অবৈধ ভিওআইপি'র অভিযোগে দুইবার জরিমানা দিয়ে মুক্তি পাওয়া নরওয়েজিয়ান নাগরিক এরিক অস এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবইলফোন অপারেটর বাংলালিংকের সিইও।
২০০৭ এবং ২০০৮ সালে দুই দফা অবৈধ ভিওআইপি'র অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এরিকের সে সময়কার কর্মস্থল গ্রামীণফোন জরিমান গুনে তাদের দায়মুক্তি নিশ্চিত করে।
২০০৮ সালের ১৬ জানুয়ারী এরিকসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।
খবরের ইংরেজি ভার্সন পড়তে ক্লিক করতে পারেন http://www.theindependentbd.com/post/43540
রাজধানীর গুলশান থানায় দায়ের করা মামলা এখন চলছে না? এর কারণ ব্যাখ্যা করে মামলার বাদী জিয়ান শাহ কবির বলেন, এডমেনেস্ট্রেটিভ ফাইন দিয়ে অপারেটর দায়মুক্তি পেয়েছে। তাই মামলা চলছে না।
২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রামীণফোনের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসাবে নিয়োগ পেয়ে বাংলাদেশে আসার পর এরিকের হাতেই বদলে যেতে থাকে অপারেটরটি। তার হাতেই অপারেটরটি দেশীয় লোগো বদলে টেলিনরের লোগো লাগানো হয়। গত বছরের ১ ডিসেম্বর এরিক বাংলালিংকের সিইও হিসাবে যোগ দেন।
বাংলালিংকের কর্পোরেট কমিউনিকেশন্সের প্রধান আসিফ আহমেদ দি ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, 'ভিওআইপি ২০০৬-০৭ সালে একটি ইন্ড্রাস্ট্রি ইসু ছিল। এটা কোনো ব্যঅক্তি ভিত্তিক ইসু নয়। বাংলালিংক এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবে না, যার সাথে অন্য অপারেটরও জড়িত।'
তবে বাংলাদেশের কোনো অপারেটরের সিইও হিসাবে থাকতে তার আইনি কোনো বাধা নেই বলে জনিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিব আলম। তার মতে, নৈতিকতা যদি বলেন, সেটি যার চর্চা করার কথা তিনি ভালো বলতে পারবেন। তবে আইনে এতে কোনো বাধা নেই।
টিআইবি'র এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর ইফতেখারুজ্জামান ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, এরিক অস যদি অবৈধ ভিওআইপির মত একটা মামলায় অভিযুক্ত হন এবং জরিমানা দিয়ে তার কর্মস্থল তাকে মুক্ত করে থাকে, তার মানে অপরাধ প্রমাণিত, সে ক্ষেত্রে সেই একই সেক্টরে (টেলিকম) তার মত একজন মানুষের নিয়োগ নৈতিকভাবে সমর্থন করা যায় না। একটা রেসপন্সিবল কর্পোরেট হাউসের কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না।
তিনি বলেন, বিজনেস মানে শুধু প্রফিট মেকিং নয়, এখানে এথিকসেরও বিষয় আছে। আমি মনে করি এ নিয়োগ অনৈতিক। '
২০০৭ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপি বিরোধি অভিযোন শুরু করলে গ্রামীণফোন দুইবার, বাংলালিংক, একটেল ও সিটিসেল একবার করে সরকারকে প্রশাসনিক জরিমানা দিয়ে অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিটিআরসির সে সময়কার চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মনজুরুল আলম কললিস্ট পরীক্ষার উদ্যোগ নেন ২০০৭-০৮ সালে। সে সময় বিটিআরসি মোবাইলফোন অপারেটরদের অবৈধ ভিওআইপির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পায়।
২০০৭ সালের শেষ দিকে অবৈধ ভিওআইপির সঙ্গে জড়িত থাকায় গ্রামীণফোনকে প্রথম দফায় ১৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আর ২০০৮ সালের শুরুর দিকে গ্রামীণফোনে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ভিওআইপির যন্ত্রপাতি উদ্ধারের পর আবার ২৫০ কোটি টাকা জরিমানা করে বিটিআরসি।
বিটিআরসির তত্কালীন চেয়ারম্যান মনজুরুল আলম সে সময় জানিয়েছিলেন, ‘ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসায় গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও তার দলের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা রয়েছে। এটা আমাদের অনুসন্ধানে বের হয়েছে।’
সে সময় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গ্রামীণফোনও স্বীকার করে, তৃতীয়পক্ষকে অবৈধভাবে ভিওআইপি প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছিল তারা। এজন্য জরিমানার ২৫০ কোটি টাকা দিতেও সম্মত প্রতিষ্ঠানটি।
সে সময়কার গুলশান থানার সাব ইন্সপেক্টর মানজুর আলী খা্ন জানিযেছেন অবৈধ ভিওআইপর অভিযোগে দায়ের করা মামলার নম্বর ৪৬। এটি দায়ের করা হয় ১৬ জানুয়ারী।
মামলার আর্জিতে বলা হয়, ২০০৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংস্থার একটি দল আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামীণফোনের কার্যালয়ে অভিযান চালায়। এ সময় দেখা যায়, চারটি 'ই ওয়ান' সংযোগের মাধ্যমে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক অ্যাকসেস টেল এর নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। অভিযানকারী দলটি গ্রামীণফোনের কল রেকর্ড ও ই মেইল 'অনুসন্ধান' করেন। এরপর ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা আট দিন গ্রামীণফোনের কার্যালয়ে অনুসন্ধান চালায় দলটি।
অভিযানে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে গ্রামীণফোনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। এ কার্যক্রমে গ্রামীণফোনের বৈদেশিক সহযোগী হিসেবে মালয়েশিয়ার ডিজি টেলিকমের সংশ্লিষ্টতারও প্রমাণ মিলেছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, গ্রামীণফোনের বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক নরওয়ের প্রতিষ্ঠান 'টেলিনর' বাংলাদেশে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় উৎসাহ দিয়েছে বলে অনুমেয়। গ্রামীণফোনের 'মেইল সার্ভার' এ সন্দেহভাজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মেইল খতিয়ে দেখে কল টার্মিনেশনে সংস্থার সম্পৃক্ততাসহ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিজস্ব সংশ্লিষ্টতারও আলামত পাওয়া গেছে।
গ্রামীণফোনের ৬২ ভাগ শেয়ারের মালিক টেলিনর মালয়েশিয়াভিত্তিক ডিজি টেলিকমেরও অংশীদার। অভিযানের সময় গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ করেছে বিটিআরসি।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, গ্রামীণফোনের হেড অফ রেভিনিউ অ্যাসুরেন্স এসপেন উইগ ০১৭১৩১৩০৪০০ নম্বরের কল রেকর্ড র্যাব সদস্যদের কাছে না দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশ দেন। পরে জানা যায় অ্যাকসেস টেল এর কল টার্মিনেশনের কাজে নম্বরটি ব্যবহৃত হতো।
মামলায় গ্রামীণফোন ছাড়াও এর সাবেক প্রধান নির্বাহী এরিক অস ও ওলা রি, সাবেক টেকনিক্যাল ডিরেক্টর থর রান্ডহগ, সাবেক চিফ টেকনিক্যাল অফিসার যোগেশ সঞ্জিব মালিক, সাবেক সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং ডিরেক্টর মেহবুব চৌধুরী, রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর খালিদ হাসান, চিফ টেকনিক্যাল অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম, সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং ডিরেক্টর কাফিল এইচ এস মুঈদ, চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার মো. আরিফ আল ইসলাম ও হেড অফ রেভিনিউ অ্যাসুরেন্স এসপেন উইগ ওয়ারেনডরফকে আসামি করা হয়েছিল।
অভিযুক্তরা কে কোথায়?
অভিযুক্তদের মধ্যে এরিক অসকে চাকুরী দিয়ে দেশে এনেছে ভিম্পেলকম। বাকিদের গ্রামীণফোন থেকে সরিয়ে টেলিনরে নেওয়া হয় এবং তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়।
অভিযুক্ত সাবেক সিইও Ola Ree বর্তমানে Head of Group Supply Chain Sustainability, Telenor. জুন ২০০০ সাল থেকে ২০০৪ সালে নভেম্বর পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে গ্রামীনফোনের এমডি ছিলেন। Yogesh Malik এখন VimpelCom এর Chief Technology Officer এবং Group Executive Board ও Group Management Board এর সদস্য।
Espen Wiig Warendorph এখন BellTel এর Advisor (Commercial) । গ্রামীণফোনে Technical Controller হিসাবে যোগ দেন ২০০৪ সালের এপ্রিল মানে। মাত্র এক বছরের মধ্যে ২০০৫ সালের মে মাসে তাতে পদোন্নতি দিয়ে করা হয় Head of Revenue Assurance & Fraud Management.
Kafil HS Muyeed বর্তমানে Managing Director, Cel Telecom Limited, গ্রামীণফোন থাকান অবস্থায় মামলার অভিযুক্ত হলে তাকে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরিয়ে দেয়া হয়। ওই বছরের এপ্রিল মাসে তাকে Consultant,Telenor হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়।
Md. Arif Al Islam বর্তমানে সামিট কমিউনিকেশন্সর সিইও এভং ভ্যবসায়িক অংশীদার। Mehboob Chowdhury সিটিসেলের সিইও হিসাবে বাংলাদেশেই কর্মরত রয়েছেন।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৮