নিজেও হয়ত জানে না এই তিলটা ওর সৌন্দর্য কত্ত বাড়িয়ে দিয়েছে।ওর ছবিতে আলতো করে স্পর্শ করতাম,আমার লক্ষ্মী বাবুটার যেন এতোটুকুও না লাগে। আমি ছিলাম ওর পাজি বাবু…আর ঘুম ভেঙ্গে এই ডাক টা না শুনলে আমার দিনটাই খারাপ যেত। শুধু অপেক্ষা করতাম কবে গ্রাজুয়েশন শেষ হবে, একটা চাকরী পাবো, আর আমার লক্ষ্মী বাবুটাকে ঘরে তুলে আনব।সারাদিন মিথিলার ছবি দেখতাম, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম।
বিপত্তির সূত্রপাত ওই ছবি থেকেই।আম্মুর কাছে ধরা পড়ে গেলাম একদিন ওর ছবি দেখতে গিয়ে।মিথিলার স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল, আর দেখতে নাদুস নুদুস একটা বাবুর মত লাগত। ওর ছবি দেখে আম্মু ঘোষণা দিল ও নাকি আমার থেকে বয়সে বড়। আর তারপর থেকে এইটা নিয়ে আমাকে নিয়মিত খোঁচাতে লাগলো। মাঝে মাঝে আমি হাসতাম, আবার মাঝে মাঝে রাগ ও হত বেশ।তখন ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে আম্মুর সাথে ঝগড়া করে আসতাম। আমি তো জানতাম আমার মিথিলা কী। কিন্তু আম্মুকে সেইটা কে বোঝাবে??
হঠাৎ করে একদিন সামিয়ার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল আমার। মনটা খুব খারাপ ছিল। ছুটির দিন, তাই প্রায় সারাটা দিনই মিথিলার সাথে কথা বলেছিলাম। সান্ত্বনা দিচ্ছিল মেয়েটা আমাকে। ঠিক এই সময় আম্মু এসে বকাবকি শুরু করেছিল। আমার মন ভালো ছিল না,তাই আমিও রেগে গিয়েছিলাম। আর তখনই আম্মু আমাকে আবার খোটা দিল- “বয়সে বড় একটা মেয়ের সাথে প্রেম করিস, তোর লজ্জা করে না??”উত্তেজনার বসে আমি ফোনের লাইন কাটতে ভুলে গেছিলাম, মিথিলা সব ই শুনেছিলো সেইদিন। জানিনা ও কখন ফোন রেখেছিল, জানিনা ওর মনে তখন ঠিক কতখানি কষ্ট লেগেছিল। ঘণ্টা খানেক পরে আবার ফোন দিয়েছিলো মেয়েটা, আমার গরম মাথা তখনো ঠাণ্ডা হয় নি, আর আম্মুও থামেনি তখনো। ফোন ধরে ওকে কিছু বলার সুজগ দেই নি আমি- “তোর সমস্যা কি রে?? আমাকে তুই একটু বল সমস্যা কি তোর? তুই কি আমাকে একটুও শান্তিতে থাকতে দিবি না??”আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনের লাইন কেটে যায়। আর কোনদিন মেয়েটা আমার ফোন ধরে নি। কত চেষ্টা করেছি আমি… কত ফোন কল, কত এস এম এস… কতবার গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি ছাত্রী হলের সামনে… কোনও লাভ হয় নি। আমার মিথিলার দুরন্ত অভিমান ভাঙ্গেনি… আমার মিথিলা ফেরেনি আর… কতদিন আমি ওর গলা শুনিনা! আমার যখন তখন হাঁসফাঁস লাগে।
সাত মাসের মাথায় খবর পেলাম মিথিলার বিয়ে… বাবা-মার পছন্দ করা পাত্র…কর্পোরেট চাকুরে… বয়সে ওর চাইতে ১১ বছরের বড়। সেইরাতে আর একবার বিয়ারের ক্যান নিয়ে বসেছিলাম…কিন্তু গলায় ঢালতে পারিনি… আমার মিথিলা মাথার দিব্যি দিয়ে রেখেছে যে আমাকে!!
আজ দুপুরে সাদীর সাথে ঝগড়া করেছি… ব্যাডমিন্টন র্যা কেট নিয়ে এত্ত বায়না করে না!! রাগ করে বাসা থেকে বেরনোর মুখে আম্মু বলল বসুন্ধরা সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যেতে…কী নাকি কেনাকাটা আছে। কেনাকাটা শেষ করে পারকিং লটে গিয়ে দেখি তিনটা দেবশিশু এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে, আর অল্পবয়সী একটা মেয়ে তাদের ধরে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছে। আম্মু যথানিয়মে জ্ঞান দেয়া শুরু করল- “দেখ দেখ… একেই বলে ভাই বোন। ওইটুকুটুকু ভাইবোনকে নিয়ে মেয়েটা একা এসেছে দেখেছিস!! আর তুই তো সারাটাদিন সময় পেলেই সাদীর সাথে ঝগড়া করবি…”আম্মুর কথা কিছুই আর আমার কানে ঢুকছে না।আমি স্তম্ভিত হয়ে মেয়েটাকে দেখছি… মিথিলা!! এত্ত সুন্দর হয়েছে!!আর ওর বাচ্চাগুলোও কি মায়াকাড়া! আম্মু হঠাৎ করে আমার হাত ধরে টান দেয়। বাস্তবে ফিরে আসি আমি। বহু কষ্টে বাচ্চাগুলোকে আদর করার লোভ সামলাই।গাড়ির দিকে যেতে যেতে শুনতে পাই স্বপ্ন রিনরিনে কণ্ঠে বলছে-“মা,তুকি!!”আর মিথিলা ওকে কোলে তুলে নিয়ে হাসছে…ওর সেই মিষ্টি হাসিটা। হঠাৎ আম্মুর কণ্ঠে চমকে যাই- “মা মানে! এই মেয়েটা কি বাচ্চাগুলোর মা নাকি!! এত্ত ছোট বয়সে এখনো মানুষ মেয়ের বিয়ে দেয়?? এই লোকগুলোকে পুলিশে দেয়া উচিৎ।” আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলি- “আম্মু, এই মেয়েটাই মিথিলা। বুয়েট থেকে পাস করে এখন রবি তে চাকরী করছে।মেয়েটা আমার চাইতে বয়সে বড়, তাইনা আম্মু??”
খুব লোভ লাগছিলো আম্মুর মুখটা একবার ভালো করে দেখি… পারলাম না। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেলো কেন জানি। গাড়ির মিউজিক প্লেয়ারটা অন করলাম,ভেসে এল মিথিলার সবচাইতে প্রিয় গানটা-
একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে
থাকবেনা সাথে কোনও ছাতা…
আমার কাছে কোনও ছাতা নেই আজকে। আমি ভিজে চলেছি অঝোর বৃষ্টিতে… আমার দু চোখে যে আষাঢ়-শ্রাবনের চাইতেও বেশি মেঘ জমে আছে…
উৎসর্গ: প্রিয় বড় আপু মাহী ফ্লোরা কে। চালতার আচার টা আর একবার খেতে চাই আপুনি।
পুনশ্চ- লেখাটা এইখানে প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১:০৮