শিরোনাম দেখেই অনেকেই ভাবা শুরু করছেন মুফতি কাজি ইব্রাহীম, এত বড় একজন ধর্মিয় বক্তা তার আবার কিসের অপরাধ। এই লেখাটা সবার আগে আপনাদেরই পড়ার অনুরোধ করবো। মুফতি সাহেব তার বক্তৃতায় যত রকমের বৈজ্ঞানিক তত্ব দেয়, নাসার বিজ্ঞানীদের যে সকল রেফারেন্স নিয়ে আসে সবগুলোই মূলত ওনার মনগড়া। সেগুলো মিথ্যে কিনা সে দিকে আমি না যাই। (ওনার সব ধরণের রিসার্সের রেফারেন্স মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার, এমনকি মেডিকেল সায়েন্সের রেফারেন্সও)
এন্টারোকোটিক মহাদেশের নিচে আরেকটা পৃথিবী, হিটলারের সেখানে পালিয়ে যাওয়া, টাকনুর নিচে সেক্স হরমোন, ৫ বছরের মধ্যে পৃথিবীর আহ্নিক গতি বন্ধ হয়ে সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উঠা শুরু করা; তার এমন আরো অনেক তত্ত্ব নিয়ে সবাই হাসি-তামাসা করে। কিন্তু তার এমন দুটো ভয়ংকর তত্ত্ব আছে যেগুলো আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষদের সরাসরি বিভ্রান্ত করতে পারে। অনেকেই তা বিশ্বাস করে ফেলতে পারে। এই বিশ্বাসের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে নিজেরাই।
এই দুটো মনগড়া তত্ত্বের কারণেই যে ওনাকে অপরাধী বলা যায় সেদুটো নিয়ে বলি।
প্রথমত শিশুদের টিকা নিয়ে উনার একটা তত্ত্ব আছে। যেটাতে উনি বলেছেন, শিশুদের টিকা দেয়ার আসলে কোন দরকার নেই। এটা ইহুদিদের চক্রান্ত। এই টিকার মাধ্যমেই নাকি আফ্রিকাতে এইডস ছড়িয়ে দিয়েছে। শিশুদের জন্য আকিকাই যথেষ্ট। আকিকা দিলেই আর কোন রোগ হবে না।
আরেকটা তত্ত্বে তিনি বলেছেন, কুত্তি একসাথে এতগুলা বাচ্চা দেয় কোন চিকিৎসা ছাড়াই। মহিলাগো ক্যান এত ডাক্তার লাগে? সিজার লাগে? এত চেক আপ লাগে? এগুলোর নাকি আসলে কোন দরকার নাই!
১০-১৫ বছর আগেও পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম ও ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা কি পরিমাণ ছিলো সেটা জানার জন্য কোন পরিসংখ্যানের দরকার হয় না। এসব মানুষের চোখে দেখা। আর ইপিআই সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে গত কয়েক বছরে এই ধরণের রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা একদম নেই বললেই চলে (২০১৪ সালে বাংলাদেশ পোলিও মুক্ত দেশের তালিকায় এসেছে)।
আর এমন একটি সময়ে জবাব ইব্রাহীম সাহেব বলে বসলেন, টিকাটুকার আসলে কোন দরকার নাই। আকিকাই যথেষ্ট।
এখন ইব্রাহীম সাহেবের এই কথায় বিশ্বাস এনে একজন বাবা-মাও যদি সন্তানকে টিকা না দেয় আর সেই সন্তান যদি পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম ইত্যাদি ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হয় সেই দায়ভার কে নিবে? গ্রামের প্রান্তিক মানুষ হাজার বছরের কুসংস্কারের কারনে এমনিতে কিছুটা পিছিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের এইসব বোঝাতে প্রচুর বেগ পেতে হয়। অনেক পরিশ্রমের ফলে মানুষ এখন টিকাদান ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখেছে। এই প্রান্তিক মানুষরাই ইব্রাহীম সাহেবদের সবচেয়ে শ্রোতা ও ভক্ত। তারা কেউ যদি ইব্রাহীম সাহেবের কথায় বিভ্রান্ত হয়, টিকা না নেয়, তাদের সন্তানরা পোলিওতে আক্রান্ত হয়, এই দায়ভার সম্পূর্ণ রূপে মুফতি ইব্রাহীমের ঘাড়ে বর্তায় না? এটা অপরাধ না?
গর্ভধারণ প্রক্রিয়া, সন্তান প্রসবের সময় মায়ের মৃত্যু, প্রসবের সময় শিশুর মৃত্যু এক সময় আমাদের দেশে স্বাভাবিক ঘটনা ছিলো। অপরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভবতী থাকা অবস্থায় সঠিক যত্নের অভাবে নানান ধরণের স্বাস্থ্য জটিলতায় প্রচুর মহিলারা এখনো ভোগে। গ্রামে বেশিরভাগ মুরুব্বি এখনো বিশ্বাস করে গর্ভবতী মায়ের আসলে এত চেকআপ টেকআপ এর দরকার নাই। এইসব আসলে হুদাই টাকা খরচ! তবে এই অবস্থায় পরিবর্তন ঘটছে। অনেক চেষ্টার ফলে গ্রামের অনেক মানুষ এখন গর্ভবতী মায়ের যত্নের বিষয়ে সচেতন হতে শুরু করেছে।
এমন সময়ে যদি কাজী ইব্রাহীম সাহেবের এমন মনগড়া তত্ত্বে কেউ বিশ্বাস করে আবারো আগের ধ্যানধারণায় ফিরে যায়, এর ফলে যদি আবারো কোন মায়ের-শিশুর অকাল মৃত্যু ঘটে, ভয়াবহ স্বাস্থ্য জটিলতা তৈরি হয় তার দায়ভার কে নিবে? কোন ধরণের গবেষণা ছাড়া এমন মনগড়া বিপজ্জনক তত্ত্ব দেয়ার জন্য তার দায়ভার কি মুফতি ইব্রাহীমের ঘাড়ে যায় না? উনি কি অপরাধী না?
সবশেষে মুফতি ইব্রাহীম সাহেবের কাছে আমার একটা প্রশ্ন, গর্ভধারণের সময় কোন কুত্তি মারা যায় না; নাসার বিজ্ঞানীরা এমন কোন গবেষণাপত্র ওনার কাছে দিয়েছে কি না?
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:৩১