একজন লেখকের নাম মনে পড়ছে, যার কাছে শুনেছিলাম হিন্দু ছাত্র ছিল বলে হোস্টেলে তারা গরু গোশত খেতেন না। তিনি 'জিবরাইলের ডানা'র গল্পকার শাহেদ আলী।
আমরা মোছলমানরা অন্য ধর্মের লোকদের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল। খেয়াল করবেন, আমি কিন্তু মোছলমানের কথা বলেছি, আমি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীলদের কথা বলছি না, যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেন এবং আমি মৌলবাদী রাজনীতিকদের কথাও বলছি না যারা মানুষের মাঝে ভাগ করেন।
ভাটি বাংলায় মানুষের বিভেদটা আমরা বহু আগেই করেছি। শিক্ষকদের কটাক্ষ আমাদের নেতৃস্থানীয়রাই করছেন। আমরা সুযোগ বুঝে, পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করি। এ একটা জিনিস মানতে পারি না। শিক্ষকদের হেলা, অবহেলা কোনোভাবেই গ্রহণ যোগ্য হতে পারে না।
আমি বলছি না, জগতের সব শিক্ষক মহান হবেন, সব দল মত শিক্ষকদের একই রকমের শ্রদ্ধা পাবেন , রাষ্ট্র একই ভাবে মূল্যায়ন করবে। এটা কেন বলছি, কারণ এখানে রাজনীতিই মুখ্য। ধর্ম নিয়ে ব্যবসার রাজনীতি, নোংরামি এখানে প্রচণ্ড রকমের। আসলে মনে যদি কেউ পরধর্ম সহিষ্ণু না হন, লো্ক দেখানো ভাব নিয়ে বেশি দিন চলা ভারি মুশখিল। অভিনয় সব সময় করা যায়, তবে সব সময় একই রকম মুখোশ লাগিয়ে থাকা যায় না।
সেলিম ওসমান যে কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন, যে অজুহাতে তিনি এর দায় থেকে নিজেকে মুক্ত মনে করছেন---তাতে আমরা সবাই অত্যন্ত আহত বোধ করছি। একজন রাজনীতিক, জনরোষকে সামলানোর জন্য একজন শিক্ষককে কান ধরে ওঠবোস করানোই সমর্থন দেবেন এটা কোনো বিচারেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যদি জনরোষ সামলাতে তিনি অক্ষম হন, তাহলে তিনি রাজনীতিক নন, তিনি রাজনীতিক হতে পারেন না।
শিক্ষক পরিবারে জন্ম নেয়া সন্তান হিসাবে শ্যামল কান্তি ভক্তের অপমানের ব্যথা, কষ্ট এবং অসহনীয় যন্ত্রণা আমাকেও কুরে কুরে খাচ্ছে, প্রতি মুহুর্তে। চোখরে সামনে ভাসছে একজন নিরীহ অসহায় মানুষের মুখ, যার কানে হাত! কম বেশি সবার জানা রাজধানীসহ সারা দেশে ৯৯.৯৯ শতাংশ স্কুল কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকরা স্থানীয় রাজনীতিকদের কাছে জিম্মি।
বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরিই তাদের হাতে । পছন্দ না হলে তাকে নিয়ে কু রাজনীতির চর্চা বহু আগে থেকেই আমার সরাসরি দেখা। তাই শিক্ষকদের রাজনৈতিক হয়রানি কবল থেকে রক্ষা উপযোগি শিক্ষাও শিক্ষার্থীদের দেওয়া দরকার। শিক্ষার্থীদের কেউ না কেউ বড় হয়ে নেতা, সন্ত্রাসী, ধনবান হচ্ছেন, যারা শিক্ষকদের জনরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য কান ধরে ওঠ বস করাচ্ছেন!
ক'দিন আগে মওলানা আবদুল লতিফ নেজামী অভিযোগ করেছেন, সিলেবাস থেকে কাজী কাদের নেওয়াজের 'শিক্ষাগুরুর মর্যাদা' মর্যাদা কবিতাটি তুলে দেওয়া হয়েছে। ড. কাজি দীন মুহম্মদের বিনয় নম্রতা উঠে গেছে আরো বহু বছর আগে। তাহলে সুশিক্ষা ! মিলবে কোথায়!
দেশে শিক্ষক নিপীড়নের ঘটনা এটাই প্রথম, তা কিন্তু নয়। খেয়াল করবেন, আমরা গত কয়েক বছরে বহু শিক্ষক হামলার শিকার হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহকে মারধর করে, জামা কাপড় ছিঁড়ে অর্ধনগ্ন করা হয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে।
আমরা এও দেখেছি প্রজন্ম লীগ আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পিটেয়েছে সঙ্ঘাত ঘটাতে পারে, এমন আশঙ্কায়। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ দেখিনি, কেন দেখিনি, তা হলো এর বিরোধী মতের শিক্ষক।
আবার জাফর ইকবালের মতো জনপ্রিয় শিক্ষককেও আমরা সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অপমানিত হতে দেখিছি। বয়োজ্যাষ্ঠ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীয় ড. এমাজ হুমকি পেয়েছেন, তার বাসার সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও আমরা খবরে পড়েছি।
আমরা মূল কথার জায়গাটা--- আমরা হুজুগে মাতি আবার একটা ঘটনা ঘটে আমরা সেটাকে নিয়ে ব্যস্ত হই। অত্যন্ত বেদনার বিষয় হলো শিক্ষক নিপীড়নের, হুমকির কোনো বিচার হয় না।
ক'দিন আগেই তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিমকে খুন করা হয়েছে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসায় ঢুকে অধ্যাপক আফতাব আহমদকে খুন করা হয়েছে। ড. হুমায়ূন আজাদ স্যারকে কুপিয়ে আহত করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই!
আমরা এ সব খুন, অপমান সহজে মেনে নিচ্ছি। এ মেনে নিতে আর রাজনৈতিক বিভাজন টানতে টানতে আক্রান্ত হচ্ছি নিজেরাই!
শ্যামল স্যার কিম্বা মাহবুব উল্লাহ স্যার, যে যখনই আক্রান্ত হন তাদের প্রতি দল মত নির্বিশেষে সহানুভূতি সবারই থাকা উচিৎ। রাষ্ট্র এ সব হামলা, অপমান আর অন্যায্য আচরণের বিচার করবে আমরা এটা আমরা আশা করি। যদিও বিচার হয় না! তবুও হবে এ আশাটাও কম কিসে!!
ধর্মকে ব্যবহার করে এর আগেও বহু নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। রামু কাণ্ড থেকে শ্যামল স্যার তার একটা উদাহরণ মাত্র। এ সব উদাহরণ সমূলে উৎপাটন করতে না পারলে আমরা 'মানুষ' হয়ে উঠবো না, এটা নিশ্চিত!
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৫