ব্যাচেলর বলতে গণমানুষের চোখে ভেসে উঠে এমন কিছু যুবকের চিত্র, যাদের রুম সবসময় অগোছালো থাকে, রাতজেগে সকালে দৈনন্দিন কাজের প্রয়োজনে ঠিকমতো উঠতে পারে না, বাসায় বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা দেয়, সকালের খাবার দুপুরে আর দুপুরের খাবার রাতে খায়! তাদের জীবনে ব্রেকফাস্ট বলে কোন শব্দ নাই। কেবলমাত্র ডিমভাজি আর আলুবর্তা ছাড়া এরা আর কোন প্রকারের খাবার তৈরি করে পারে না বিধায় বুয়ারা যাই রান্না করে গিনিপিগের মতো তাই খাওয়া লাগে।
কিন্তু আমাদের আশরাফ ছিলো ঠিক এইগুলার উলটো! ব্যাচেলর সমাজের গোবরে পদ্মফুল টাইপ সোনার ছেলে ছিলো আশরাফ। সে খুবই গোঁছালো ও সময়ের ব্যাপারে সচেতন ছিলো। আর তার সবচেয়ে বড় গুণ সে অসম্ভব ভালো রান্না জানতো। আর এই রন্ধনশিল্প আয়ত্ব করাই তার জীবনে বিড়ম্বনা হয়ে এসেছিলো। ব্যাচেলর সমাজে ভালো রান্না করলে বিড়ম্বনার স্বিকার হওয়াই স্বাভাবিক।
দেশি সুস্বাদু প্রায় সব খাবারের রেসিফি তার আয়ত্বে ছিলো। আশরাফ থাকতো চট্রগ্রাম। বাসায় কোন বুয়া রাখতো না। আমরা ওর বাসায় গেলে ওর খবর নেয়ার আগে ওর বাসার হাঁড়ির খবর নিতাম। আমাদের পার্বত্য চট্রগাম কিংবা কক্সবাজার ভ্রমণে বেজ ক্যাম্প থাকতো আশরাফের বাসা। বেজ ক্যাম্পে মাঝে মাঝে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও আমাদেরকে রান্না করে খাওয়াতো সে। আবার বিশেষ দিবসে আশরাফ ঢাকা আসলে আমরা আমাদের বুয়াকে ছুটিতে পাঠাতাম।
আশরাফ যে শুধু আমাদের রান্না করে খাওয়াতো তাও না। ওর এই রন্ধনশিল্পকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের প্রেমিকাদের কাছে হয়ে উঠেছিলাম এলিট শ্রেণীর ব্যাচলর। ওর কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের রন্ধনপ্রণালী বলে দিয়ে আমরা "যে ব্যাচেলর সে রান্নাও করে" টাইপ ভাব নিয়ে প্রেমিকাদেরকে অবাক করে দিতাম। দু-একজন এই প্রক্রিয়ায় প্রেমিকাদের ইম্প্রেস করে প্রেম করে ফেলেছে। ও মাঝে মাঝে ত্যাক্ত-বিরক্ত হলেও আমরা খুব একটা পাত্তা দিতাম না এইসব।
এরকমই এক বর্ষায় আশরাফ ঠিক করলো তার পছন্দের মেয়েকে সাথে করে ওর নিজের হাতের রান্না করা খাবার সহ ক্যান্ডেল নাইট ডিনারের আয়োজন করে মেয়েকে প্রোপোজ করবে। সাহস জোগানোর জন্য আমাদের ডাক পড়লো। আমরাও হালুম ঢেঁকুর তুলে হারেরেরে করতে করতে চট্রগ্রাম চলে গেলাম। আশরাফের বাসায় গিয়ে বুঝলাম রান্নাবান্না সহ বাকি সব আয়োজন সম্পন্ন। আমরা কয়েকঘন্টার জ্যাম ঠেলে চট্রগ্রাম গিয়ে একিসাথে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত ছিলাম। পরিকল্পনা ঠিক হলো আশরাফ মেয়েকে আনতে যাবে আর আমরা ঘরে হরেকরকম মোমবাতি জ্বালিয়ে ওর দেয়া ডিজাইন অনুযায়ী টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখবো। পরিকল্পনা অনুযায়ী রুম সাজিয়ে আমরা একটা চিরকুটে "আমরা খুবই ক্লান্ত, ডিস্টার্ব করবি না! তোদের জন্য শুভকামনা" লিখে দরজা একটু ভেজিয়ে দিয়ে তব্দা মেরে শুয়ে ছিলাম। যথারিতি আশরাফ মেয়েটাকে নিয়ে বাসায় আসলো। এসে দেখলো মোমবাতি, তাদের জন্য রেডি করা স্পেশাল টেবিল সবই ঠিক আছে শুধু টেবিলে খাবার নেই। নিজেকেই সব পরিবেশন করতে হবে ভেবে আশরাফ রান্নাঘরে গিয়ে দেখে হাঁড়ি-পাতিল সবই আছে কিন্তু পাতিলেও কোন খাবার নেই। আমরা আসলে তেমন কিছুই করিনি, আশরাফ মেয়েটাকে আনতে যাওয়ার পর আমরা ফ্রেশ হয়ে বসতেই ক্ষুধা আলোর গতিতে বেড়ে যাওয়ায় আমরা কেবল খাবারগুলো একটু ছেখে দেখেছিলাম। তাতেই যে সব খাবার শেষ হয়ে যাবে এই ধারনা আমাদেরও ছিলো। ক্ষুধার রাজ্যে যেখানে পূর্নিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি সেখানে ক্যান্ডেল নাইট ডিনারকে পাত্তা দেয়ার কোন মানেই হয়না!
শেষ পর্যন্ত আশরাফের প্রেম আর হয়নি। কিন্তু তার বাসায় আমাদের খাওয়া চলছে অবিরাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:০৭